ড. ইউনূস প্রসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের অভিযোগের যে জবাব দিল ইউনূস সেন্টার

গ্রামীণ ব্যাংকের অভিযোগগুলোর জবাব তুলে ধরেছে ইউনূস সেন্টার।

শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। গত ২৬ মে দায়েরকৃত অভিযোগ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানান গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ।

আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণমাধ্যমের কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের অভিযোগগুলোর জবাব তুলে ধরেছে ইউনূস সেন্টার।

'অভিযোগ

নব্বইয়ের দশকে যখন ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, তখন চট্টগ্রামে অবস্থিত ড. ইউনূস ও তার পরিবারের মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজেস করপোরেশন লিমিটেডকে গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ম-কানুন না মেনে সাড়ে ৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

জবাব

প্যাকেজেস করপোরেশনের মালিকরা, অর্থাৎ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার পরিবারের কেউ গ্রামীণ ব্যাংকের থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো ইচ্ছা থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে কোনো চুক্তি করেননি। তারা  গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবহারের জন্য তাদের ছাপাখানা দিতে চেয়েছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংক সেটা গ্রহণ করেছিল। গ্রামীণ ব্যাংক এবং প্যাকেজেস করপোরেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে এটা খুব স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে প্যাকেজেসের মালিকরা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনো প্রকার আর্থিক সুবিধা—যেমন: লভ্যাংশের ভাগ, জমির ভাড়া, ভবন ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য  কোনো ধরনের অর্থ নেবে না; সবকিছু বিনামূল্যে দেওয়া হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদকালে এই ব্যবস্থা বহাল থাকবে।

এটা গ্রহণ করার পেছনে ব্যাংকের উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামীণ ব্যাংকের মুদ্রণ সামগ্রীর খরচ কমানো, মানসম্মত মুদ্রণ নিশ্চিত করা এবং সব মুদ্রণ সামগ্রীর সময়মতো ডেলিভারি নিশ্চিত করা। মালিকরা আক্ষরিক অর্থে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে বিনা আর্থিক সুবিধায় প্ল্যান্টটি হস্তান্তর করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রস্তাবটি অবহেলা করতে পারেনি, যেহেতু ব্যাংক তখন খুব দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল এবং মানসম্পন্ন মুদ্রণ সামগ্রীর দ্রুত সরবরাহের ব্যাপক প্রয়োজন ছিল। ইউনূস পরিবারের প্রিন্টিং প্ল্যান্ট সম্পূর্ণ বিনামূল্যে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব কোনো ধরণের আর্থিক বাধ্যবাধকতামুক্ত একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রস্তাব হিসেবে এসেছিল।

চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এবং প্যাকেজেসের প্ল্যান্ট ও সম্পত্তি গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করার পর প্যাকেজেস করপোরেশনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়। প্যাকেজেস করপোরেশন তখন থেকে আর তার মালিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মালিকদের সঙ্গে আর কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি।

এটি প্যাকেজেস করপোরেশনের একটি নতুন অধ্যায়, যেখানে মালিকরা আর্থিক বিষয়গুলোসহ কোম্পানির সব বিষয় থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরিয়ে ফেলেছিলেন।

এই নতুন অধ্যায়ে প্যাকেজেস কর্তৃক প্রাপ্ত কোনো ঋণ কোনোভাবেই কোম্পানির মালিকদের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। ঋণ নেওয়া হলে সেটা হবে গ্রামীণ ব্যাংকের নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরীণ আর্থিক লেনদেন। চুক্তি অনুযায়ী, নতুন প্যাকেজসকে দেওয়া কোনো ঋণ মালিকদের কাছে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। এটি সবসময় গ্রামীণ ব্যাংক নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকবে—গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর প্রকল্পের মধ্যে, অথবা গ্রামীণ ব্যাংক দ্বারা মনোনীত কোনো সামাজিক ব্যবসার মধ্যে থাকবে। মালিকদের কাছে কোনোভাবেই যাবে না।

অতএব অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

এটি গ্রামীণ ব্যাংক চুক্তি-পরবর্তী পর্যায়ে মালিক সম্পৃক্ততা মুক্ত প্যাকেজেস করপোরেশনকে ঋণ দিয়েছে। তাও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নয়, দাতা সংস্থাগুলোর সমবেত আর্থিক সাহায্যে গঠিত এসভিসিএফ (সোশ্যাল বিজনেস ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড) নামে পরিচিত সামাজিক ব্যবসা তহবিল থেকে ঋণ এসেছে। সামাজিক ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য দাতাদের অর্থায়নে এসভিসিএফ তৈরি করা হয়েছিল।

অভিযোগ

ড. ইউনূস ও তার পরিবার ব্যাংকের কোটি কোটি টাকার প্রিন্টিং সামগ্রী চড়া দামে ছাপানোর জন্য পারিবারিক কোম্পানিকে কার্যাদেশ দিয়ে বিপুল আর্থিক সুবিধা নেন।

জবাব

এই চুক্তি ২৫ বছর কার্যকর ছিল। এই ২৫ বছরে গ্রামীণ ব্যাংক প্যাকেজেসকে মোট ঋণ দিয়েছে ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

প্যাকেজেস করপোরেশনের মালিকরা, অর্থাৎ অধ্যাপক ইউনূস ও তার পরিবার গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেননি।

অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

গ্রামীণ ব্যাংক বা এর মনোনীত কোম্পানি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত প্যাকেজেস করপোরেশনকে মুদ্রণের আদেশ দেয়, যার সঙ্গে ইউনূস পরিবারের কোনো সম্পর্ক ছিল না। গ্রামীণ ব্যাংক ও প্যাকেজেস করপোরেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে এটা স্পষ্ট করা হয়েছিল যে প্যাকেজেস করপোরেশনের মালিকরা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনো প্রকার আর্থিক সুবিধা—যেমন: লাভের ভাগ, জমির ভাড়া, ভবন ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদির জন্য যেকোনো প্রকারের দেয় নেবেন না।

পুরো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামীণ ব্যাংকের মুদ্রণ সামগ্রীর খরচ কমানো, মানসম্মত মুদ্রণ নিশ্চিত করা এবং মুদ্রণ সামগ্রীর সময়মতো ডেলিভারি নিশ্চিত করা। মালিকরা আক্ষরিক অর্থে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে বিনা আর্থিক সুবিধায় প্রিন্টিং প্ল্যান্টটি ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করেছিলেন।

অভিযোগ

গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী, ব্যাংকের ঋণ সুবিধা ভূমিহীন দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের জন্য সীমাবদ্ধ। কিন্তু, ড. ইউনূস আইন ভঙ্গ করেন এবং তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজেস করপোরেশনকে ঋণ প্রদান করেন।

জবাব

প্রফেসর ইউনূস কোনো আইন ভঙ্গ করেননি।

প্যাকেজেস করপোরেশন দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় সৃষ্ট এসভিসিএফ তহবিল থেকে ঋণ পেয়েছিল।

গ্রামীণ ব্যাংক এবং প্যাকেজেস করপোরেশনের মধ্যে চুক্তি অনুসারে,  প্যাকেজেস করপোরেশন যদি কোনো লাভ করে, মালিক পক্ষ কখনই সেই লাভের কোনো অংশ পাবে না। চুক্তিকালে প্যাকেজেস করপোরেশন কখনই কোনো লাভ করেনি। কারণ, মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকের মূল্য নির্ধারণী কমিটি কঠোরভাবে কাজ করতো। মূল্য নির্ধারণ কমিটি যে মূল্য নির্ধারণ করতো, তা সবসময় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম থাকতো।

অভিযোগ

যখন প্যাকেজেস করপোরেশন ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন ড. ইউনূস ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং নিজ পরিবারকে লাভবান করার জন্য ব্যাংকের কাছ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ মওকুফ করেন।

জবাব

ইউনূস পরিবার প্যাকেজেস করপোরেশনের আর্থিক বিষয়ে জড়িত ছিল না। মালিকপক্ষ কোনো ঋণ নেয়নি। কাজেই মওকুফ করার প্রশ্নও আসে না। চুক্তির ২৫ বছর মেয়াদকালে গ্রামীণ ব্যাংক মোট ঋণ দিয়েছে ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে যে অনাদায়ী টাকা মওকুফের কথা বলা হচ্ছে, তার পরিমাণ হচ্ছে ৭ লাখ ২২ হাজার টাকা।

ইউনূস পরিবারকে সুবিধা দিতে ব্যাংকের 'উল্লেখযোগ্য পরিমাণ' অর্থ মওকুফ করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগটি ভিত্তিহীন।

অভিযোগ

পরিচালনা পর্ষদকে না জানিয়ে ড. ইউনূস প্যাকেজ করপোরেশনের সঙ্গে একটি 'ম্যানেজিং এজেন্ট' চুক্তিতে প্রবেশ করেন, যা ব্যাংকের সুবিধার বিরুদ্ধে ছিল। এ ছাড়া, তিনি ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্যাকেজেস করপোরেশনে নিয়োগ দেন এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের অফিস বিনামূল্যে ব্যবহার করেন।

জবাব

প্যাকেজেস করপোরেশনের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক যে ব্যবস্থাই করুক না কেন, তা গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের দ্বারা করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের একাধিক বোর্ড সভায় চুক্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বোর্ড এই চুক্তি  বাস্তবায়নে আগ্রহ সহকারে সহযোগিতা করেছে।

গ্রামীণ ব্যাংক যখন মুদ্রণের এই বৃহৎ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নেয় এবং সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি শাখায় সঠিক সময়ে, সঠিক মুদ্রণ সামগ্রী, সঠিক পরিমাণে সরবরাহ করে, তখন গ্রামীণ ব্যাংক তার কয়েকজন কর্মীকে এই কাজ করার দায়িত্ব দেয়।

সেটা ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের সম্প্রসারণ পর্বের ব্যস্ততম সময়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পাঁচশ শাখা থেকে এক হাজার শাখায় উন্নীত করার কর্মসূচি নিয়ে এগুচ্ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। দেশের দূরদূরান্তে তখন শাখা স্থাপন করা হচ্ছিলো। সঠিক সময়ে সঠিক ফরম, লেজার, পাসবই, সঠিক পরিমাণে পৌঁছানো একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ ছিল। তার জন্য দক্ষ সহকর্মীর প্রয়োজন ছিল এবং গ্রামীণ ব্যাংক তাদের নিয়োজিত করেছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের অফিস ও প্যাকেজেসের অফিসে তারা কাজ করেছে। প্যাকেজেসের অফিস তারা নিজেদের অফিস হিসেবেই গণ্য করেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Ex-president Badruddoza Chowdhury passes away

He breathed his last at 3:15am today while undergoing treatment at the Uttara Women’s Medical College

54m ago