'আক্রমণের ধরনই বলে ওরা ছাত্র না'
নামিরার বয়স সাড়ে তিন, আর নাদিরার মাত্র এক বছর। তাদের বাবা ট্রাফিক সার্জেন্ট সৈয়দ মাসুদুর রহমান কাজ থেকে ফিরে তাদের সাথে খেলতেন। গত ছয়দিন ধরে বাবা কাজে যাচ্ছেন না, শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। আন্দোলনকারীদের একাংশের আঘাতে বদলে গেছে তার চেহারার আদল। মেয়েরাও তাকে চিনতে পারছে না।
ওয়ারি ট্রাফিক ডিভিশনে কর্মরত মাসুদ গত ১৮ জুলাই ডিউটিতে যোগ দিতে আফতাবনগরের সি ব্লকের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। আফতাবনগর সি ব্লকের সামনে আন্দোলনকারীদের একটি দল তার ওপর আক্রমণ করে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমাকে এলোপাতাড়ি লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে আমি একটি ব্যাংকে ঢুকতে চাইলে, সেখানেও প্রবেশ করতে পারিনি। পরে আমি আবার আক্রমণের শিকার হই। পরে সিনিয়রদের জানানোর পর আমি ওই ব্যাংকে আশ্রয় পাই। কিন্তু তারাও সেখানে আসতে পারছিলেন না।'
'এক পর্যায়ে আমার স্ত্রী সেখানে আসেন। যারা আক্রমণ করেছিল আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই, তারাই আমাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। পরে তারা আমাকে সেখান থেকে যেতে দেয়। তাদের আক্রমণে আমার ডান হাত ভেঙে গেছে, একটি আঙ্গুলে আটটি এবং মাথায় দশটি সেলাই লেগেছে।'
মাসুদ বলেন, 'আক্রমণের ধরণই বলে আমিসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যের ওপরে যারা আঘাত করেছিল তারা ছাত্র না। সাধারণ ছাত্ররা প্রতিরোধ করেছে।'
শুধু মাসুদুর রহমানই নয়, এমন ৫৮ জন পুলিশ সদস্য বর্তমানে রাজধানীর কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের মধ্যে একজন ভর্তি রয়েছেন আইসিইউতে।
আহত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে ডেইলি স্টার। তারা বলেছেন, 'যে নৃশংসভাবে পুলিশ সদস্যদের ওপরে হামলা করা হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই ছাত্রদের আক্রমণ হতে পারে না'।
গত ১৮ জুলাই খিলগাঁও থানার কনস্টেবল আমিনুল ইসলামের ডিউটি ছিল রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকায়।
তিনি বলেন, 'ওইদিন সকাল ১০টা থেকে আমার ডিউটি শুরু হয়। তিন ঘণ্টা ধরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছিল। একটা পর্যায়ে তিনদিক থেকে আন্দোলনকারীরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলে। আমি হাতিরঝিলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে আরেক পুলিশ সদস্যর সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যাই। এরপর এলোপাতাড়ি আমাকে মারতে শুরু করে। সাধারণ কিছু মানুষ তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে আমাকে সিএনজিতে করে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে আসে।'
তিনি জানান, শুধু মাথাতেই ৬০টি সেলাই পড়েছে। আর বাইরে বাম হাত ভেঙেছে, আঙ্গুল ভেঙেছে দুইটি।
১৮ জুলাই দফায় দফায় উত্তরায় আক্রমণের শিকার হন উত্তরা পশ্চিম থানার এএসআই মো. মহিউদ্দিন।
তিনি বলেন, 'পরিবেশ ভালো না দেখে আমি আব্দুল্লাহপুরের দিকে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলাম। এসব আমাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সামনে আটকে এসএস পাইপ, পানির পাইপ ও চাপাতি দিয়ে মারতে থাকে। আমি অবস্থা খারাপ বুঝে একটি বাসার রান্নাঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেই। পরে তারা সেই দরজা ভেঙে আমাকে মারতে শুরু করে। প্রায় ২৫ মিনিট তারা আমাকে মারে।'
'এরপর ওরা আমাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু আরেকপক্ষ ওই অ্যাম্বুলেন্সেও হামলা করে কাঁচ ভেঙে ফেলে। এমনকি নার্সদেরও মারতে থাকে। হাসপাতালের ভেতরে আমি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাইনি। এ সময় আমার স্ত্রী হাসপাতালে আসলে তাকেও আঘাত করা হয় এবং তাকে লাশঘরে নিয়ে যেয়ে বলে- "তোমার স্বামীরে খুঁজে বের কর"। পরে রাত ১টার দিকে আমি পুলিশ হাসপাতালে আসার জন্য সিএনজিতে উঠি, মহাখালী এলাকায় আমি আবারও আক্রমণের শিকার হই।'
তিনি বলেন, আমার ২২ বছরের সার্ভিস লাইফে এমন নৃশংস হামলা দেখিনি। তাদের আক্রমণে আমি নিশ্চিত তারা কোনোমতেই ছাত্র হতে পারে না।
জাতীয় সংসদের স্পিকারের প্রটেকলে থাকা পুলিশ সদস্য কনস্টেবল মোতালেব হোসেন যাত্রাবাড়ী কাজলা এলাকায় আক্রমণের শিকার হন। তিনি জানান, কথা বলতে গেলে তার মাথায় ব্যাথা করে।
তিনি বলেন, 'আমি হাফ ইউনিফর্মড ছিলাম। ওরা যখন বুঝতে পারে, আমি পুলিশ, তখন চাইনিজ কুড়াল দিয়ে মাথার বাম পাশে আঘাত করে। আমার মাথার মগজ বের যায় এবং আমি সেন্সলেন্স হয়ে যাই। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।'
পুলিশের এসবির এসআই আব্দুল্লাহ আল কাইয়ূম যাত্রাবাড়ী এলাকায় গত ১৯ জুলাই আক্রমণের শিকার হন।
তিনি বলেন, 'আমি নাইট ডিউটি শেষে যাত্রাবাড়ীর বাসায় ফিরছিলাম। আমি সিভিল ড্রেসে ছিলাম। আন্দোলনকারীদের একজন আমার প্যান্ট দেখে পুলিশ হিসেবে আইডেন্টিফাই করে এবং মারধর শুরু করে। যারা মারছিলো তাদের দেখেই আমি বুঝতে পারি ওরা ছাত্র না।'
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসার সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক (ডিআইজি) শেখ মো. রেজাউল হায়দার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আমাদের সামর্থ্যর সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আহত পুলিশ সদস্যদের ট্রিটমেন্ট করেছি। পুলিশ সদস্যদেরা হাসপাতালে আসার এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে ট্রিটমেন্টের আওতায় এসেছে। আমাদের এখানে ৩০ জন রোগীর অপারেশন করা হবে। ইতিমধ্যে আমরা শিডিউলও রেডি করেছি।'
তিনি জানান, এসব চিকিৎসায় আমাদের দুই কোটি টাকার মধ্যে খরচ হবে। কারণ, আমরা সম্পূর্ণ চিকিৎসা বিনামূল্যে করছি।
সর্বোচ্চ ২৫৯ জন পুলিশ সদস্য সেখানে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে তিনজন মারা গেছেন বলে জানান তিনি।
Comments