দেওয়ান পরিবারের ৬৪ বছর আগলে রাখা গান ‘মা লো মা’

আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ/স্টার

বংশ পরম্পরায় লোকসংগীতের পালা গান করে আসছে দেওয়ান পরিবার। মানুষের সঙ্গে স্রষ্টা ও প্রকৃতির রহস্যের সংযোগ দেখা যায় তাদের গানে।

সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় মৌসুমে 'মা লো মা' পরিবেশন করে আধ্যাত্মিক সংগীতের জাদু তুলে ধরেছেন আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান। গানটি বাংলাদেশে ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ের শীর্ষে উঠে এসেছিল। বিশ্বজুড়ে ট্রেন্ডিংয়ের তালিকায় ছিল ৩০তম অবস্থানে।

খালেক দেওয়ানের লেখা ও প্রীতম হাসানের সুর করা 'মা লো মা' গানটিতে আদি ও আধুনিকের অপরূপ সংমিশ্রণ দেখা গেছে, যা মুক্তির অল্প সময়ের মধ্যেই দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।

দেওয়ান পরিবারের গানের ঐতিহ্যের সূচনা হয় আলেপ চান শাহের হাত ধরে। তিনি আলফু দেওয়ান নামে পরিচিত। তার দুই ছেলে- খালেক দেওয়ান ও মালেক দেওয়ান 'সওয়াল-জওয়াব' (প্রশ্ন ও উত্তর) এর মতো নাটকীয় ভঙ্গিমায় আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করে এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

বর্তমানে এই পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম তাদের সুরেলা কণ্ঠ এবং বেহালা, মন্দিরা ও ঢোলের ঐকতানে শ্রোতাদের মন জয় করে যাচ্ছেন। সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন দেওয়ান পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম, প্রবীণ শিল্পী আরিফ দেওয়ান ও উদীয়মান প্রতিভা সাগর দেওয়ান।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার স্টুডিওতে এসে দুই ভাই তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস, গানটির উৎস ও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।

আরিফ দেওয়ান বলেন, 'বিশ্বব্যাপী সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা কোনো বাধা নয়। 'মা লো মা' গানটি আমার দাদা খালেক দেওয়ানের, পাকিস্তান আমলে রেকর্ড করা গানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিয়ে ও বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রধান অংশ হয়ে ওঠে। এর সাম্প্রতিক সাফল্য পালাগানের প্রতি দর্শকদের আকর্ষণের প্রমাণ।' 

গানটির কোক স্টুডিও সংস্করণের মূলে আছে দুই দেওয়ান ভাইয়ের দারুণ সমন্বয়। আরিফ দেওয়ানের মূল সুরের সঙ্গে সাগর দেওয়ান আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটান।

সাগর জানান, ছোটবেলা থেকে এই গানটি তার জন্য অনেক তাৎপর্য বহন করে।

'আপনি যখনই সুরটি শুনবেন, শরীরে এক ধরনের শিহরণ জাগবে। সাথে ছন্দ ও তাল আপনাকে মুগ্ধ করবে, গানটির প্রেমে পড়ে যাবেন আপনি। 'মা লো মা, ঝি লো ঝি। বইন লো বইন, আমি করলাম কী'- এই দুটি লাইন আমার মনে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে,' বলেন তিনি।

গানটি সম্পর্কে সাগর আরও বলেন, 'গানটিতে মানুষের জীবন ও এর চক্রাকার প্রকৃতির প্রতিফলন দেখা যায়। যখন আমি থাকব না, তখনও আমার সৃষ্টি ও রেকর্ডগুলো থাকবে। এ ধরনের চিন্তা আমার মনে দীর্ঘদিন ধরেই আছে ও তখন থেকেই 'মা লো মা' এর প্রতি আমি গভীর ভালোবাসা অনুভব করি।'

ভক্তরা প্রায়ই জনপ্রিয় গানের রিমেকের বিরোধিতা করেন, তবে প্রীতম হাসানের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখেছেন আরিফ দেওয়ান।

আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান। ছবি: সংগৃহীত

প্রবীণ এই সংগীতশিল্পী বলেন 'রেকর্ডিংয়ের সময়, গানটির কম্পোজিশনের ব্যাপারে আমার একদমই ধারণা ছিল না। আমি শুধু নিজের অংশ অর্থাৎ বেহালা বাজানোর দিকে পুরো মনোযোগ দিয়েছি। পরে যখন গানটি শুনি, তখন দেখি আমার গলায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি, বিষয়টি ভালো লেগেছিল। মিউজিক ভিডিওতেও গানের নির্যাস ধরে রাখা হয়েছে, বেমানান কিছু ব্যবহার করা হয়নি। তাই আমার বিশ্বাস ছিল সবাই গানটি পছন্দ করবে।'

কোক স্টুডিওর এই সংস্করণ কীভাবে তৈরি হলো? সে এক মজার গল্প।

সাগর দীর্ঘদিন ধরেই গানটিতে নতুনত্ব আনার কথা ভাবছিলেন, তবে শিডিউল না মেলায় বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল রেকর্ডিং। 'টিমের সঙ্গে প্রীতম ভাই এই ছন্দটি বানিয়েছিলেন; গানটি শোনার পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন 'মা লো মা' তার কম্পোজিশনের সঙ্গে নিখুঁতভাবে যায়,' বলেন সাগর। 

তিনি আরও বলেন, 'আমার ছোটবেলায় ছাদ পেটানো গান বেশ জনপ্রিয় ছিল। চুন সুরকি দিয়ে ঘরবাড়ি সংস্কারের সময় শ্রমিকরা ছন্দে ছন্দে এই গান গাইতো।'

গানটির উৎস নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক দেখা দেয়। কোক স্টুডিও বাউল রশিদ উদ্দিনের লেখা 'মা গো মা' নামে আরেকটি সংস্করণের কথা উল্লেখ করে। তবে, নেত্রকোণার একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এর বিরোধিতা করে। তারা জানায় খালেক দেওয়ান গানটির আসল লেখক ও তাদের জেলা থেকেই গানটির উৎপত্তি।

এসব বিতর্ক উড়িয়ে দেন সাগরও। তিনি জানান, তাদের কাছে আসল রেকর্ডিংসহ আরও অনেক তথ্যসূত্র আছে যা প্রমাণ করে খালেক দেওয়ানই গানটির আসল লেখক।

'১৯৬০ সালে খালেক দেওয়ান 'মা লো মা' গানটি লেখেন, 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি)' মিউজিক কোম্পানির (বর্তমান সারেগামা) তত্ত্বাবধানে রেকর্ডিং করেন। তখন থেকে আমাদের পরিবার গানটি ও এর ইতিহাস ধরে রেখেছে। সম্প্রতি কোক স্টুডিওর সংস্করণের কারণে বিতর্ক দেখা দিয়েছে ও একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ আমাদের বিপক্ষে কাজ করছে' অভিযোগ করেন এই তরুণ শিল্পী।

তিনি বলেন, 'যারা এর বিরোধিতা করছেন, আপনাদের দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ দিন। ইমদাদুল হক মিলনের 'নুরজাহান' উপন্যাসে এই গানের কথা উল্লেখ আছে। এটি বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে। এই গানের একমাত্র স্বত্তাধিকারী খালেক দেওয়ান।'

কোক স্টুডিওর গান নিয়ে আলাপ করার সময় আরিফ বাংলাদেশের সংগীত জগতের বর্তমান দুর্দশা ও দেশজ সংস্কৃতিকে বিশ্বের বুকে প্রচার করতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্যোগের অভাব নিয়ে আক্ষেপ করেন।

'এ জীবনে যতটা ভালোবাসা ও সম্মান চেয়েছি, তা-ই পেয়েছি। তবে সংগীত জগতে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব ঘোচাতে আমি সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করব,' বলেন তিনি।

'একবার ভাবুন, প্রীতম হাসান যদি কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খানের সঙ্গে কাজ করতে পারতেন, তাহলে কী অসাধারণ কিছু তৈরি হতে পারতেন। বর্তমানে লোকজন শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা যদি সব ধরনের পরিবেশ থেকে উঠে আসা মেধার সঠিক মূল্যায়ন না করি, তাহলে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা কঠিন হবে,' গুণী এই লোকসংগীত শিল্পী বলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Fund crunch hits Rohingyas hard

A humanitarian crisis in Cox’s Bazar Rohingya camps is brewing in the face of funding shortage for the refugees and more arrivals from the conflict-ridden Rakhine state of Myanmar.

10h ago