স্বৈরাচারী শাসনের সুযোগ না রেখে সংবিধান সংশোধন করতে হবে: ড. কামাল
গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস সভাপতি এবং বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সংবিধান নতুন করে পর্যালোচনা করার গুরুদায়িত্ব এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান-চিন্তা ও দূরদর্শিতা আমাদের পথ দেখাতে পারে।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে 'আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তা: জুলাই অভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক সংস্কার' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
আবুল মনসুর আহমদের জন্মদিন উপলক্ষে তার সংবিধান চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে এ আলোচনা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ।
অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. কামাল হোসেন। তবে অসুস্থতার কারণে কথা বলেননি তিনি। তার পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান।
ড. কামালের বক্তব্যে বলা হয়, 'আবুল মনসুর আহমদ বিবেচনা করেছেন যে সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন ও পরিমার্জনের দাবি রাখে। আজ আমরা সংবিধান সংশোধন নিয়ে যা আলোচনা করছি, তা আবুল মনসুর আহমদের সেই চিন্তারই প্রতিফলন।'
এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের স্থপতি অ্যালবি স্যাকসকে উদ্ধৃত করে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, 'অ্যালবি স্যাকস বলেছিলেন যে, অধিকার আমাদের কেউ দেয় না। আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অধিকার অর্জন করি। কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ হওয়ার আগে এই অধিকার আমাদের প্রাণে রক্ষিত থাকে। ঠিক একইভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার নিয়ে আমরা সংবিধান রচনা করেছিলাম। যেখানে বৈষম্য নিরসন ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলোর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এবারের আন্দোলন আবারো বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। একইসঙ্গে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার কোনো সুযোগ যাতে না থাকে, সে আলোকেও সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করতে হবে বলে আমি মনে করি।'
লিখিত বক্তব্যে কামাল হোসেন আরও বলেন, 'গত কয়েক মাসে আমরা যে ভয়াবহ ও কষ্টদায়ক ঘটনাবলী দেখেছি তা আমাদের নাড়া দিয়েছে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীসহ অজস্র নাগরিকের ওপর ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও দমনপীড়ন এবং আইনের শাসনের প্রতি যে অবজ্ঞা আমরা দেখেছি তা অবশ্যই আমাদের সংবিধানে স্থান পাওয়া উচিত। আমাদের দায়িত্ব হলো সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন করা এবং চর্চা করা যেন ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি কখনো আর না ঘটে।'
কামাল হোসেনের ভাষ্য, 'আমরা যেন এই শিক্ষাগুলোকে আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোতে গেঁথে দিতে পারি, যাতে কোনো নাগরিকের সঙ্গে অন্যায়-অবিচার আর কোনো দিন না ঘটে।'
প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম এই প্রণেতার পর্যবেক্ষণ হলো, 'আবুল মনসুর আহমদ সর্বদা গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত গণতন্ত্রই একটি জাতির সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। সাম্প্রতিক বিপ্লবের মূলে ছিল সেই গণতন্ত্রেরই অভাব। বাংলাদেশের বঞ্চিত তরুণ-তরুণীরাই এই অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এই কথাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ও ঐক্যের শক্তি অপরিসীম।'
কামাল হোসেন বলেন, 'সাম্প্রতিক আন্দোলন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে জনগণের ক্ষমতায়নেই একটি জাতির প্রকৃত শক্তি নিহিত। আমাদের সংবিধানে জনগনের শক্তিকেই কার্যকরী করতে হবে। আবুল মনসুর আহমদ ব্যক্তির অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন মৌলিক অধিকারগুলো কেবল আইনি বিধান নয়; বরং প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার।'
সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার তাগিদ দেন কামাল হোসেন। বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি কীভাবে মৌলিক অধিকারের ক্ষুণ্নতা একটি জাতিকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এজন্যই আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং এই অধিকারগুলো রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে।'
কামাল হোসেন আরও বলেন, 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করতেন আবুল মনসুর আহমদ। বিগত ১৬ বছরের সরকারের শাসনামলে এবং তারও আগে থেকে আমরা দেখছি গণমাধ্যম কীভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে তার স্বাধীনতা হারায়।'
তাই নতুন সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার তাগিদও দেন গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা। একইসঙ্গে ফৌজদারি আইনের মানহানি কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহীতার মতো যে অপরাধগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সকলের মতপ্রকাশের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে সেগুলোকে বাতিল করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।
কামাল হোসেন বলেন, 'আমাদের নতুন সংবিধানে এমন কোনো অপরাধের উল্লেখ থাকবে না যাতে মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আবুল মনসুর আহমদ ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তার মতে, "ধর্মের প্রতি আনুগত্য সভ্য মানুষের একটা বড় সম্পদ। রাষ্ট্রের জন্যও মানুষ প্রাণ দিয়াছে সত্য। কিন্তু সেটা দিয়াছে রাষ্ট্রের আদেশে বাধ্য হইয়া।"'
নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ওপর জোর দেন কামাল হোসেন। বলেন, 'একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষপাতী ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টকে অপ্রয়োজনীয় এবং ব্যয়বহুল বলে বিবেচনা করতেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এখন এমন একটি সময় এসেছে যখন আমরা দ্বিতীয় কক্ষের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে পারি। এটি আমাদের সরকার পরিচালনায় নাগরিকদের সরাসরি অবদান রাখার সুযোগের পথ তৈরি করবে।'
এর পাশাপাশি আবুল মনসুর আহমদ বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখার উপর জোর দিয়েছিলেন মন্তব্য করে কামাল হোসেন বলেন, 'তিনি (আবুল মনসুর আহমদ) বিশ্বাস করতেন, একটি স্বাধীন বিচার বিভাগই নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে। আমরা সারাজীবন বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করে এসেছি। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও অনেক রায় দিয়েছে যেগুলো কার্যকরী করা যায় এবং যার অংশবিশেষ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যেমন- বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণ, সুপ্রিম ডিভিশন কাউন্সিল গঠন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।'
Comments