পাহাড়ে শান্তি চাই, রক্তপাত ও হাহাকার নয়

দুই পার্বত্য জেলায় সহিংসতার পর ধর্মঘটের প্রথম দিন রাঙ্গামাটি শহরে ফাঁকা রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি। ছবি: সংগৃহীত

জনগণের একটাই চাওয়া—পাহাড়ে চলমান রক্তপাত ও হাহাকার বন্ধ হোক। কিন্তু গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাহাড়ে আবারও রক্তপাত শুরু হলো।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এই রক্তপাত বন্ধ হয়নি। শান্তির বদলে অশান্তি, নৈরাজ্য ও হানাহানি অতিষ্ঠ করে তুলছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন। যার একটি মর্মান্তিক পরিণতি হলো সম্প্রতি রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট।

১৪ মামলার আসামি মোটরসাইকেল চুরি করে তড়িঘড়ি করে পালানোর সময়  বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কয়েকজনের হাতে ধরা পড়েন এবং তারা তাকে মারধর করে বাঙালিদের হাতে তুলে দেয়। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু মারধর নয়, বরং বিদ্যুতের খুঁটির ধাক্কায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে বিবৃত দিয়েছেন খাগড়াছড়ির রিজিওন কমান্ডার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।

কিন্তু প্রতিবাদ মিছিলের নামে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙ্গামাটিতে যে হামলা হলো, নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে পেটানো হল, ঘরবাড়ি দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হলো—এর দায়ভার কে নেবে?

সমতলে গণপিটুনিতে মানুষ মরলে তাদের এই চেতনাবোধ কোথায় হারিয়ে যায়? আদিবাসী নারী-শিশুকে যখন ধর্ষণ করা হয়, তখন এদের একজনও প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামেন না।

পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত হলেও নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন সবাই। একদিকে কারফিউ, আরেকদিকে আতঙ্কিত হয়ে হামলায় আহত অনেকেই চিকিৎসাহীন অবস্থায় রয়েছেন। রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় হওয়ায় এবং হাসপাতালে আগত রোগী ও স্বজনরা হামলার শিকার হওয়ায় উন্নত চিকিৎসা নিতে পারছেন না।

ঘটনার সময় বেশ কয়েকজন বিভিন্ন জায়গায় আটকে ছিলেন, তাদের সবাইকেও নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত উদ্ধার কার্যক্রম চলমান আছে।

পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পথে তখন আরেকটা স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসীদের নামে দেশব্যাপী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুমল্যান্ড নামে আলাদা রাষ্ট্র গঠনসহ জুমল্যান্ডের লোগো, মানচিত্র ও টাকার নোট ডিজাইন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে সমতলের বাঙালিদের বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র করছে এবং সাম্প্রদায়িক বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এটা দীর্ঘদিনের প্রোপাগান্ডা। নতুন নতুন ঘটনার সময় এগুলো নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই শক্তিশালী প্রোপাগান্ডাগুলোকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে এক স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক ঘটনার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে বসবাসকারী আদিবাসীরা ঝুঁকি ও আতঙ্কে রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে 'ধরে ধরে মারা'র, 'জবাই করা'র, 'মেয়েদের ধর্ষণ করা'র হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

অবাক করার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিছু পেজ ও গ্রুপ থেকেও অপপ্রচার করে এই সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে—যা বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের জন্য অশনিসংকেত।

এই যে পাহাড়ে এত বড় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেলো, মিডিয়া এখানে নিশ্চুপ কেন? প্রকৃত ঘটনা কেন আড়ালে রাখা হচ্ছে? মিডিয়া কারা নিয়ন্ত্রণ করে? এসব প্রশ্নের জবাব চায় পাহাড়ের মানুষ।

মনে রাখবেন, পাহাড়ের মানুষ অধিকার চায়, স্বাধীনতা নয়। আমরা দেশের মানুষের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে থাকতে চাই, বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে নয়। আমরা পাহাড়ে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়। আমরা এক দেশে এক নীতির দাবি করি, দুই নীতি চাই না। পাহাড়ের মানুষ অবৈধ সেটেলারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, বাঙালিদের বিরুদ্ধে না।

জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা এবং এটাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দীর্ঘদিনেও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। যার ফলে পাহাড়ে এখনও বিচারবহির্ভূত হত্যা, সন্ত্রাস, দাঙ্গা, খুন, উচ্ছেদ, নিরাপত্তাহীনতা, ভূমি বেদখল, অপহরণসহ নানা সদস্যা লেগেই আছে।

পাহাড়ের এই সমস্যা সমাধানে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং স্থানীয়দের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ও কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনের বিধিমালা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করা হয়নি। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোনো সফলতা আসেনি।

এক দেশে দুই নীতি চলমান থাকলে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সমতলের মতো পাহাড়েও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়িদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার, ঘৃণা ও সহিংসতা না ছড়ালে; পাহাড়ের মানুষের প্রতি সৎ ও সংবেদনশীল হলে আস্থাহীনতার সংকট কেটে যাবে। মানুষের হাহাকার ও জীবনের অনিশ্চয়তা দূর করতে সবাইকে একতাবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কারোই কাম্য নয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ হত্যা-অগ্নিসংযোগ-লুটপাট এবং মসজিদ-মন্দিরে হামলায় জড়িদের চিহ্নিত করে দ্রুত এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাই।

দীপেন চাকমা; প্রতিষ্ঠাতা, সেবামূলক সংগঠন 'উন্মেষ'

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago