‘স্ট্রেচারে প্রাণহীন পড়ে ছিল রাব্বি, কপালে গুলির চিহ্ন’
গত ৫ আগস্ট সকালে ঢাকায় ছাত্র-জনতা যখন গণভবন ঘেরাওয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দুই তরুণী রাস্তায় নামেন তাদের ছোট ভাইকে খুঁজতে। ১৭ বছর বয়সী ইসমাইল হোসেন রাব্বি তার আগের দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হয়েছিল। তারপর থেকেই রাব্বির কোনো খোঁজ পাচ্ছিল না পরিবার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর দুই বোনকে বেশ কিছু ছবি দেখান একজন আনসার সদস্য। সেখানে একটা ছবি ছিল রাব্বির। স্ট্রেচারে প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে। কপালে একটি গুলির চিহ্ন।
'আমার ভাইয়ের সেই ছবি দেখার পর আমার পুরো দুনিয়া উল্টে যায়,' বলেন রাব্বির বোন মিম আক্তার।
ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে যেতে মর্গ কর্তৃপক্ষকে বার বার অনুরোধ করেন রাব্বির দুই বোন। কিন্তু রাব্বির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের প্রমাণ দেখানোর কথা জানায় মর্গ কর্তৃপক্ষ।
সেটা কীভাবে করা সম্ভব, জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ জানায় জিগাতলা পুলিশ বক্স থেকে কোনো কর্মকর্তাকে নিয়ে আসতে হবে। কারণ সেখান থেকেই রাব্বির মরদেহ ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।
মিম বলেন, 'আমাদের মামাদের জিগাতলা পুলিশ বক্সে পাঠানো হলে পুলিশ তাদের দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়।'
মর্গের লোকজনকে আমরা অনেকবার অনুরোধ করি যে পুলিশ তো আসবে না, কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই কানে নেয়নি, বলেন মিম।
'আমরা ভয় পাচ্ছিলাম রাব্বির মরদেহ না আবার উধাও করে দেয়। এর আগে শুনেছি অনেক শিক্ষার্থীর বেলায় এমন হয়েছে।'
বিকেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অন্যদের লাশ সেখান থেকে বুঝে নিতে এলে দুই বোন তাদের সাহায্য চান। তাদের সহায়তায় ভাইয়ের লাশ বুঝে পান দুই বোন। এরপর অনেক কাকুতি-মিনতির পর ৭ নং ওয়ার্ড থেকে রাব্বির মৃত্যুসনদ পান তারা।
সেই সনদে শুধু রাব্বির নাম ও মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করা থাকলেও মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বুলেট যে তার কপাল দিয়ে ঢুকে মগজ ভেদ করে বের হয়ে গেছে সেটা তো সবাই দেখেছে বলেন মিম।
কিন্তু এনিয়ে কোনো কথা বলার সাহস তখন ছিল না মিমদের। পুলিশ কখন তাদের আটকে দেয় এই ভয় মাথায় নিয়ে তারা দ্রুত ভাইয়ের লাশ নিয়ে বেরিয়ে যান।
'সারাজীবন ভেবেছি, আমার ভাই একদিন আমাদের লাশ কাঁধে নেবে। ওর লাশ যে আমাদের কাঁধে নিতে হবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি,' বলেন মিম।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ভাইয়ের লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও তাদের কাছে আছে বলেও জানান তিনি।
মরদেহের ছবি, সেটি উদ্ধারের জন্য দুই বোনের সংগ্রামের ভিডিও এবং মৃত্যুসনদের মতো প্রমাণাদি থাকার পরও রাব্বিকে এখনো শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
শহীদের তালিকায় রাব্বির নাম নেই। তার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি কোথায় চাইবেন, সেটাও জানেন না দুই বোন— মিম ও মিতু।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অভাবে এ নিয়ে আদালতে মামলা করতেও পারছেন না তারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি দেয়নি।
মাদারীপুরে রাব্বির দাফনের পর আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কারীকে সাথে নিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন দুই বোন। রাব্বির মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে একটি মৃত্যু সনদ দেওয়ার দাবি জানান তারা। কিন্তু স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে সেই সনদ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় তাদের।
মিতু বলেন, 'পাঁচখোলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সনদ নিয়ে আমরা আবার ঢামেকে যাই। এবার পরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে তার কথা হয়েছে, তিনি জানিয়েছেন সময়মতো তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।'
'এক মাসের বেশি হয়ে গেছে, সেই সময় এখনো আসেনি। আমার ভাই এখনো শহীদ হিসেবে কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি,' বলেন মিম।
এরমধ্যে রাব্বির পরিবারের পক্ষ থেকে সমন্বয়কদের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করা হয়। শহীদের নাম তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়ার জন্য কোথায় যেতে হবে বা কী করতে হবে, সেটি জানার জন্য। কিন্তু তারা প্রতিবার একজন আরেকজনের নাম বলেছেন। কেউই এই ব্যাপারে পরিষ্কার কিছু জানায়নি।
মিম বলেন, 'এটা কি আমাদের দায়িত্ব? সরকারের যদি যাচাই করার প্রয়োজন হয়, তারা আমাদের নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিক। আমাদের মতো অনেক শহীদ পরিবারেরই এই অবস্থা। কোথায় যেতে হবে তাও জানে না কেউ। অনেক শহীদের লাশ গুম বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে কীভাবে তালিকাভুক্ত করা হবে? এরকম যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তাদের কি কোনো মূল্য নেই? তারা কি কোনো স্বীকৃতি পাবে না?'
মিম জানান, রাব্বি শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। রাব্বির বাবা মো. মিরাজ তালুকদার পেশায় ভ্যানচালক। তার মা আসমা বেগম বাচ্চাদের আরবি পড়ান। মিম নিজেও টিউশনি করে নিজের খরচ যোগান। সেখান থেকে রাব্বিকেও মেসে থাকার খরচ দিতেন তিনি।
'যখন জানতে পারলাম রাব্বি শরীয়তপুরে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, তখন আমরা তাকে সায়েদাবাদ নিয়ে আসি। আমরা এখানে থাকি। ১৯ জুলাই শাহবাগে রাবার বুলেট খেয়েছিল রাব্বি,' বলেন মিম।
মিম জানান, জুলাইয়ের শেষের দিকে যখন অনেক শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছিল, ছাত্র-জনতার হতাহতের ছবি-ভিডিওতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে যাচ্ছিল, তখন বারবার রাব্বিকে বাসায় থাকতে বলি আমরা। কিন্তু রাব্বি তা শোনেনি।
'৪ আগস্ট যখন আমরা টিউশনি করাচ্ছিলাম, তখন কীভাবে যেন ও দরজা খুলে বের হয়ে যায়। আমরা টের পাইনি। এরপর আর ফোনেও যোগাযোগ করতে পারছিলাম না রাব্বির সাথে,' বলেন মিম।
মিম জানান, ৩ আগস্ট শেষবার যখন রাব্বির সাথে কথা হয় তখন সে বলেছিল, 'তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করছ? মুগ্ধ ভাই, আবু সাঈদ ভাই ওরা তো শহীদ হয়ে গেছে। মরে গেলে আমিও শহীদ হব। রাব্বি শহীদ হয়েছে, কিন্তু সেই স্বীকৃতি এখনো পায়নি।'
গত ২৫ সেপ্টেম্বর আরেক শহীদ মিরাজ হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন মিম ও মিতু।
উপদেষ্টা তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, সকল শহীদ ও আহত ব্যক্তিকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
Comments