ভয় ও সন্ত্রাসমুক্ত সচল একাডেমিক ক্যাম্পাস চাই: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক

নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক
ছবি: সংগৃহীত

'চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিগত কয়েকদিন যা ঘটেছে তাতে সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে শিক্ষকরা সকলেই বেদনাহত। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন নানান সংঘাতময় পরিস্থিতি পেরিয়ে সাত জনের মৃত্যু ও হাজারো তরুণের আহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছে রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিতর্কিত, একপেশে ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা—যা দেখে আমরা বিক্ষুব্ধ।'

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার দেওয়া প্রতিবাদলিপিতে এ কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে গীতি আরা নাসরীন প্রতিবাদলিপিটি পাঠান।

এতে বলা হয়েছে, 'দেশ যখন চরম এক সংকটময় পরিস্থিতিতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার জাতির উদ্দেশে প্রায় আট মিনিটের এক ভাষণ দেন। তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি তরুণ সমাজের স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ ও পেশাগত সুযোগের দাবির বিষয়টি আজও অন্তরে ধারণ করেননি। তার বিচারে বরং সেসব "কোমলমতি" তরুণরা "কিছু বিশেষ মহল" দ্বারা বিভ্রান্ত। সেই বিশেষ মহলকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেননি, কিন্তু তাদের "সন্ত্রাসী কার্যক্রমের" যে উদাহরণ তিনি দিলেন, তার শিকার হিসেবে নিজের দলের ছাত্রের কথাই কেবল উল্লেখ করেন।'

'যেকোনো তরুণ প্রাণের, তার ভাষায় "অহেতুক মৃত্যু"ই বেদনাদায়ক ও নিন্দনীয়। কিন্তু তার এই পক্ষপাতে বোঝা যায়, তিনি সব নাগরিকের সরকারপ্রধান নন, কেবল তার নিজের লোকের জন্যই তার ভাবনা ও কার্যক্রম আবর্তিত।'

'চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের সদস্যর মৃত্যুর পূর্বে যে পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রলীগের যৌথ তৎপরতায় চার জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে, তা উল্লেখ করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। এমনকি যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন, তা যেন কেবল আন্দোলনকারী এবং কিছু মহলেরই একার ব্যাপার ছিল। তার অনুগত ছাত্রলীগের সদস্য ও বহিরাগত ভাড়াটেরাই যে ১৫ জুলাই প্রথম আন্দোলনকারীদের ওপরে চড়াও হয়ে ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, তার ভাষণে সেসবের কোনো উল্লেখ ছিল না।'

'তিনি জানান, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বের করা হবে, কারা ছিল উস্কানিদাতা এবং অরাজক পরিস্থিতি তৈরির জন্য কারা দায়ী ছিল। তাদের বের করে যে শাস্তি দেওয়া হবে, তাও তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু তার উদাহরণ বাছাই দেখে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে এই তদন্ত ও শাস্তি প্রক্রিয়ায় হত্যাকারী পুলিশ ও সন্ত্রাস কায়েমকারী ছাত্রলীগের সদস্যদের রেহাই দেওয়া হবে এবং আন্দোলকারীদেরই বেছে বেছে শাস্তি দেওয়া হবে।'

'ইতোমধ্যে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাব দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দখল থেকে হলগুলো মুক্ত হওয়ার পরের দিনই এই পদক্ষেপ আমদের শঙ্কিত করে যে ছাত্রলীগের পশ্চাদপসরণের ফলে এখন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ সরাসরি নিতে চায়।'

'আমরা সামনের দিনগুলোয় ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবো যে ক্যাম্পাসগুলো ছাত্রলীগের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে পুনরায় এক সন্ত্রস্ত জনপদ হয়ে ওঠে কিনা।'

'আর যে কথাটি বলতেই হয়, অহেতুক প্রাণ ঝরে যাওয়া এবং অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে খোদ প্রধানমন্ত্রীর যে দায় আছে, তার বক্তৃতায় স্বীকার করার সৎসাহস তিনি দেখাননি। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক পর্যায়ে আচমকা তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা প্রথা বিলোপ করার ঘোষণা দেন। অথচ আন্দোলনকারীরা কোটা প্রথার বিলোপ চাননি, চেয়েছেন সংস্কার। তার সেই সিদ্ধান্তের কারণেই কিছু নাগরিক সেই সংক্রান্ত পরিপত্র বাতিলের দাবি জানিয়ে পরে রিট করেছে এবং হাইকোর্ট ওই পরিপত্রটি সংবিধানের কিছু ধারার পরিপন্থী হওয়ায় গত জুন মাসে তা অবৈধ ঘোষণা করে।'

