বিসিএসের অপেক্ষায় অপচয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করার কয়েক মাস পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে ৪১তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন ইমাম হোসেন।

বিসিএস পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি ছিল তার। ২০২১ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত এমসিকিউভিত্তিক প্রাথমিক পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। ওই বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন তিনি। শুরু হয় ভাইভার জন্য অপেক্ষা।

সেই ভাইভা পরীক্ষা হয় দুই বছর পর, ২০২৩ সালে। চূড়ান্ত এই পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন ইমাম হোসেন।

তবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ইমাম ক্যাডার সার্ভিসে জায়গা করে নিতে পারেননি। তার নাম সুপারিশ করা হয় নন-ক্যাডার পদের জন্য। কিন্তু তিনি নন-ক্যাডার পদেও চাকরি পাননি। কারণ, এসব পদে নিয়োগ হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া চাহিদা সাপেক্ষে।

নন-ক্যাডার পদের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করে থাকার পর শেষ পর্যন্ত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন ইমাম।

তিনি বলেন, 'এত সময় যাওয়ার কারণে আমার অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে। আমার জীবনের চার বছরেরও বেশি সময় শেষ হয়ে গেছে অপেক্ষায় থেকে। বয়স ৩০ বছর পার হয়ে যাওয়ার কারণে অন্য কোনো সরকারি চাকরির জন্যও আর আবেদন করতে পারি না।'

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে এত বেশি সময় লাগা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

৪১তম বিসিএস পরীক্ষা শেষ করতে চার বছর চার মাস সময় নিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।

করোনা মহামারির সময়ে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৪২তম বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিল শুধুমাত্র চিকিৎসকদের জন্য। বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে গেজেট প্রকাশ—সবকিছুই শেষ হয় এক বছরের মধ্যে। এই বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে প্রায় চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ পান।

এরপর ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতেই সময় লেগেছে তিন বছর এক মাস। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখনো এই পরীক্ষার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি।

পিএসসির ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সাংবিধানিক সংস্থাটি বিসিএস পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়াটি এক বছরে সম্পূর্ণ করার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিল। সেই রোডম্যাপ কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এই পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা তাদের কর্মজীবনের অন্তত চারটি বছর নষ্ট করেন।

পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন এই দেরির বিষয়ে সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, 'আমরা এক বছরের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।'

রোডম্যাপ অনুযায়ী ১২ মাসের মধ্যে বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত সব কাজ শেষ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

যারা শেষ পরীক্ষাতেও সফল হন, তাদেরও অপেক্ষায় থাকতে হয়—মেডিকেল পরীক্ষা এবং পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার নিরাপত্তা ছাড়পত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং গেজেট প্রকাশ হতে প্রায় এক বছর সময় লাগে।

কেন এই দেরি

পিএসসি সদস্যরা বলছেন, তাদের জনবল সীমিত। এই কারণে প্রশ্নপত্র তৈরি ও মুদ্রণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং ভাইভাসহ বেশিরভাগ কাজের জন্য তাদেরকে অন্যদের ওপর নির্ভর করতে হয়।

পিএসসির এক সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেরি হওয়ার একটি কারণ হলো পরীক্ষকদের (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও আমলা) উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে দেরিতে জমা দেওয়া। এ ছাড়া, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উত্তরপত্র তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। ফলে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে আরও দেরি হয়।'

পিএসসি উত্তরপত্র মূল্যায়নে 'স্বচ্ছতা' নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালে দ্বৈত পরীক্ষকের বিধান চালু করে। এর ফলে প্রতিটি উত্তরপত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক মূল্যায়ন করেন। ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে এই ব্যবস্থা কার্যকর হয়।

এর পরের বছর পিএসসি আরেকটি পদ্ধতি চালু করে, যেখানে দুই পরীক্ষকের দেওয়া নম্বরের মধ্যে ২০ শতাংশ বা তার বেশি পার্থক্য থাকলে উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়নের জন্য তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়।

