জাপানে পড়তে চাইলে যা জানা প্রয়োজন

বিশ্বজুড়ে অনেকের কাছেই অন্যতম স্বপ্নের গন্তব্য জাপান। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও নয়নাভিরাম দর্শনীয় স্থানের জন্য বিখ্যাত হলেও উচ্চশিক্ষার জন্যও ব্যাপক সুযোগ দেয় দেশটি। ফলে, বিদেশে পড়াশোনা করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের কাছে জাপান বেশ জনপ্রিয় দেশ এবং ধীরে ধীরে এই জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে।

সম্প্রতি জাপানের রিটসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে (এপিইউ) ভর্তি হওয়া শরীফ মাশরাফি বলেন, 'জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন করার আগে বেশ কয়েকজন সিনিয়র এবং পরিচিতজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তাদের অভিজ্ঞতা জানতে। জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনলাইন কর্মশালার আয়োজন করে। সেখান থেকেও অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং প্রায়শই এমন কর্মশালার আয়োজন করা হয়।'

শিক্ষার্থীদের বিশেষ জ্ঞানার্জন নিশ্চিতে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যক্রম রয়েছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজিতে পাঠদান করে এবং তারা সাধারণত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের স্কলারশিপ দেয়। যেমন: টিউশন ফি কমিয়ে দেয়, ভর্তি ফি কমিয়ে দেয় বা উভয় ক্ষেত্রেই ছাড় দেয়।

টোকিও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী হাসিন তাবাসসুম বলেন, 'আমি জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়েছি স্কলারশিপের জন্য। আমাকে শুধু এখানে পাঠানোর সামর্থ্য ছিল আমার মা-বাবার। তাদের নিশ্চিত করেছিলাম যে পড়াশুনা ও অন্যান্য খরচের ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারব।'

তিনি বলেন, 'আমি শতভাগ স্কলারশিপ পেয়েছি। স্কলারশিপের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বহন করা সম্ভব। তবে সেটা নির্ভর করবে আপনার টিউশন ফি কত, কতটা স্কলারশিপ পাচ্ছেন এবং কোন এলাকায় থাকবেন, তার ওপর।'

হাসিন তাবাসসুম বলেন, 'তবে এটা অবশ্যই বলে রাখা দরকার যে জাপানে কাজ করার জন্য আপনাকে অবশ্যই কিছুটা জাপানি ভাষা জানা থাকতে হবে। বাংলাদেশে থাকতে আমি জাপানি ভাষা শিখিনি। যার কারণে এখানে বেশকিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছে। জাপানে ক্লাস শুরু করার আগে ভালো পার্টটাইম চাকরি পেতে হলে এন৫ সার্টিফিকেট পাওয়া খুবই দরকার। জাপানি ভাষার ওপর প্রাথমিক দক্ষতার প্রমাণ হচ্ছে এই সার্টিফিকেট।'

জাপান সরকার সম্পূর্ণ অর্থায়নের প্রোগ্রামও দিয়ে থাকে, যা এমইএক্সটি নামে পরিচিত। এমইএক্সটি এমন একটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম, যা জাপানে পড়াশুনার সব খরচ বহন করে।

দুইভাবে এমইএক্সটি স্কলারশিপের জন্য আবেদন করা যায়। দূতাবাসের মাধ্যমে এমইএক্সটি স্কলারশিপের আবেদন করা হলে জাপানি দূতাবাস এই বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আবেদন করা হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ই নির্ধারণ করে যে কারা এই স্কলারশিপ পাবে।

জাপানি দূতাবাসের ওয়েবসাইটে স্কলারশিপের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।

এ ছাড়া, জাপান স্টুডেন্ট সার্ভিস অর্গানাইজেশনের (জেএএসএসও) মতো সংস্থাও জাপানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রার খরচ মেটানোর জন্য সহযোগিতা করতে আর্থিক সহায়তার আকারে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এমনকি, দেশটির স্থানীয় সরকারগুলো তাদের জেলায় বসবাসকারী এবং তাদের জেলায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিয়ে থাকে।

জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া মোটামুটি সহজ। এর জন্য ও লেভেল এবং এ লেভেলের কিংবা এসএসসি এবং এইচএসসির ট্রান্সক্রিপ্ট প্রয়োজন হবে। সেইসঙ্গে প্রয়োজন হবে ইংরেজি দক্ষতা পরীক্ষার স্কোরও—আইইএলটিএস বা টোফেল বা ডুয়োলিংগো। স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট স্কোর—যেমন: এসএটি বা এসিটি—গ্রহণযোগ্য হলেও এগুলো সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।

সুপারিশের চিঠির জন্য বেশিরভাগ জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফরম্যাট আছে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য প্রবন্ধ লিখতে হবে এবং দুটি সুপারিশপত্র লাগবে।

এসব ঠিকঠাক থাকলে বেশিরভাগ স্কলারশিপের আবেদন প্রক্রিয়ায় টিকে যাওয়া সম্ভব। আবেদন প্রক্রিয়ার যেকোনো বিষয়ে জানার থাকলে ইমেইলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।

ফল'২৭ এ আবেদনকারী ফারহান সাদেক বলেন, 'জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের প্রক্রিয়া অবিশ্বাস্য রকমের সহজ। আমি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছি, সেখান থেকে ইমেইলের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। জাতীয় ছুটি না থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা আপনার ইমেইলের জবাব দিয়ে দেবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই।'

জাপানি সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা একটু কঠিন হতে পারে এবং এর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে।

রিটসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আনিকা চৌধুরী বলেন, 'আমি মনে করি, ভাষাগত কারণে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে। তাই জাপানি ভাষা শেখার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।'

তিনি বলেন, 'জাপানে পরিবহন ব্যবস্থা খুবই সুবিধাজনক হলেও, আপনাকে পুরো সিস্টেম সম্পর্কে জানতে হবে। তা না হলে আপনার কাছে বিষয়টি কঠিন মনে হবে। এখানকার খাবার এবং সংস্কৃতিও ভিন্ন। অবশ্য, অন্য যে দেশেই যাবেন সেখানেই এই সমস্যাটা থাকবে। তবে এটা অবশ্যই বলব যে এখানে আসার পর ধীরে ধীরে সবকিছুই সঙ্গেই মানিয়ে নেওয়া সম্ভব।'

একটি নতুন দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা। এ প্রসঙ্গে টোকিওর হোসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহির চৌধুরী বলেন, 'জাপানে জাতিগত বিষয় কোনো উদ্বেগের কারণ নয়। কারণ, জাপানিরা অতিথিপরায়ণ হিসেবে পরিচিত। আমি বলব, বসবাসের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাপান।'

তিনি বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ, আপনার যেকোনো জিনিস যদি জনবহুল কোনো জায়গায় ফেলে যান, তারপরও কয়েকঘণ্টা পর ফিরে এসেও সেটা সেখানেই পাবেন। চুরি বা পকেটমারের মতো ছোটখাটো অপরাধ জাপানে খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। যদি কোথাও চুরি হয়, সেটাকে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে দেখা হয়।'

মাহির চৌধুরী বলেন, 'জাপানের মতো দেশে বিদেশি হিসেবে থাকা একটু কঠিন হতে পারে, তবে তারা মোটেই খারাপ নয়। কাজের জন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া বা বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা প্রায়শই বিদেশিদের চেয়ে নিজ দেশের মানুষকে অগ্রাধিকার দেয়। এর কারণ হতে পারে, হয়তো তারা বিদেশিদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা পেয়েছে। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন এবং কোন এলাকায় থাকছেন, তার ওপর ভিত্তি করে জাপানে আপনার অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে।'

দিনশেষে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান, সেটা নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময় নিয়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করে রাখতে হবে।

শরীফ মাশরাফি বলেন, 'আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলবো, সামগ্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে হবে। আবেদন করার পর পুরো প্রক্রিয়ার সময়টাতে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে হবে এবং মাথা ঠান্ডা রেখে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।'

অনুবাদ: স্মিতা জাহান

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago