জুলাই গণঅভ্যুত্থান: যে গ্যারেজ হয়ে উঠেছিল গুলিবিদ্ধ-আহতদের অস্থায়ী ক্লিনিক

চারিদিকে যখন ভয়, অনেকে যখন নিজেদের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন নিজেদের দুয়ার খুলে দেন তারা।

১৮ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা 'কমপ্লিট শাটডাউন' বাস্তবায়নে ধানমন্ডি-২৭ অবরুদ্ধ করে রেখেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের বাধার মুখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হলে সড়কটি পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। অনেকে নিহত হন, আহত হন কয়েকশ মানুষ। কিন্তু চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পাননি অনেকে।

হাসপাতালগুলোর সামনে মোতায়েন করা ছিল পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হতে পারে আন্দোলনে আহতদের। ধানমন্ডি-২৭ এর কাছাকাছি অবস্থানে থাকা ইবনে সিনা ও সিটির মতো হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের চাপ। কারণ, কিছু কিছু হাসপাতাল রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করতে চেয়েছিল, কেউ কেউ অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে, কেউবা আহতদের ফিরিয়ে দিয়েছে।

এই পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন দুই তরুণ চিকিৎসক—ডা. অর্থি জুখরিফ এবং ডা. হৃতিশা আক্তার মিথেন। চারিদিকে যখন ভয়, অনেকে যখন নিজেদের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন নিজেদের দুয়ার খুলে দেন তারা। তাদের বাড়ির নিচের গাড়ির গ্যারেজকে পরিণত করেন এক অস্থায়ী ক্লিনিকে।

তাদের প্রতিবেশীরা ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক্স, ওরস্যালাইন, পানি, শুকনো খাবার—যে যা পেরেছেন তাই দিয়েছিলেন। এই প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় দুইদিনে ১০০ জনেরও বেশি আহত শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. অর্থি ও মিথেন।

তাদের এই সাহসিকতা ও সহযোগিতা না থাকলে আরও অনেকেরই নাম হয়তো থাকতো নিহতদের তালিকায়।

মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা

১৮ জুলাই দুপুর ২টা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ধানমন্ডি-২৭ নম্বর সড়কসহ আশেপাশের গলি ভরে যায় কাঁদানে গ্যাসে। চারিদিক থেকে আসতে থাকে গুলির শব্দ।

ইবনে সিনা হাসপাতালের ওটি সহকারী এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে হেলথ শো উপস্থাপক ডা. অর্থি বলেন, 'আমার জীবনে ওই প্রথম এত ভয়ংকরভাবে নিজের এত কাছাকাছি কোথাও গুলির শব্দ শুনেছিলাম। তার আগে তো শুধু নাটক-সিনেমায় গুলির শব্দ শুনেছি।'

বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখতে পান, আহত শিক্ষার্থীরা নিচে পড়ে আছে। তাদের পোশাক ভিজে গেছে রক্তে। চোখে-মুখে আতঙ্ক।

ডা. অর্থি বলেন, 'একটাই ভাবনা এসেছিল, আমি এভাবে কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসব দেখতে পারি না।'

একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে তিনি নিচে ছুটে যান। ওই বাড়ির আরও কয়েকজন বাসিন্দাও ততক্ষণে নেমে এসেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতালের সাবেক মেডিকেল অফিসার ডা. মিথেনও।

ডা. মিথেন বলেন, 'মানবতা—শুধু এই একটি কারণেই সেদিন সব করেছি। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।'

ভয়ে অনেক বাড়ির গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু বন্ধ হয়নি ডা. অর্থি ও মিথেনের বাড়ির গেট। বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সহযোগিতায় তারা আহতদের সেবা দিতে শুরু করলেন। তারা যতটা পেরেছে ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক্স, গজসহ প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী নিয়ে এসেছে।

এই দুই চিকিৎসকের প্রতিবেশী খুরশীদ জাহান বলেন, 'আহতদের দেখে আমাদের ভেতরে যে অনুভূতিটা কাজ করলো সেটা হচ্ছে, আমাদেরও তো সন্তান আছে। এই আহতরাও কোনো মায়ের সন্তান। এই সন্তানদের জন্য অবশ্যই আমাদের কিছু করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের দেওয়ার মতো তেমন কিছুই ছিল না। ডা. অর্থি ও মিথেন যতক্ষণ চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন, আমি চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দেওয়ার। আমার স্বামী ও মেয়ে আহতদের পানি দিয়েছে, প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী এনে দিয়েছে, পোশাক এনে দিয়েছে।'

প্রথমে তারা বাড়িটির গেটের ভেতরে আহতদের চিকিত্সা দিতে শুরু করেন। পরে আহত আরও মানুষ আসতে থাকায় একপর্যায়ে সেখানে দুটি অস্থায়ী শয্যা স্থাপন করা হয়।

ডা. অর্থি ও মিথেন আহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যান পরিবারের একজন সদস্যের মতো করে। ছররা গুলি বের করেছেন, আঘাতের ক্ষত ড্রেসিং করেছেন, তাদের মানসিক শক্তি দিয়েছেন।

ডা. অর্থি বলেন, 'আঘাতগুলো ছিল ভয়ংকর। তাদের পিঠ, মাথা, বুক শটগানের গুলিতে ছিদ্র হয়ে গেছে। কিছু গুলি পেশীতে আটকে গেছে। অন্তত ১০ জনের গুলি লেগেছিল চোখে।'