৪৪তম বিসিএসের ক্ষেত্রে প্রথম দুই পরীক্ষকের দেওয়া নম্বরের পার্থক্যের কারণে ১৫ হাজার ৭০৮টির মধ্যে ৯ হাজারের বেশি উত্তরপত্র তৃতীয় পরীক্ষকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে জানান পিএসসি সদস্যরা।

তিনি বলেন, 'সময়মতো উত্তরপত্র জমা দেওয়ার জন্য আমরা বারবার অনুরোধ করলেও অনেক পরীক্ষক বিভিন্ন অজুহাতে দেরি করে দেন। তারা সম্মানিত মানুষ হওয়ায় আমরা কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারি না। তাদের কারণেই পিএসসি সমস্যায় পড়েছে।'

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়াও কিছু আমলা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। তারা শুধুমাত্র কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স মূল্যায়ন করেন।

বিসিএসের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা দুই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের নিয়মিত লেকচার, পরীক্ষা ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মূল্যায়ন নিয়েই প্রচুর ব্যস্ত থাকেন। তাদের অনেককে আবার প্রশাসনিক কাজও করতে হয়। ফলে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মূল্যায়নের সময় বা আগ্রহ তাদের নেই।

এ ছাড়া, এই কাজের জন্য পিএসসি যে পারিশ্রমিক দেয় তা খুবই সামান্য। ফলে, শিক্ষকরা এসব উত্তরপত্র মূল্যায়নে খুব কমই আগ্রহ দেখান।

গড়ে প্রত্যেক শিক্ষককে ১০০ থেকে ১২০টি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে হয়।

গোলকধাঁধা

৪৩তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশকৃত ১৫ প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের প্রত্যেকেই বলেছে যে পরীক্ষার জন্য কোচিং, থাকা-খাওয়া এবং যাতায়াতের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়।

দীর্ঘ সময় লেগে গেলে আর্থিক চাপ বেড়ে যায় এবং তারা এক ধরনের গোলকধাঁধায় থাকেন। কারণ, বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত তারা তাদের কর্মজীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

৪৩তম বিসিএসে চাকরিপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, 'পিএসসি এত সময় নিলেও আমি হঠাৎ করেই কোর্স পরিবর্তন করে অন্য চাকরি খুঁজতে পারি না। ফলাফল যদি তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতো তাহলে আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে পারতাম।'

এই অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তার বাসা ভাড়া এবং খাবার খরচ দুটোই বেড়ে গেছে।

মাহমুদুল বলেন, 'আমিও মেস ছেড়ে চলে যাই তাহলে পড়াশুনা ব্যাহত হবে। প্রাইভেট টিউশন করিয়েও সব খরচ মেটানো কঠিন।'

করণীয় কী

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দ্বৈত পরীক্ষকের বিধান চালু করা দেরি হওয়ার একটি বড় কারণ, বিশেষ করে যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেওয়ার মতো পরীক্ষকের অভাব থাকে।

তার মতে, এই নিয়ম 'আপাতদৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত', কিন্তু মাত্র কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসিএস উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট যোগ্য শিক্ষক রয়েছেন।

তিনি জানান, পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং মেডিকেল পরীক্ষার জন্য যে সময় লাগে সেটাও বেশ দীর্ঘ।

বর্তমানে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে প্রায় এক বছর সময় লাগে।

সাবেক এই সচিব বলেন, 'এটা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে করা যেতে পারে। আগে এমনই ছিল। সেই পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া উচিত। যেটা দরকার সেটা হলো চাকরিপ্রার্থীরা ফৌজদারি মামলার আসামি কি না, সেটা যাচাই করা।'

তার মতে, বর্তমানে এই যাচাই প্রক্রিয়ায় চাকরিপ্রার্থীদের আত্মীয়দের ব্যাকগ্রাউন্ড ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেখা হয়, যা অপ্রয়োজনীয়।

এ ছাড়া, অনেক সুপারিশকৃত প্রার্থীও তাদের আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বাদ পড়ে যান।

তিনি বলেন, 'ভারতে যাচাই চলাকালীন সময়েও চাকরিপ্রার্থীদের সুপারিশের ভিত্তিতে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাছাড়া, ওখানে অন্যান্য বিষয়ে (আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক সম্পর্ক) ফোকাস করে না।'

Comments