বিবিসির প্রতিবেদন

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে কট্টর ডানপন্থিরা

শাহবাগে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
শাহবাগে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর সহিংসতা হচ্ছে, বাড়ি-ঘর পুড়ছে এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানুষ সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে, এমন মর্মান্তিক সব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ 'বিবিসি ভেরিফাই'ও 'গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন সব ভিডিও যাচাই করে দেখেছে যে, সেগুলোর অনেকগুলোই ভুয়া ও মিথ্যা সংবাদ।

বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাশের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। ছবি: স্ক্রিণশট
বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাশের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। ছবি: স্ক্রিণশট

আজ রোববার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে 'সনাতন ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যা' চলছে দাবি করে অনেকে সেই ভিডিওগুলো শেয়ারও করছেন। বিবিসির মতে, মূলত কট্টর ডানপন্থিরা এসব কন্টেন্ট শেয়ার করছেন।

তাদেরই একজন হলেন স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন, যিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টমি রবিনসন নামে পরিচিত। কট্টর ডানপন্থি এই ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের দাঙ্গার সময় বিভ্রান্তিকর পোস্ট করার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন।

যুক্তরাজ্যে উগ্র ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত টমি রবিনসন, তথা স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেননের একটি 'এক্স' পোস্ট। ছবি: স্ক্রিণশট
যুক্তরাজ্যে উগ্র ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত টমি রবিনসন, তথা স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেননের একটি 'এক্স' পোস্ট। ছবি: স্ক্রিণশট

মন্দিরে হামলার ভুয়া খবর

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বেশ আলোচনায় রয়েছে।

৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় বাংলাদেশের চার শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীদের অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই রয়েছেন।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অতি ডানপন্থি দলের নেতাকর্মীরা এসব হামলার ঘটনাকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে মত দিয়েছেন ফ্যাক্ট চেকাররা।

ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, 'বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা' একটি মন্দিরে হামলা চালিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে, চট্টগ্রামে ধারণ করা এই ভিডিওতে নবগ্রহ মন্দিরের পেছনে অবস্থিত আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলার ঘটনা দেখা গেছে।

বিবিসি ভেরিফাইয়ের হাতে এই ঘটনার কিছু ছবি এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, হামলার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবিসহ বেশ কিছু পোস্টার পোড়ানো হয়েছে।

মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, গত ৫ অগাস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগের ওই কার্যালয়ে হামলা হয়। হামলার সময় কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল বাইরে বের করে এনে আগুন লাগানো হয়েছিলো।

চট্টগ্রামের এই মন্দিরে আগুন লাগানো হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামের এই মন্দিরে আগুন লাগানো হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। ছবি: সংগৃহীত

এই ঘটনায় মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বপন দাস। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, মন্দিরের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য ২৪ ঘণ্টাই মন্দিরটি পাহারা দেওয়া হচ্ছে।

অথচ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ছড়ানো হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণকারী অ্যাপ 'ব্র্যান্ডওয়াচ' বলছে যে, ভিডিওটি প্রায় একই ধরনের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে প্রায় দশ লাখ বার মেনশন করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি শেয়ার করা হয়েছে ভারত থেকে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।

পোস্টে লেখা হয়েছে, 'কট্টর ইসলামপন্থিরা' বাড়িটিতে আগুন দিয়েছে।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, পোস্টের বাড়িটি ক্রিকেটার লিটন দাসের নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজার।

ভারতে যারা এসব পোস্ট শেয়ার করছেন, তাদের অনেকেই কট্টর ডানপন্থি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক বলে জানা গেছে।

এক হিন্দু ব্যক্তি সাঁতার কেটে পালাচ্ছেন বলে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, তিনি আসলে মুসলমান। ছবি: সংগৃহীত
এক হিন্দু ব্যক্তি সাঁতার কেটে পালাচ্ছেন বলে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, তিনি আসলে মুসলমান। ছবি: সংগৃহীত

ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী

বাংলাদেশের মুসলমানদের নাম জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর এমন ঘটনা এখন ভারতের বাইরে এমনকি যুক্তরাজ্যেও ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) টমি রবিনসন নামে অ্যাকাউন্ট চালানো কট্টর ডানপন্থি স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন যাচাই না করেই এমন একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন।

এর শিরোনামে ইয়াক্সলি-লেনন 'হিন্দু গণহত্যা' শব্দটি উল্লেখ করেছেন।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার স্বামীর জীবন বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছেন।

পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, 'ইসলামপন্থিরা' হামলা করার পর ওই নারী এমন আকুতি জানিয়েছেন।

কিন্তু যাচাই করে বিবিসি পুরোপুরি ভিন্ন একটি ঘটনার খোঁজ পেয়েছে।

মূল ভিডিওটি আগস্টের ছয় তারিখে প্রকাশ করা হয়। এরপর স্থানীয় শিক্ষার্থীদের একটি দল ওই নারীকে সাহায্য করতে গিয়েছিল।

