বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও

কেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এত দুর্বল হবে? তাহলে কি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এত বছর এগোনোর বদলে শুধুই পিছিয়েছি?

শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পরবর্তীতে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা রীতিমতো রোমহর্ষক। ১৬ বছরের কর্তৃত্বপরায়ণ, একনায়ক শেখ হাসিনাকে গদিচ্যুত করতে প্রচুর রক্ত ঝরেছে। অনেক মানুষ গুরুতর আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে। রাজপথে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে ক্ষোভ ও ঘৃণা ছুঁয়েছে হিমালয়ের চূড়া—এ কথা ধ্রুব সত্য। কিন্তু শেখ হাসিনা বিদায়ের যে উচ্ছ্বাস-আনন্দ, তা মাত্র তিন দিনে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। চারদিকে নজিরবিহীন নৈরাজ্য। আরও ভীতিকর বিষয় হলো এ বিষয়গুলো রোধ করা, দেখা বা আটকানোর জন্য কোথাও কেউ নেই। দেশের পুলিশবাহিনীর সদস্যরা নিজেই নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে। দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া পুলিশ প্রধান বক্তব্য দিয়েছেন অজ্ঞাত স্থান থেকে। কী ভয়াবহ পরিস্থিতি! একটা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এই অরাজক, মাৎস্যন্যায়ের জন্য কে দায়ী, তা পরে খুঁজে বের করা যাবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বিষয় এই অবস্থার অবসান হওয়া। এটাই খুব জরুরি। এক সেকেন্ডও সময় হাতে নেই নষ্ট করার। দেশটার এরইমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়েছে। দয়া করে আর নয়।

আওয়ামী লীগের আজকের এভাবে ভূপাতিত হওয়ার কারণ অনেক। কিন্তু আমার মনে হয় শেখ হাসিনার সম্রাজ্য পতনের প্রধান কারণ তার দম্ভ, অহংকার। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন দেশটা জনগণের। পতনের কয়েকদিন আগেও তিনি দম্ভ দেখিয়ে বলেছিলেন শেখ হাসিনা পালায় না! কিন্তু কয়েকদিন পার না হতেই লক্ষ্মণ সেনের মতো পালিয়ে গেলেন। নিজ দলের নেতাকর্মীদের রেখে গেলেন মৃত্যুর মুখে। উন্মত্ত জনতার রোষ থেকে বাঁচতে তারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আত্মগোপনে আছেন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাকর্মী, সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রীরা।

এদিকে পালাবদলের মধ্যকার শূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছেন মুক্তচিন্তার মানুষ, শিল্পী, শিল্পীর বাড়ি-বাদ্যযন্ত্র, শিল্পকর্ম, এমনকি লাইব্রেরি। নির্বিচারে চলেছে ভাস্কর্য ভাঙা ও চিত্রকর্মের ধ্বংসযজ্ঞ। এমনকি শিশুদের বিকাশ কেন্দ্র জাতীয় শিশু একাডেমিও আক্রান্ত। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ভীতিকর খবরও আমরা পেয়েছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরইমধ্যে এমন কিছু ভিডিও, ছবি ছড়িয়ে পড়েছে যা রীতিমতো ভয়ংকর। বিশ্ব দরবারে যা মারাত্মকভাবে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। কালিমালিপ্ত হচ্ছে বাঙালির সহনশীল, মধ্যপন্থী ও অতিথিপরায়ণ পরিচয়ে। বরং এর বিপরীতে আমরা পরিচিত হচ্ছি বর্বর, বিবেকশূন্য ও বিবেচনাহীন একটি জাতি হিসেবে। যা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে এখনই।

৫ আগস্ট সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ছিল না। সচিবালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, বিসিবি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গাতেই অকল্পনীয় নৈরাজ্য দেখা গেছে, যার কিছু এখনো আছে। গুজবে ভরে গেছে গোটা দেশ। কে কাকে হত্যা করছে, কীভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পরও দেশে এমন নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। শুধু ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা নেওয়ার পর দেশে এমন সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। যদিও ওই পরিস্থিতির অবসান হয়েছিল তিন দিন পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও বাংলাদেশকে কেন এই রকম একটি নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে? কেন মানুষের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। কেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এত দুর্বল হবে? তাহলে কি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এত বছর এগোনোর বদলে শুধুই পিছিয়েছি?

বাংলাদেশে রাজনৈতিক খুনাখুনি, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে-পরে এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। যার অংশ হিসেবে ভয়াবহ এক দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। যদিও এই সংঘাতের কারণ বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল না। ভারতের কাশ্মীরে হযরত বাল মসজিদে মহানবী হযরত মুহম্মদের (স.) পবিত্র চুল সংরক্ষিত ছিল। ১৯৬৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর যা চুরি হয়। এ নিয়েই পুরো পাকিস্তানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। যা থেকে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। এই দাঙ্গাতে কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার কোনো হিসাব না থাকলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, প্রাণ হারিয়েছিলেন অনেকে হিন্দু। ওই সময় প্রাণহানি ও সম্পদ ক্ষয় ঠেকাতে মাঠে নেমেছিলেন বাংলাদেশের বিবেকবান শান্তিকামী মানুষেরা। সে সময় তারা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৪ সালের মতোই ২০২৪ সালে আগস্টে চলমান নারকীয় তাণ্ডব মোকাবিলায় সবাইকে আবার এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে অবিলম্বে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা।

১৯৬৪ সালের ওই দাঙ্গা প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সংবাদকর্মীরাও। ১৯৬৪ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছিল একই শিরোনামের সংবাদ, যার শিরোনাম ছিল 'পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও'। ২০২৪ সালের আগস্টে একজন সামান্য শিক্ষক ও সংবাদ ভাষ্যকার হিসেবে আমার আহ্বান 'বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও'। এই আত্মবিনাশী, ভ্রাতৃঘাতি নৈরাজ্য আর চলতে পারে না। আর একদিনও না।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Dengue danger not over yet

As rain and thunderstorms are expected in various parts of the country over the next few days, experts warn that the dengue season could extend further this year

1h ago