'পাকা দেখা'য় নির্মোহ ভালোবাসার উপাখ্যান
বাংলা কথাসাহিত্যে শক্তিমান লেখক শওকত আলী। তাঁর প্রদোষে প্রাকৃতজন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক। নাঢ়াই নামে তাঁর একটি উপন্যাস আছে যেখানে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা তুলে ধরে লেখা হয়েছে এমন তিনটি উপন্যাসের অন্যতম হলো শওকত আলীর যাত্রা। পাকা দেখা তাঁর শেষের দিকে লেখা। নীপা ও রাতুল নামের দুই তরুণ-তরুণী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। দুইজনের মধ্যে বঞ্চনার দিক থেকে আশ্চর্যরকম মিল। চাকুরির খোঁজে তাদের যাত্রা শুরু।
সুসান ই শোয়ার্তজ তাঁর দি এবসেন্ট ফাদার ইফেক্ট অন ডটার্স গ্রন্থে একজন কন্যা সন্তানের জীবনে বাবার অনুপস্থিতির যে বিরুপ প্রভাব ফেলে তার খুটিনাটি আলোচনা করেছেন। মানব সন্তানের জন্য বাবা-মা দু'জনেরই উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বাবা মা যে কোনো একজনের অনুপস্থিতি সন্তানকে এতিম করে দেয়। বাবা মা যে কোনো একজনের অনুপস্থিতির ফলে সন্তানের যে জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে মনোবিদদের গবেষণার সারবস্তু এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
মা বাবা যে কোনো একজনের অনুপস্থিতে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের মানসিক স্থিরতা সহজে গড়ে উঠে না। তদের মধ্যে এক ধরণের শূন্যতা তৈরি হয়। অনেকে নিভৃত, নির্জনবাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মেয়েদের মনোজগতে পুরুষ মানুষের প্রতি এক ধরণের বিরূপতা গড়ে ওঠে। ছেলেরা যে কোনো সম্পর্কে এক ধরণের নির্ভরতা বা আত্মীয়তা খুঁজে বেড়ায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকটা নাটকীয় অবস্থান গড়ে উঠে তাদের মধ্যে। অনেকে নেশা, নারী এবং উন্মত্ততায় মেতে উঠে। পাকা দেখা উপন্যাসের নীপা ও রাতুল উভয়ের মধ্যে উপরেল্লিখিত বেশ কিছু বৈশিষ্ঠ্য বিদ্যমান।
ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের "অভ প্যারেন্টস" বা "অভ ম্যারিজ এন্ড সিঙ্গেল লাইফ " পড়লে ইহ সংসারে যে কারো পক্ষে পরিবার ও বাবা মায়ের অস্তিত্বের গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। বাবাকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত ব্যাণ্ড তারকা জেমসের গাওয়া 'বাবা কত দিন দেখিনি তোমায়' গানটি শুনলে আমাদের চোখ আদ্র হয়ে আসে। বিশেষ করে আমাদের মধ্যে যারা বাবার আদর বঞ্চিত বা বাবাকে হারিয়েছেন অথবা সামাজিক বা পারিবার কারণে একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে তাদেরকে এই গানটা ভেতর থেকে নাড়া দেয়।
পাকা দেখা উপন্যাসের নীপা তার জন্মের আগে বাবাকে হারায়। সে যত বড় হতে থাকে তত বাবার অভাব বুঝতে শুরু করে। যখন সে জানতে পারে মায়ের বর্তমান স্বামী তার বাবা নন। নীপার বাবা ছাত্রকালের শেষদিকে এসে বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার দায়ে খুন হন। তখনো তাদের বিয়ে হয়নি। শারিরীক সম্পর্কের ফলে পেটে আসা ভ্রুণকে নীপার মা বেশ যত্নে দুনিয়ার আলো দেখানোর দায়িত্ব পালন করেন। আবার নীপার দাদা-দাদি বা চাচারা এই বিষয়টাকে মেনে নেয়নি। তবে নানা-নানীর উদার ব্যক্তিত্ব ও তার মায়ের অবিচলতার কারণে ভালোবাসার সে ফল দুনিয়ার আলো দেখতে পায়। এসব জানার পর নীপার মনোজগতে এক ধরণের অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে তাকে অনেক ভোগায়।
পড়ালেখায় নীপা বেশ মনোযোগী ছাত্রী। কিন্তু, সৎ বাবার সংসারে সে ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ে। যদিও তার মায়ের স্বামী ভদ্রলোক তাকে খুব যত্ন করেন। কিন্তু, নীপা সেই একই নৈকট্য অনুভব করে না। যা একজন বাবা ও মেয়ের মধ্যে গড়ে উঠে। মায়ের সাথেও তার এক ধরণের বোঝাপড়ার দুরত্ব তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছেলে বন্ধুকে সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। সমবয়সী অন্যান্য মেয়েদের প্রায় সবার প্রেম হলেও নীপার সেটা হয়ে উঠে না। কারণ সে পুরুষ মানুষের প্রতি এক ধরণের ঘেন্না অনুভব করে। তার মা একজন সম্পন্ন পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক করতে গেলে বাঁধে দুনিয়ার বিপত্তি। ভদ্রলোক আমেরিকা প্রবাসী। স্ত্রীকে নিয়ে যেতে চায় সে দেশে। নীপা তাতে কোনোভাবেই রাজি হয় না। অনেক চড়াই উতরায় পেরিয়ে সে বিয়েটা ঠেকাতে সমর্থ হয়। তার সাফ কথা সে দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না জানিয়ে। কারণ দেশের মাটিতে মিশে আছে তার বাবার রক্ত। এদেশের ধুলোয় মিশে আছে তার বাবার শরীর। যার স্পর্শ সে কোনোদিন পায়নি।
নীপার মনে সবসময় একটা ভীতি কাজ করতো। তাঁর বাবার পরিচয় যদি জানাজানি হয় তবে তার জীবনে আসা নতুন মানুষটি কিভাবে নেবে। মা হারা, নারীদের প্রতি বিরুপ ধারণা পোষোণ করা রাতুলকে পেয়ে তার সেই ভীতি কাটে
রাতুলের সাথে নীপার দেখা হয় একটা স্কুলের চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে। উভয়েই চাকুরিপ্রার্থী। নীপার চাকুরি হয়। রাতুলের হয় না। সে সাংবাদিকতায় যায়। তার মধ্যে এক ধরণের বিপ্লব মনস্কতা আছে। ভালো কিছু করার স্বপ্ন আছে তার বুকে। নীপার সাথে তার বন্ধুত্ব হলে জানা যায় রাতুল মেয়ে মানুষকে স্বার্থপর ছাড়া কিছুই ভাবে না। কারণ অবশ্যই তার সৎ মা। সৎ মায়ের আচরণে তার জীবন দুঃসহ হয়ে উঠে। তাই সে নারীদের পছন্দ করে না। অন্যদিকে নীপা পুরুষ মানুষদেরকে ঘেন্না করে। কিন্তু, বন্ধুত্ব তাদেরকে কাছে আনে। বন্ধু সম্পর্কে ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, 'বন্ধু হলো সে যার সাথে আমরা মন খুলে সবকিছু ভাগাভাগি করে নিতে পারি'। খলিল জিবরান বলেছেন, 'বন্ধু হলো পরস্পরের গোপনীয়তা রক্ষার ঢাল'। এদের ক্ষেত্রেও তাই হয়।
নীপার মনে সবসময় একটা ভীতি কাজ করতো। তাঁর বাবার পরিচয় যদি জানাজানি হয় তবে তার জীবনে আসা নতুন মানুষটি কিভাবে নেবে। মা হারা, নারীদের প্রতি বিরুপ ধারণা পোষোণ করা রাতুলকে পেয়ে তার সেই ভীতি কাটে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের সম্মন্ধকে না করে দেওয়ার পর সে ভাবে রাতুলই হবে তার জীবনসঙ্গী। অথচ রাতুলকে ভালোলাগার কথাটা এখনো বলা হয়নি তার। ব্যক্তি সম্পর্কের এই নাটকীয় অবস্থানের কারণ হলো নীপার অস্থির মনোজগত। তারা ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রতি মনো্যোগী হওয়ার পরিবর্তে এক ধরণের নাটকীয় অবস্থানে চলে যায় বা সৃষ্টি করে। উপন্যাস এখানেই শেষ। এখানে শওকত আলীর লেখক হিসেবে বড়ত্ব। পাঠককে ভাবিত করে তোলা, ভাবনার স্পেস দেওয়া।
পারিবারিক সম্পর্কের জটিল আবর্ত নিয়ে ডিএইচ লরেন্সের লেখা সান্স এন্ড লাভার্স, ডরিস লেসিং এর দ্য গ্রাস ইজ সিঙিং এর কথা আমরা জানি। উভয় উপন্যাসেই পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও নানা জটিল আবর্তের কথা এসেছে। সৈয়দ শামসুল হক রচিত জনক ও কালো কফি উপন্যাসে দেখতে পাই কেন্দ্রীয় চরিত্র মুসতাককে, যার জীবনে কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে গড়ায় না। মা-হীন বেড়ে ওঠা সন্তানের জীবনে যতরকম বিপত্তির কথা আমরা মনসতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে জানতে পাই তার প্রায় সব কয়টা বিপত্তি তার জীবনে ঘটে তার জীবনে। এতে নীপা ও রাতুল দু'জনেই এতিম হওয়ার ফলে নানাভাবে অবহেলিত হয়। বঞ্চিত হয় স্বাভাবিক হওয়া থেকে। নীপা তবুও দেশ ছেড়ে যেতে রাজি হয় না। কারণ তার বাবার রক্ত মিশে আছে এদেশের মাটিতে।
Comments