সংস্কার হবে এমন, জনগণ যেন বুঝতে পারে রাষ্ট্রের মালিক তারাই: আলী ইমাম মজুমদার
বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের যেভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে, সেগুলোর সংস্কার করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এক মাস সময়ের মধ্যে আমলাতন্ত্র ও পুলিশকে সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য।
চলমান মব-জাস্টিস ও সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী? রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেভাবে গণহারে মামলা হচ্ছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এগুলোসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
দ্য ডেইলি স্টার: আপনারা সংস্কারের কথা বলছেন। কোন কোন জায়গায় কী কী সংস্কার আনতে চান?
আলী ইমাম মজুমদার: জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ বিষয়ে কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেমন: ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে হয়, এ সংস্কৃতিটা আমার ভুলতে বসেছিলাম। এটা আমাদের সংস্কার কাজের অন্যতম বিষয়। এর বাইরে আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন নিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা বা ভালো পোস্টিং না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে যারা (বিগত সরকারের সঙ্গে) তাল মিলিয়ে চলেছে, সেটা একটা বিষয়। কিন্তু তাদের একটি অংশ চরম দলবাজী করেছে, অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা (রাজনৈতিক) দলের নেতাকর্মীদের মতো আচরণ করেছে। পত্র-পত্রিকায় দলদাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে বলে আমরা দেখেছি।
অন্যদিকে পুলিশের প্রতি মানুষের রোষ আমরা দেখেছি। তবে পুলিশ সদস্যকে মেরে টাঙিয়ে রাখার ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটি বেদনাদায়ক ব্যাপার। হয়তো মব সবক্ষেত্রে সঠিক ছিল না। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনটা হয়েছে। যেমন: ফরাসি বিপ্লব।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড় করানোর যে প্রচেষ্টা, সেটাই সংস্কার। মানুষ কী চায়? সেবা চায়। কীভাবে চায়? সহজে পেতে চায়। এই কাজটাই আমরা করতে চাই, যেন জনগণ বুঝতে পারে রাষ্ট্রের মালিক তারাই। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে যাতে স্বেচ্ছাচারিতা চেপে না বসে, তা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করার কাজটা আমরা করে যেতে চাই।
ডেইলি স্টার: এর জন্য কত সময় লাগতে পারে?
আলী ইমাম মজুমদার: প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জনগণ যতদিন এই সরকারকে দেখতে চাইবে, ততদিন দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রেখেছেন।
ডেইলি স্টার: আমলাতন্ত্রের অনেকের মধ্যে ভয় কাজ করছে। ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না।
আলী ইমাম মজুমদার: এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। আমার মনে হয় অবস্থা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ভীতি বা শঙ্কার ক্ষেত্রে বলব, যারা ভালো কাজ করেছেন, তাদের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যারা দলীয় ক্যাডারের মতো কাজ করেছে, তাদের জন্য কিছুটা এরকম থাকবে। যারা দলদাসের মতো আচরণ করেছে, তারা খেসারত দেবে। কিছুক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আরও দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আশা করি দ্রুতই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
একটি সরকারের পুরো সিস্টেমকে পৃথিবীর কোনো দেশেই পরিবর্তন করা হয় না। যেমন: স্পয়েল সিস্টেম আমেরিকায় আছে, সেটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের পদগুলোর জন্য। অর্থাৎ আমেরিকাতে সরকার বদলের পর সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা বদল হয় না।
ডেইলি স্টার: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সরকার আপনারা। আমলাতন্ত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের...
আলী ইমাম মজুমদার: বৈষম্য না রাখতে পারলে আমি খুবই খুশি হবো। কিন্তু এটাতে কাজ করতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। কতটা সম্ভব এখনই বলতে পারছি না।
আবার এটাও ঠিক, সব চাকরির ক্যারিয়ার অপরচুনিটি সমান না। যেমন: যারা বিসিএস ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন, তারা বিদেশে পোস্টিংয়ের সময় দুই সন্তানের পড়াশোনার জন্য পৃথক খরচ পান। এর বাইরেও অনেক সুযোগ-সুবিধা পান। যেটা দেশে চাকরি করা কর্মচারীরা পান না।
বিসিএসে দুই ভাগে জেনারালিস্ট ক্যাডার ও বিশেষায়িত ক্যাডার নিয়োগ হয়। বিশেষায়িত ক্যাডারদের অনেক ভাগ। বিষয়টি জটিল, যা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এজন্য পদোন্নতি জটিলতা বেশি।
ডেইলি স্টার: কিন্তু প্রশাসন, পুলিশসহ কয়েকটি ক্যাডারে শূন্যপদ না থাকলেও ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি হচ্ছে...