'কারণ সংবিধানে অনগ্রসর নাগরিকদের নানান সুবিধা দেওয়ার কথা আছে। ২০১৮ সালেই যদি তিনি সংস্কারের ব্যবস্থা নিতেন, তবে আজ এই পরিস্থিতি হতো না। তিনি ১৪ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে জানান, "বিরক্ত হয়ে" কোটা প্রথা বাতিল করেছিলেন। বস্তুত তিনি কোনো জন দাবিই সহজে মানতে চান না, সব দাবি ও আন্দোলনের ভেতরেই তিনি "কিছু মহলের" উস্কানি ও অংশগ্রহণ দেখেন। দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা বাদ দিয়ে বিরক্তি ও জেদের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা কখনোই জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হয় না।'

'সেই সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমনকি আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে "রাজাকারের নাতিপুতি" বলে কটাক্ষ ও তাচ্ছিল্য করেন এবং এ কারণে সেই রাতেই শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তার নিজের এই দুই দায় এড়িয়ে বক্তৃতাজুড়ে তিনি আন্দোলনের পেছনের ষড়যন্ত্র খুঁজে গেলেন।'

'প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর গত পাঁচ দিনে আন্দোলনকারীদের ফুঁসে ওঠা, আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্মম হামলা, শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়ন, পরদিনই আবার পুলিশ দিয়ে ক্যাম্পাসগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া—এই ঘটনাগুলো একের পর এক দ্রুত ঘটতে থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ বলপ্রয়োগ করা হয়।'

'এই পুরো প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদেরকে দেখা যায়নি, বলা যায় কোনো ধরনের কার্যক্রমেই তারা হাজির ছিলেন না। তাদের একমাত্র কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অবৈধ নির্দেশক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়া এবং বিজিবি ও পুলিশ বাহিনীকে ক্যাম্পাসে অবাধে প্রবেশ করতে দেওয়া।'

'এমনকি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতে কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও ইন্টারনেটের গতি কমানো হয়। শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস ত্যাগ করার জন্য মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় এবং অবরুদ্ধ পরিবেশে পরিবহণ সেবা দেওয়া কিংবা ধাপে ধাপে হল খালি করার মতো ধৈর্য ধারণ করতে রাজি ছিলেন না প্রশাসকরা। এরকম দায়িত্বহীন প্রশাসকদের শীর্ষে আছেন ঢাকা,  জাহাঙ্গীরনগর, বেগম রোকেয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। তাদের কেউ বলছেন ক্যাম্পাস তার নিয়ন্ত্রণে নেই, কেউ মাথা নিচু করে অভিযোগ শুনছেন, কাউকে প্রয়োজনের সময় পাওয়া যাচ্ছে না—অথচ পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন আক্রমণের। এ বড় লজ্জার দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে।'

'এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষক নেটওয়ার্কের কিছু শিক্ষক এবং কিছু নাগরিক এগিয়ে আসেন অবরুদ্ধ ও অপ্রস্তুত শিক্ষার্থীদের নিজ বাসায় স্বল্পকালীন থাকার সুযোগ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আবারো প্রমাণ দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষার চাইতে তারা সরকারের আজ্ঞাবহ থাকতে চান এবং যাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আছে, তারা সেই অধিকার প্রয়োগ করতে চান না।'

'বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রভোস্টসহ প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের এই নতজানু ও জনবিরুদ্ধ অবস্থান দেখে আমরা ভয়ঙ্করভাবে ক্ষুব্ধ এবং শিক্ষক সমাজের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে মারাত্মকভাবে লজ্জিত। বছর বছর লাগাতার শিক্ষার্থীবিরুদ্ধ ভূমিকা সত্ত্বেও তারা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সামনে যাওয়ার মতো নির্লজ্জ ও বেহায়া প্রজাতিতে পরিণত হয়েছেন।'

'সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি—

১. প্রধানমন্ত্রী তার অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের জন্য শিক্ষার্থীসমাজের কাছে দুঃখপ্রকাশ করবেন।

২. যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকেরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা না দিয়ে তাদের হামলার মুখে ছেড়ে দেওয়ার মতো দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন—যেমন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যসহ প্রক্টোরিয়াল বডি পদত্যাগ করবেন।

৩. নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. হত্যাকারী ও হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে হবে এবং শাস্তি দিতে হবে। আটক-গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে। সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে হবে এবং ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্রাবাস উদ্ধার করে পুরোপুরি শিক্ষকদের ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দিতে হবে। মেধার ভিত্তিতে ছাত্রাবাসের আসন বণ্টন করতে হবে। হলগুলো ছাত্রলীগের দখলমুক্ত রাখতে হবে।

৬. অবিলম্বে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে। সংবিধানের আলোকে একটি কমিটি গঠন করে কোটা সংস্কারের রূপ নির্ধারণ করতে হবে। কমিটিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

No philanthropy, they staged robbery for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

8m ago