এই আহত রোগীদের চিকিৎসায় অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গুরুতর আহত রোগীদের তারা পাঠিয়ে দিয়েছেন বিশ্বস্ত ও আগ্রহী কয়েকটি ক্লিনিকে।
কিন্তু একজন রোগী গভীরভাবে দাগ কেটে গেছেন ডা. জুখরিফের হৃদয়ে। ১০ বছর বয়সী সেই ছেলেটির সারা শরীরে ছিল ছররা গুলির ক্ষত।

ডা. অর্থি বলেন, 'আমি তাকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলি। কিন্তু কয়েকঘণ্টা পরা সে আবার এলো। দেখি তার কপালে ফুলে আছে। গুলি লেগেছে। আবারও তাকে চিকিৎসা দেই। তারপর সে চলে যায়।'

দুঃখজনকভাবে, ওইদিনই সংঘর্ষে ছেলেটি নিহত হয়।

ডা. অর্থি বলেন, 'কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাকে একটা ভিডিও দেখালো। ওই ছেলেটি রাস্তার ওপর পরে আছে। তার নিথর দেহটা পুলিশ নিয়ে গেল। আমি ওর নাম জানতাম না। কিন্তু এক মুহূর্তের তার চিন্তা আমার মাথা থেকে যায়নি। হয়তো তার বাবা-মা জানতেনও না যে তাদের ছেলে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। আমার মনটাই ভেঙে গেছে। ছেলেটার কথা ভুলতেই পারি না। এখনও আমার রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না।'

পরেরদিন ছিল কারফিউ। উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে টহল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার মধ্যেই আহত শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পথচারী এবং সাধারণ মানুষের চিকিত্সা চালিয়ে যান এই দুই চিকিৎসক।

তাদের কাছে চিকিৎসা সামগ্রী তেমন বেশি ছিল না। খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো শেষ হতে থাকে। কিন্তু তাদের ভবন মালিক সমিতির সহযোগিতায় বিভিন্ন ফার্মেসি মালিকদের কাছ থেকে আরও সামগ্রী আনতে সক্ষম হন। শিক্ষার্থীরাও যে যতটা পেরেছে নিয়ে এসেছে। তাদের এই অস্থায়ী ক্লিনিকের কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ালে আহত আরও অনেকে চলে আসেন চিকিৎসা নিতে।

হুমকি-নজরদারি, তবু তারা অটুট

১৯ জুলাই রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা যখন শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন, তখন পুলিশ তাদের ভবনের দিকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং তাদের গেট বন্ধ করতে বাধ্য করে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য ভেতরে নিয়ে আসতে হয়।

একপর্যায়ে সাদা পোশাকে পুলিশ এসে বাড়ির দারোয়ানকে প্রশ্ন করে, তারা কারা, কেন শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা করছে এবং হুমকি দেয় যে বাইরে পা রাখলে তাদের ভয়ংকর পরিণতি হবে।

ডা. মিথেন বলেন, 'শুরুতে তাদের হুমকি গায়ে লাগাইনি। কিন্তু পরে যখন আমাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো তখন খানিকটা নার্ভাস লাগছিল। তারপরও আমরা চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ করিনি। কারণ, আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে মানবতা বাঁচিয়ে রাখা।'

তিনি বলেন, 'আমি মারা গেলেও দেশের জন্য শহীদ হতাম। আমি যা করেছি, দেশের জন্য করেছি।'

বাড়িটির বাসিন্দারা দেখতে পেয়েছেন, ড্রোন সেখানে নজরদারি করছে। তারা এই দুই চিকিৎসককে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেন।

ডা. অর্থি জানান, গণমাধ্যমে থাকা তার বন্ধুরা তাদের সতর্ক করেছিলেন যে ধানমন্ডিতে মাত্র তিনটি বাড়ি নজরদারিতে রয়েছে এবং তার মধ্যে একটি তাদের বাড়ি। সেইসঙ্গে তাদের মোবাইলও ট্র্যাক করা হচ্ছে এবং যেকোনো সময় পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে পারে।

ডা. অর্থি বলেন, 'দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। কারণ, কোনো বিপদে পড়লে রাজনৈতিকভাবে যোগাযোগ করে আমাকে বাঁচাতে পারবে, এমন কেউ আমার পরিবারে নেই। এই ট্রমায় আমি ভুগেছি অনেকদিন।'

তিনি বলেন, 'কিন্তু আমি এই নিরীহ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা করতে পেরে এক অনাবিল শান্তি পেয়েছি। অপরকে সাহায্য করা একটা মানবিক ব্যাপার, রাজনৈতিক নয়। রক্ত কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে না।'

'শিক্ষার্থীরা কৃতজ্ঞ চিত্তে আমাদের যে কথাগুলো বলেছিল, সেগুলোই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া,' যোগ করেন তিনি।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের পর ৬ আগস্ট শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় ডা. অর্থি ও মিথেনের কাছে, তাদের ধন্যবাদ জানাতে। যে সময় কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, তখন এই দুই চিকিৎসক ছিলেন তাদের পাশে।

ডা. মিথেনের প্রত্যাশা, নতুন বাংলাদেশে আর কেউ নিপীড়নের শিকার হবে না।

তিনি বলেন, 'সেই ভাই-বোনেরা জীবন দিয়ে আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন। তাদের রক্ত যেন বৃথা যায় না। আমার চাওয়া, আর যেন কোনো মরদেহ দেখতে না হয়।'

Comments

The Daily Star  | English
Awami League leader Matia Chowdhury (1942-2024)

Matia Chowdhury no more

She breathed her last at 12:37pm at Evercare Hospital where she was undergoing treatment

3h ago