‘এটা কৃত্রিম বৃষ্টি নয়, এভাবে পানি ছিটানোয় অস্বস্তি আরও বাড়বে’

গত শনিবার আগারগাঁওয়ের রাস্তায় শিশুদের নিয়ে ‘স্প্রে ক্যাননের পানি’তে ভিজছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। ছবি: ডিএনসিসির সৌজন্যে

তীব্র তাপপ্রবাহে সারাদেশে জনজীবন যখন প্রায় ওষ্ঠাগত, তখন ঢাকার রাস্তায় স্প্রে ক্যানন দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

গত শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের রাস্তায় এই 'স্প্রে ক্যাননের পানি'তে ভিজতে ভিজতে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, 'চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের পরামর্শে চলমান প্রচণ্ড দাবদাহে জনগণকে স্বস্তি দিতে কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে।'

তবে প্রশ্ন উঠেছে, নেদারল্যান্ডসের তৈরি ১৩ কোটি টাকার এই 'স্প্রে ক্যানন' কি 'কৃত্রিম বৃষ্টি' তৈরি করছে বা কথিত এই 'কৃত্রিম বৃষ্টি' কি তাপপ্রবাহ কমাতে আদৌ কার্যকর কিংবা জনগণকে স্বস্তি দিতে সক্ষম?

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। ছবি: সংগৃহীত

বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ এবং বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

এই দুজনেরই ভাষ্য, 'স্প্রে ক্যাননের সাহায্যে যে পানি ছিটানো হচ্ছে, এটি কৃত্রিম বৃষ্টি নয়। এই পদ্ধতি গরম থেকে পরিত্রাণ দেবে না। বরং এতে অস্বস্তি আরও বাড়তে পারে। পানি ছিটিয়ে তাপপ্রবাহ কমানোর কোনো সুযোগ নেই।'

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'ডিএনসিসি মেয়র কেন কৃত্রিম বৃষ্টির কথা বলেছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। এটা বিজ্ঞানভিত্তিক না। আমরা যারা বিজ্ঞান পড়ি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন জিনিস বুঝতে পারি, তাদের কাছে এটা পরিষ্কার যে এর মাধ্যমে পরিবেশ ঠান্ডা হবে না, তাপ কমবে না, বরং অস্বস্তি বাড়বে।'

তিনি বলেন, 'কেননা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত হলো মেঘকে ঘনীভূত করে বৃষ্টি তৈরি করা, যা মধ্যপ্রাচ্য ও চীনে হয়েছে। তবে আমাদের এখানে যে পানি ছিটানো হচ্ছে, এতে বাতাসে আরও দ্রুত বাষ্প তৈরি হবে। এমনিতেই এখানে উচ্চ জলীয়বাষ্প, পানি ছিটানোর ফলে জলীয়বাষ্প আরও কিছুটা যুক্ত হয়ে অস্বস্তি বাড়াতে পারে।'

'ঢাকার যে মারাত্মক বায়ুদূষণ, পানি ছিটানোতে সেই দূষণ কিছুটা কমতে পারে। তবে বাস্তবে এর মাধ্যমে পরিবেশ ঠান্ডা করা যাবে না, এমনকি মানুষের স্বস্তিও বাড়ানো যাবে না। বরং এই গরমে রিকশাচালক বা দিনমজুরদের ছাতা বিতরণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ ভালো উদ্যোগ, এগুলোকে সাধুবাদ জানাই', বলেন তিনি।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, 'আমাদের দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগে যেতে হবে। আগামী বর্ষাকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, সেসময় প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। যেসব লেক আছে সেগুলোর পাড়ে আরও গাছ লাগাতে হবে, যাতে ঘন সবুজ বেষ্টনী তৈরি হয়। হাতিরঝিলের সবুজ আরও বাড়ানোর জন্য পরিবেশবিদ ও বৃক্ষ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে একটি কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। হঠাৎ করে গাছ লাগালে হবে না। রীতিমত পরিকল্পনা করে ঢাকায় গাছ লাগাতে হবে।'

'বিশেষ করে বনাঞ্চল যাতে বাড়ে, গাছগুলো যেন ঢাকার বায়ুদূষণ, আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এর আগে আমরা দেখেছি যে বিভিন্ন সময় সড়ক বিভাজকে যেসব গাছ লাগানো হয়েছিল, সেগুলো গাড়ির কালো ধোঁয়ায় মরে যেত, ঠিকমতো বাড়ত না। ফলে সে ধরনের গাছ আর লাগানো যাবে না। এমন গাছ লাগাতে হবে, যেগুলো এই বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে পারে', বলেন তিনি।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির বহুল ব্যবহারের কারণে আমাদের শহরগুলো দিনে দিনে 'হিট আইল্যান্ডে' পরিণত হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'এসি যাতে কম ব্যবহৃত হয়, সেরকম কিছু কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এসি যেন কোনোমতেই ২৬ ডিগ্রির নিচে ব্যবহার না করা হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় থাকবে, গাড়ি যেন আর না বাড়ে। মেট্রোরেলের মতো পরিবহন আরও বাড়াতে হবে।'

'আমাদের মেনে নিতে হবে যে আগামী বহুদিন তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়বে অথবা এরকম বেশিই থাকবে। কাজেই সেই সময়ে আমরা যাতে টিকে থাকতে পারি, আমাদের উন্নয়ন যাতে ব্যাহত না হয়, মানুষের স্বাস্থ্য-উপার্জন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়—এসব বিষয় মাথায় রেখে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে', বলেন তিনি।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'এখন আমরা সবাই জানি যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী। সুতরাং একে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। টেকনিক্যালি সাউন্ড কোনো ব্যবস্থা না নিলে সেটা কার্যকর হয় না।'

নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, 'আমাদের সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবো কোথা। যে সিটি করপোরেশনে পেশাজীবী ও পরিবেশবিদরা বিনা পারিশ্রমিকে জরুরিভিত্তিতে তিন বছর কাজ করে সবুজায়ন নীতিমালা তৈরি করে দিলেন, সেটাকে বাস্তবায়ন না করে এই পানি ছিটানোর কাল্পনিক স্বপ্নের জায়গা তৈরি করার মধ্য দিয়ে জনতুষ্টির একটি ছবি তৈরি করা যায়, কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছানো যায় না।'

'আমি বিষয়টিকে খাটো করে দেখছি না, তবে প্রতীকীভাবে দেখছি এইজন্য যে এই তোলা দুধে পোলা বাঁচবে না। প্রথমত: তাপমাত্রা নিরসনের এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলো বিত্তবানদের এলাকাগুলোতে বাস্তবায়ন না করে বস্তি, ঘনবসতিপূর্ণ নিম্নবিত্ত মানুষের এলাকায় করা হোক। কেননা এই মুহূর্তে এসব অঞ্চলের মানুষেরাই বাঁচার জন্য বেশি হাঁসফাঁস করছে। দ্বিতীয়ত: সবুজায়ন নীতিমালা আগামী এক-দুই বছরে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে কাজে নেমে যাওয়াটা জরুরি।'

এই নগরপরিকল্পনাবিদ বলেন, 'অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী কয়েকটি দেশ ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর চেষ্টা করছে। তবে এর যে প্রতিঘাত, যাতে আজ তারা পর্যুদস্ত। তাই বলি—পরিবেশ, প্রকৃতিকে আর খোঁচাবেন না। প্রকৃতিকে জয় করার মানসিকতায়, প্রকৃতিকে আঘাত ও পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে যে অভিঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আজকের পৃথিবী প্রকম্পিত। বরং প্রকৃতি-পরিবেশবান্ধব সমাধানই হচ্ছে এখান থেকে বেরিয়ে আসার বা উত্তরণের একমাত্র পথ। এই ক্লাউড সিডিং প্রোগ্রামগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গত কয়েকদিনে যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, সেজন্য তারা প্রস্তুত না থাকায় যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, সেটি এই মুহূর্তে ওই দেশগুলোও সহ্য করতে পারছে না।'

'উপরন্তু এই সিডিং করতে গিয়ে যে বিলিয়ন ডলার খরচ করার সামর্থ্য, সেটিও আমাদের নেই। আমাদের প্রাধিকারে আরও অনেক অভাব রয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে চাই যে, এ ধরনের উদ্ভট চিন্তা থেকে বেরিয়ে প্রকৃতিগত সমাধানের যে সুযোগ আমাদের মতো দেশে রয়েছে—যেখানে বীজ ফেললেই গাছ হয়, বছরে অনেকটা সময় বৃষ্টি হয়, যে পানি আমরা ব্যবহার করতে পারি না, অল্পখরচে সবুজের যে সমারোহ তৈরি করা সম্ভব, সেই উদ্যোগও আমরা নিচ্ছি না। বরং গাছ কাটার মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ অভিযানের বিকল্প তৈরির চেষ্টা করছি, সেখানে এই ধরনের অলীক চিন্তাগুলো অনেক অনেক দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা দরকার', বলেন তিনি।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, 'আর এই সিডিংয়ের যে চিন্তা, এটি অত্যন্ত অ-প্রকৃতিবান্ধব এবং এর ফলে যে প্রতিঘাত, তার ছবি ইতোমধ্যে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখেছি। আমাদের পক্ষে এটি করার জন্য বিলিয়ন ডলারও নেই এবং এর প্রতিঘাত সহ্য করার মতো সামর্থ্যও আমাদের নেই। কেননা আমাদের অতি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ওই ধরনের ঘটনা ঘটলে অজস্র প্রাণহানি হবে।'

'আমি এখনো মনে করি, পানি ছিটিয়ে তাপপ্রবাহ কমানোর কোনো সুযোগ নেই, কিছুটা প্রশমিত হতে পারে ক্ষণিকের জন্য। বরং এটি বস্তিবাসী, অতি ঘনত্বের নিম্নবিত্ত মানুষের যে জায়গা, যেখানে মানুষ জমায়েত হতে বাধ্য হচ্ছে, হাট-বাজার, সেখানে মানুষের কষ্ট লাগবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতেই পারে না', বলেন তিনি।

এই নগরপরিকল্পনাবিদ মনে করেন, সবুজায়ন নীতিমালার আওতায় প্রথমেই ছায়া সম্বলিত, ভেষজ, ফলজ ও ঔষধি এবং প্রকৃতিবান্ধব তথা পাখি, প্রজাপতিবান্ধব গাছ জরুরি-ভিত্তিতে লাগানো, সড়কের প্রশস্ততা কমিয়ে ফুটপাত বাড়িয়ে বৃক্ষশোভিত, ছায়া আচ্ছাদিত নগরীকে আবার পুনরুদ্ধার করার মধ্য দিয়ে এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও নগর বন এবং সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সেইসঙ্গে জলাধার ও খালগুলো উদ্ধার করে পরিবেশের একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করাই আমাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং আশু করণীয় কাজ।'

স্থপতি ইকবাল হাবিবের ভাষ্য, 'আমাদের বিদেশিভাবাপন্নতা, লোকরঞ্জনবাদ, মানুষকে দেখানো এবং অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্য প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে মেকি উন্নয়ন প্রদর্শন করার যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, তার বদলে টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে একমাত্র উন্নয়নের ধারণা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এখনো ব্যর্থ হচ্ছি, আমাদের সেখানে ফেরত যেতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

1h ago