তারা বিবিসিকে জানিয়েছে যে, ভিন্ন একটি বিরোধের জেরে ঘটনাটি ঘটেছে এবং সেটার সঙ্গে 'ইসলামপন্থিদের' কোনো যোগসূত্র নেই।

'জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে ঘটনাটি ঘটে। বিষয়টি নিয়ে অনেক আগেই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল,' ঘটনাস্থল সরজমিনে দেখে এসে বিবিসিকে জানিয়েছে একজন শিক্ষার্থী।

প্রায় ছয় মাস ধরে স্থানীয় আদালতে জমির মালিকানা নিয়ে মামলাটি চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বিবিসিকে শিক্ষার্থীরা আরও বেশকিছু ছবি এবং ভিডিও দিয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে বাড়িটির ভিতরে অবস্থিত মন্দিরটি অক্ষত রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে বিবিসি। তারাও জানিয়েছে যে, হামলার ঘটনাটি ধর্মীয় কারণে হয়নি।

তারা আরও জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকার পতনের ঘটনায় তাদের এলাকার কোনো হিন্দু পরিবার বা মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেনি।

অথচ এক্সে টমি রবিনসন অ্যাকাউন্ট থেকে 'বিভ্রান্তিকর' শিরোনাম দিয়ে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার পতনের পর তার ম্যুরাল বিকৃত করে বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স
শেখ হাসিনার পতনের পর তার ম্যুরাল বিকৃত করে বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স

বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাজ্যের দাঙ্গার সময় ওই একই অ্যাকাউন্ট থেকে অভিবাসী এবং মুসলমানদের লক্ষ্য করে উস্কানিমূলক পোস্ট করা হয়, যা নিয়ে পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

তবে এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নামে দুইটি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের অর্ধ শতাধিক জেলায় সংখ্যালঘু মানুষের উপর দুই শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে।

তবে এসব হামলার ঘটনার জেরে ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানোর ঘটনাও বেড়েছে।

বাংলাদেশে বার্তাসংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট-চেকার কদরউদ্দিন শিশির বিবিসিকে বলেছেন, 'বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর রাজনৈতিক কারণে হওয়া হামলাগুলোকে ভারতের ডানপন্থি সমর্থকরা "ধর্মীয়" হিসেবে ছড়াচ্ছেন।'

সংখ্যালঘুদের সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসেবে, সরকার পতনের পর অন্তত পাঁচজন হিন্দু নিহত হওয়ার খবর তারা পেয়েছেন, যাদের মধ্যে দুইজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

আর বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে যে, সহিংসতায় আওয়ামী লীগের ৫০ জনেরও বেশি মুসলিম নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।

মন্দির পাহারায় মইনুল (বাঁদিক থেকে তৃতীয়)। ছবি: সংগৃহীত
মন্দির পাহারায় মইনুল (বাঁদিক থেকে তৃতীয়)। ছবি: সংগৃহীত

মুসলমানরাই পাহারা দিচ্ছে মন্দির

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে যখন ভুয়া খবর বেশি ছড়ানো হচ্ছে, তখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক এলাকায় মুসলমান শিক্ষার্থীরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছেন।

যারা এই কাজ করছেন, তাদেরই একজন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী মইনুল।

বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ 'বিবিসি ভেরিফাই' যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তিনি তার আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে 'শ্রী শ্রী সীতা কালী মাতা মন্দির' পাহারা দিচ্ছিলেন।

'তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদের। আমরা সব সরকারি স্থাপনা, মন্দির, গির্জা – সব কিছুই রক্ষা করব', বলেন মইনুল।

তার কথায়, যেসব পোস্ট ছড়াচ্ছে, সেগুলো 'আমাদের চোখে দেখা বাস্তব ছবির সঙ্গে মিলছে না। ওই সব পোস্ট বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল হিসেবে তুলে ধরছে।'

বিক্ষোভকারীদের ওপরে ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যার শেষে যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেন, বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা খুব আশ্চর্যের কিছু ছিল না।

অন্যদিকে, থানাগুলোতে আক্রমণ হওয়ার ফলে পুরো বাংলাদেশেই ছিল না পুলিশ। এই সময়েই সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে লুট চলে, সহিংসতা শুরু হয়।

তবে বাস্তবে দেখা গেছে, যে সাধারণ নাগরিকদের বাড়িতেও লুট চলেছে, তাদেরও কেউ কেউ সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের নতুন, অন্তর্বর্তী সরকার।

বিবিসির মূল প্রতিবেদনে তথ্য সহায়তা দিয়েছেন জয় চেথাম, কুমার মালহোত্রা

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

13h ago