এখনো ধরা যায়নি জেল পালানো ৯২৮ দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে
গণঅভ্যুত্থানের আগে ও পরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮৮ জনসহ অন্তত দুই হাজার ২৪১ জন বন্দি কারাগার থেকে পালিয়েছেন। এই সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের একটি বড় অংশ এখনো পলাতক আছেন।
এখন পর্যন্ত চার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ মোট এক হাজার ৩১৩ জন বন্দি আত্মসমর্পণ করেছেন অথবা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকি ৯২৮ জন আসামি কোথায় আছেন সে সম্পর্কে পুলিশ কিছুই জানে না বলে জানিয়েছেন কারা অধিদপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তারা।
দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে পাঁচটিতে কারাগার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮৮ বন্দির বেশিরভাগই গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, কারাগার থেকে পালিয়ে আসা আসামিরা যেন দেশ ছাড়তে না পারেন সেটি নিশ্চিত করতে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের তালিকা সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ মোতাহার হুসাইন বলেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করা গণঅভ্যুত্থানের সময় যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে অধিকাংশ বন্দি পালিয়েছে।
বিটিভির বুলেটিনসহ আরও বিভিন্ন উপায়ে আসামিরা সরকার পতনের কথা জানতে পেরেছিল বলেও জানান তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারকে মোতাহার বলেন, 'বন্দিরা বলছে দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে। তাদের দাবি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর তো বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তাহলে এখন কেন হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, দুর্বল কাঠামো এবং কারা কর্মকর্তারা বিদ্রোহ দেখতে ব্যর্থ হওয়ায় কারাগার ভাঙার ঘটনাগুলো ঘটেছে।
গত ১১ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করা কারা মহাপরিদর্শক আরও বলেন, 'আমরা এখান থেকে শিক্ষা নিয়েছি এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। পলাতক আসামিদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'
কারা কর্মকর্তারা জানান, শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে গত ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রধান ফটকে আগুন ধরে গেলে সেখান থেকে নয়জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দি পালিয়ে যায়। রোববার পর্যন্ত এদের মধ্যে তিন জঙ্গিসহ ৬২২ জন আত্মসমর্পণ করেছেন অথবা গ্রেপ্তার হয়েছেন।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বন্দিদের বিক্ষোভ এবং বাইরে থেকে তাদের সহযোগী ও স্বজনদের হামলার ফলশ্রুতিতে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার এবং সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও শেরপুর কারাগার থেকে এক হাজার ৪১৫ জন বন্দি পালিয়ে যান।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ২০৩ বন্দির মধ্যে অন্তত ২০০ জনের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন জেলার লুৎফর রহমান।
সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও শেরপুর কারাগার থেকে পালিয়ে আসা আসামিদের মধ্যে ৬৮৯ জন আত্মসমর্পণ করেছেন অথবা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকি ৫২৩ জন কোথায় আছেন তা জানে না কর্তৃপক্ষ।
সাতক্ষীরা কারাগারের জেলার হাসনা জাহান বীথি বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ ৭৩ জন কয়েদির কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
শেরপুর কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির খান জানান, কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৫১৮ জনের মধ্যে অন্তত ১০৬ জন পরে ময়মনসিংহ ও জামালপুর কারাগারে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণকারী ৯১ জন বন্দি পরে জামিন পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
সারা দেশ থেকে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮৮ আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি এবং যৌথ অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের মূল লক্ষ্য অবৈধ ও চুরি হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা। তবে আমরা পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের খুঁজে বের করাকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছি।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তাওহিদুল হক বলেন, 'এখন পর্যন্ত ছোটখাটো অপরাধে অভিযুক্ত আসামিরাই শুধু আত্মসমর্পণ করেছেন। বেশিরভাগ বড় অপরাধে দণ্ডিত, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা এখনো পলাতক।'
'এই আসামিরা আবার সংগঠিত হতে পারে বা বিভিন্ন অপরাধ চক্রের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করতে পারে। এটা সার্বিকভাবে সমাজের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। যত দ্রুত সম্ভব এদের গ্রেপ্তার করতে হবে,' বলেন তিনি।
(দ্য ডেইলি স্টারের গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া সংবাদদাতা এই প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন।)
Comments