আলী ইমাম মজুমদার: আমি মনে করি অন্যান্য ক্যাডারের সমপর্যায়ে থাকা অফিসারদেরও পদোন্নতি পাওয়ার অধিকার আছে। এ ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি আদেশও আছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে (এসএসবি) কাজ হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতও চাওয়া হয়েছে।
আমি এতটুকু বলতে পারি, সরকার নির্মোহভাবে কাজ করছে। আমি এখন কোনো চাকরি করছি না, কোনো ক্যাডারেও বিলং করছি না। আমি সবার দিকটাই দেখছি। যদি তাদের পদোন্নতির পক্ষে মত আসে, তাহলে অবশ্যই অন্যরাও (আদার্স ক্যাডার) পদোন্নতি পাবে।
আইন মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নেই। সেখানে জুডিশিয়ারিসহ লেজিসলেটিভ বিভাগের অফিসাররা কাজ করেন। আশা করি সেখানে এই বিষয়টা নির্মোহভাবে পরামর্শ আসবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার।
ডেইলি স্টার: আদার্স ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব পুলে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করতে চান।
আলী ইমাম মজুমদার: আমার মনে হয় উপসচিব পুলে যে হার আছে (৭৫/২৫), এখানে সংস্কার আসতে পারে। সেটা আলোচনা সাপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
ডেইলি স্টার: সরকারের দায়িত্বশীলদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে কি?
আলী ইমাম মজুমদার: উপদেষ্টাদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার চিন্তা আছে। অন্য কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে কি না, এখনই তা বলতে পারছি না। ১৬ লাখ কর্মচারীর সম্পদের হিসাব ব্যবস্থাপনা কঠিন কাজ। সবকিছু একসঙ্গে করা যাবে না। তবে কারো বিরুদ্ধে পত্রিকায় বা অন্যভাবে অভিযোগ জমা পড়লে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
সাবেক সিনিয়র সচিব, আইজিপি ও এনবিআর সদস্যের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে সরকারের সহানুভূতি থাকবে না। দুর্নীতিবাজ কোনো সরকারের জন্যই উপকারী নন।
ডেইলি স্টার: মব জাস্টিস বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
আলী ইমাম মজুমদার: এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এসব বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে।
ডেইলি স্টার: আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাদের সাবেক বসদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করতে পারবে কি?
আলী ইমাম মজুমদার: পুলিশ সব তদন্ত খারাপ করে না। যেমন: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় র্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পুলিশ ভালো তদন্ত করেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিকল্প উদ্যোগ নেওয়া যাবে কি না, সেটা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভালো বলতে পারবেন। তা ছাড়া সব অপরাধের তদন্ত শুধু পুলিশ করবে না। দুর্নীতির অভিযোগগুলো দুদক তদন্ত করবে।
ডেইলি স্টার: গণহারে মামলা হচ্ছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে...
আলী ইমাম মজুমদার: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া হত্যা মামলা হওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আন্দোলনটাকে ওই পর্যায়ে নেওয়ার জন্য কিছু সাংবাদিকের করা প্রশ্ন কি দায়ী নয়? এই জাতীয় লোকদের বিষয়ে মানুষের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা থাকাটা অস্বাভাবিক না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি সেল গঠন করেছে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন। মামলাগুলো যাচাই-বাছাই করে যেসব মামলায় যাদের সম্পৃক্ত হওয়া অযৌক্তিক প্রমাণিত হবে, সেগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
ডেইলি স্টার: সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। ২০০১ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে মাইনরটি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের।
আলী ইমাম মজুমদার: কয়েকদিন দেশে কোনো সরকার ছিল না, তখন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা প্রথমেই গুরুত্ব দিয়ে নৈরাজ্য পরিহারে কঠোর বার্তা দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমার জানামতে প্রতিটা ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে, অনেক জায়গায় গ্রেপ্তারও হয়েছে।
শুধু সংখ্যালঘু নয়, সমাজের দুর্বল অংশের ওপর নির্যাতন হয়। তাই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, এই দেশের নাগরিক বা মানুষ হিসেবে বিচার চাওয়া সবার অধিকার। আমরা এই জায়গায় সুবিচার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে চাই, যাতে কেউ তার ধর্মের পরিচয়ে নয়, নাগরিক হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জায়গায় নিজের পরিচয় খুঁজে পায়।
Comments