আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপতি মানিককে নিয়ে যা ঘটেছিল

বিজিবির হাতে আটককালে এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

সিলেট সীমান্তে গত শুক্রবার (২৩ আগস্ট) আটক হওয়ার পর শনিবার বিকেলে সিলেট আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আদালত প্রাঙ্গণে ৭৫ বছর বয়সী এই বিচারপতির ওপর ডিম-জুতা নিক্ষেপ এবং মারধরের ভিডিও প্রকাশ হলে আদালত চত্বরে আসামির নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, কেন আদালত প্রাঙ্গণে একজন আসামির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? এই ব্যর্থতার দায়ভার নিয়েও রয়েছে সমালোচনা।

গত ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক বিচারপতি মানিককে পরদিন সকালে কানাইঘাট থানায় হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ তাকে কোড অব ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর এর ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখায়।

বিচারপতি মানিককে বিকেলেই আদালতে হাজির করা হবে, এ বিষয়টি আগে থেকেই জানাজানি হওয়ায় ছুটির দিনেও আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় জমান অসংখ্য মানুষ। এ সময় আদালত চত্বরে সিলেট জেলা পুলিশ ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পর্যাপ্ত সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

বিকেল ৪টার দিকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে বিচারপতি মানিককে আদালত প্রাঙ্গণে হাজির করা হয়। এ সময় উপস্থিত মানুষ উত্তেজিত হয়ে প্রিজনভ্যানের দরজা ও আদালত ভবনে প্রবেশের রাস্তা ঘিরে রাখেন। তারা স্লোগান দিতে থাকেন—'কে বলেরে রাজাকার, সাঈদী মোদের অহংকার'।

বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট পরা বিচারপতি মানিককে প্রিজন ভ্যান থেকে নামানো মাত্রই উত্তেজিত ব্যক্তিরা পুলিশের বাধা টপকে তার উপর হামলার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় তার ওপর জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করা হয়। 

প্রিজন ভ্যান থেকে আদালত ভবনের গেইট পর্যন্ত নিয়ে আসার মধ্যেই বেশ কয়েকজন তাকে আঘাত করেন। তার মাথার হেলমেটও খুলে পড়ে যায়। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা এ অবস্থাতেই তাকে দ্রুত আদালত ভবনে ঢুকিয়ে গেইট লাগিয়ে দেন।

এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত একাধিক সংবাদকর্মী এবং পুলিশ জানিয়েছেন যে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা বেশিরভাগই আদালতের আইনজীবী এবং আদালতের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারী যারা বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত।

হামলার শিকার হওয়ার পর বিচারপতি মানিককে আদালত ভবনের লিফট ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। বরং সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে চার তলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করানো হয়।

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচারপতি মানিক তার শারিরীক অসুস্থতা ও আহত হওয়ার বিষয় জানালে আদালত তাকে চিকিৎসা এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আদেশ দেন।

আদালত প্রাঙ্গণে হামলার বিষয়ে পুলিশি নিরাপত্তার ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট জেলা পুলিশের আদালত পরিদর্শক জামশেদ আলম বলেন, 'সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিলেট জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা ছাড়াও রিজার্ভ পুলিশ ছিল। তার ওপর হামলার সময় তাকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।'

বন্ধের দিনে আদালত প্রাঙ্গণে এত বিক্ষুব্ধ লোকসমাগম হলেও তাদেরকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখা যায়নি কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের বেশিরভাগই আদালতের আইনজীবী কিংবা বিভিন্ন পদে কর্মরত কর্মচারী। এর মধ্যে বহিরাগত কিছু ব্যক্তিও ছিল যাদের পরিচয় আমরা নিশ্চিত নই। যেহেতু আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বেশি ছিল, তাই তাদেরকে আদালত এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়ার সুযোগ ছিল না।'

তিনি বলেন, 'আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বল প্রয়োগ করতে পারতাম, কিন্তু তা করা যায়নি কারণ সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ বাহিনী এমনিতেই নানা কারণে সমালোচিত। এ অবস্থায় বল প্রয়োগ করলে তা নিয়েও সমালোচনার সৃষ্টি হতো। তবুও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাকে নিরাপদে আদালতে উপস্থিত করতে এবং আদালত থেকে নিয়ে বের হতে।'

লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি জানান যে সেসময় আদালতে লোডশেডিং চলছিল বলে লিফট ব্যবহার করা যায়নি। 

আদালত থেকে বের হওয়ার পর বিচারপতি মানিককে সিলেট শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরের সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। কারাফটকে তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষার পর তার গুরুতর আঘাত বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

জেল পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. সগীর মিয়া বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ আগে গুরুতর আহত বন্দিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, তারপর কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা তা করেনি। তাকে যখন কারাগারে নিয়ে আসা হয়, তখন তিনি গুরুতর আহত, তার ইনজুরিও মারাত্মক ছিল। অবস্থা বিবেচনায় তাকে আমরা দ্রুত হাসপাতালে পাঠাই।'

হাসপাতালে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান, ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শিশির চক্রবর্তী বলেন, 'তার মাথার পিছনে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ভোতা আঘাত ছিল, তবে সেগুলো বেশি গুরুতর ছিল না। তার স্কোটাল ইনজুরি (অণ্ডকোষে আঘাত) ছিল গুরুতর তাই রাতেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।'

তিনি জানান, 'বিচারপতি মানিকের হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল। তবে মারধরের আঘাত, বিশেষ করে স্কোটাল ইনজুরিটি একদম নতুন ছিল। এই আঘাত তিনি কীভাবে পেয়েছেন তা হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে।'

সরকার পতনের পর হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় বিগত সরকার সংশ্লিষ্ট অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা, তিন জন সাবেক মন্ত্রী, দুজন প্রতিমন্ত্রী, সংসদের ডেপুটি স্পিকার, একজন উপমন্ত্রী এবং তিন জন এমপি। এছাড়াও সাংবাদিকদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তাদের প্রায় প্রত্যেককে আদালতে হাজির করার সময় হামলার চেষ্টা করা হয়েছে, ডিম-জুতা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কাউকে কাউকে মারধরও করা হয়। সর্বশেষ বিচারপতি মানিকের ওপর হামলার পর আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়।

সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বলেন, 'পুলিশি নিরাপত্তাতে একজন বন্দী যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, তার সাথে সিলেট আদালত প্রাঙ্গণে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তা আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এ ধরনের ঘটনা সাবেকি প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির ধারাবাহিকতা বলে মনে হচ্ছে এবং এ ধরনের আচরণ কোনো সুখকর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা জাগায় না।'

আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের ওপর হামলা ও নিরাপত্তা বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ড. আলী রীয়াজ।

তিনি লিখেছেন, 'আদালত প্রাঙ্গণে এবং আদালতে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে আমি উদ্বেগজনক বলে মনে করি। যে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার প্রাপ্তি যেমন অধিকার তেমনি তার নিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব। … বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে এক ভয়াবহ এক-ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী শাসনের মধ্য দিয়ে গেছে যখন মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এখনকার কোনো আচরণ যেন এই জায়গা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে না নেয় সেটা মনে রাখা দরকার।' 

দায়িত্বগ্রহণের দুই সপ্তাহ পর গতকাল (রোববার) সন্ধ্যায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের উপর হামলার বিষয়টি উল্লেখ করে তার অবস্থান জানান।

তিনি বলেন, '… এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তি বিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

1h ago