‘১৯৭০ সালের পর এমন জলোচ্ছ্বাস দেখেনি মনপুরাবাসী’
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল গত রোববার রাতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। দীর্ঘ সময় নিয়ে এটি উপকূল অতিক্রম করে। এ সময় তিনটি জোয়ারের প্রভাবে ১০-১২ ফুট স্ফীত জলোচ্ছ্বাস হয় ভোলায়।
ভাটায় পানি না নামায় জোয়ারের উচ্চতা ১২ ফুট ছাড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
মনপুরা দ্বীপের বাসিন্দারা ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এমন জলোচ্ছ্বাস দেখেননি বলে জানিয়েছেন মনপুরার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
বরিশাল বিভাগের ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বরিশাল বিভাগে নয় জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়।
এর মধ্যে বরিশাল জেলা সদরে দুই জন, বাকেরগঞ্জে একজন, পটুয়াখালীর বাউফল, কলাপাড়া ও দুমকী উপজেলায় একজন করে মোট তিন জন, ভোলার লালমোহন, দৌলতখান ও বোরহান উদ্দিন উপজেলায় একজন করে মোট তিন জন মারা গেছেন।
তাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে গাছ চাপায় কিংবা প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে।
তাদের মধ্যে বরিশাল সদর উপজেলার রুপাতলীর লোকমান হোটেলের মালিক লোকমান ও কর্মচারী মোকছেদ মারা গেছেন হোটেলটির দেয়াল ধসে।
বরিশাল বিভাগে ৪ হাজার ২টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ২ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ঘূর্ণিঝড়ে বিভাগের অন্তত ১২০টি পয়েন্টের ২০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শুধু পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ৪০-৪৫টি পয়েন্টে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এখনো বিচ্ছিন্ন ও পানিবন্দি আছেন বিভিন্ন উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ।
বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় জানায়, রোববার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত বিভাগের বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। সেইসঙ্গে বন্ধ থাকে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে এই প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় পুরো চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বরিশাল
জেলায় দুর্গত ইউনিয়ন ৯৫টি, দুর্গত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজার। জেলার ২৫৫টি বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ২ হাজার ৪৬৭টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
উজিরপুর উপজেলার সাতলা বাগদা বাঁধের মাত্র ৫টি পয়েন্টে ২৫ মিটার সম্পূর্ণ ও ১২০ মিটার আংশিক ভেঙেছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন অলীদ ডেইলি স্টারকে জানান, বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। ১০-১২ ফুট উচ্চতার এই বাঁধের কিছু অংশ ধসে যাওয়ায় মানুষের ক্ষতি হয়েছে।
উজিরপুর হারতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অমল বেপারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাতলা বাগদা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।'
বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ-১ এর কর্মকর্তা জিম হুমায়ন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, শুধু বরিশাল জেলার ৫টি উপজেলার ১১টি সাব-স্টেশনের মধ্যে মাত্র ৩টি স্টেশন চালু করা গেছে।
তিনি জানান, গত ৩৬ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। ঝড়ে অন্তত ১০০ খুঁটি ভেঙে গেছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা।
বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার সাদিকুর রহমান জানান, তার আওতাধীন এলাকার ১৩টি সাব-স্টেশনের মধ্যে ৫টি চালু হয়েছে। মোট ২৭টি খুঁটি ভেঙে গেছে, ক্ষতি হয়েছে ১ কোটির টাকার বেশি।
ভোলা
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভোলায় এবার বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে, যা অতি সম্প্রতি আর দেখা যায়নি।
ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান ডেইলি স্টারকে জানান, পানি আর এক ফুট বাড়লে হয়ত ভোলা শহর তলিয়ে যেত।
তিনি জানান, জেলায় দুর্গত মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩২ হাজার। ৪৫ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া, ৫ হাজার ১০০ বাড়ি আংশিক ও ২ হাজার ৪৬৫টি বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯০টি ঘের ও ৬ হাজার পুকুর ভেসে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, এবারের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১০-১২ ফুট স্ফীত জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি দীর্ঘ সময় ধরে উপকূল অতিক্রম করায় তিনটি জোয়ারের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস আরও ভয়াবহ হয়েছে।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার বাসিন্দা শামসুদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমন পানির উচ্চতা সিডরেও দেখিনি। আমাদের পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে। জমির সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।'
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, জেলার ৩৫০ কিলোমিটার বাঁধের ৫ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া, ১৬৪ মিটার সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।
মনপুরা উপজেলার বেড়িবাঁধটি ১২টি পয়েন্টে মোট ১৬৪ মিটার ভেঙে গিয়ে ৯ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাসান মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এবারে পানির স্ফীতির কারণ পূর্ণিমা ও তিনটি জোয়ার। পূর্বমুখী বাতাস জলোচ্ছ্বাসকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। একেকটি ঢেউয়ের উচ্চতা ১ দশমিক ৮ মিটার পর্যন্ত ছিল, যা সিডরের চেয়েও বেশি।'
মনপুরা
প্রবল জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে মনপুরা উপজেলায়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জহিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন বাঁধ ভেঙে গেছে, তখন মানুষকে দুর্গত এলাকা থেকে উদ্ধার করছিলাম। গ্রামের মানুষ কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ১৯৭০ সালের পর এরকম পানি দেখলেন তারা।'
তিনি জানান, মনপুরার কলাতলি ইউনিয়নে মাত্র ৩টি আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু বাড়িঘরে ও বহুতল ভবনে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
মনপুরার ৮-১০ ফুট উচ্চতার বাঁধ কোনো কোনো জায়গায় উপচে, আবার কোথাও ভেঙে পানি ঢুকেছে বলে জানান ইউএনও।
তিনি বলেন, 'মনপুরা উপজেলার নিম্নাঞ্চল কোথাও কোথাও ৮ ফুট, কোথাও ১০ ফুট জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। উপজেলার অন্তত ২ হাজার ৩০০ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
Comments