ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ৮, বিএসএফের গুলিতে নিহত ১৩: আসক

আসক

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে অন্তত ২ জন নারীসহ ৮ জনের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়া একই সময়ে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ১১ জন।

আজ বৃহস্পতিবার মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

গণমাধ্যমে পাঠানো আসকের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নার সই করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, সীমান্তে হত্যা, সাংবাদিক নিপীড়নসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। 

হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন

গত ছয় মাসে দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে অন্তত ২ জন নারীসহ ৮ জনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। 

এর মধ্যে, যশোরের অভয়নগর থানায় পুলিশ হেফাজতে আফরোজা বেগম (৪০) মারা গেছেন। পরিবারের অভিযোগ, ঘুষের দাবিতে তাকে পুলিশ নির্যাতন করে হত্যা করেছে। 

গত ১ জুন রাত দেড়টার দিকে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রাম থেকে তাকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ২ জুন সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আফরোজা বেগম থানা-হাজতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সুস্থ বোধ করলে তাকে থানায় ফিরিয়ে আনা হয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

আফরোজা বেগমের ছেলে অভিযোগ করেন, ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। 

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে র‌্যাবের হেফাজতে গৃহবধূ সুরাইয়া বেগম (৫২) মারা গেছেন। পরিবারের অভিযোগ, তাকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় শারীরিক নির্যাতনের ফলে তার মৃত্যু হয়। 

বরুণাকান্দি গ্রামের আজিজুল ইসলামের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম পুত্রবধূ রেখা বেগম হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। এ মামলায় গত ১৬ মে রাতে সুরাইয়াকে নান্দাইল এবং তার ছেলে রেখার স্বামী তাজুলকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছিলেন ভৈরবের র‌্যাব সদস্যরা। 

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানা এলাকার ফিরোজ হোসেনকে গত ৯ জুন শৈলকুপা থানা পুলিশ মারধর করে এবং এক পর্যায়ে গুলি করে। গুলির ঘটনায় ফিরোজ হোসেন গুরুতর আহত হন এবং ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে তার হাত কেটে ফেলতে হয়। 

পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে ঢাকার লালবাগ এলাকায় মো. ফারুক হোসেনের কারাগারে মৃত্যুর অভিযোগ করেছে পরিবার। পরিবারের পক্ষ থকে এ ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

চট্টগ্রামে পুলিশের নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়ে কারা হেফাজতে রুবেল দের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে পরিবার। এ ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

নাশকতায় মামলায় কারাবন্দী বাগেরহাট জেলা যুবদল নেতা কামাল হোসেন এবং কারাবন্দী নাটোর জেলা যুবদল নেতা এ কে আজাদের মৃত্যু হয়। আটকের পরে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেছে পরিবার। 

অন্যদিকে, যশোর জেলার একজন যুবদল নেতা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

সীমান্ত হত্যা

আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ১১ জন।

গত বছরের প্রথম ছয় মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন, আহত ১৪ জন। 

অন্যদিকে, এবার মিয়ানমার সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে একজন বাংলাদেশি এবং একজন রোহিঙ্গা নিহত হন এ বছর। 

সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি

গত ছয় মাসে ১৪৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে আসক জানিয়েছে। 

শেরপুরের নকলা উপজেলায় দৈনিক দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদক শফিউজ্জামান রানা গত ৫ মার্চ উপজেলা কার্যালয়ে গিয়ে কিছু তথ্য না পাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে ইউএনও মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠান।

রাজনৈতিক সহিংসতা

জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের বরাতে প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ছয় মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৪০টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪১ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার ৭৩৬ জন। 

কারা হেফাজতে মৃত্যু 

এই সময়ে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৪৬ জন। তাদের মধ্যে কয়েদি ২০ জন এবং হাজতি ২৬ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১৩ জন হাজতি এবং ১০ জন কয়েদির মৃত্যু হয়।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন 

বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭টি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, ৫টি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ২১টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে আসক। অন্যদিকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ১টি মন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। 

নারীর প্রতি সহিংসতা

জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪৬ জন নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে হামলার শিকার ১১৩ নারী ও ৩৩ পুরুষ। 

যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন এক নারী। অন্যদিকে, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটের হাতে নিহত হয়েছেন ৪ জন পুরুষ।

ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ২৫০ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন ৩ জন। 

পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৬৯ নারী। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৯৪ জন নারী।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৩৩ নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন নারী। 

গণপিটুনিতে নিহত 

ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহত হন মোট ৩২ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন, খুলনা বিভাগে ২ জন, বরিশাল বিভাগে ১, ময়মনসিংহ বিভাগে ২ এবং সিলেট বিভাগে ১ জন নিহত হন। 

২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন ছয় মাসে গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৪। 

আসক জানিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ সংখ্যাগত প্রতিবেদন ১০টি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ ও আসকের নিজস্ব সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।  

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

11h ago