নিত্যপণ্যের বাজার কতটা প্রতিযোগিতামূলক, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

নিত্যপণ্যের দাম
পবিত্র রমজানেও ক্রেতারা নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পাননি। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

দেশের বাজারে গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তাদের মধ্যে `সিন্ডিকেট' শব্দটি নিয়ে এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে। এজন্য তারা সবসময় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতাকে দোষারোপ করে আসছেন।

উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা যেতে পারে পেঁয়াজের কথা।

২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে দেশের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুত করতে শুরু করে। ফলে গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে রাতারাতি প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম প্রায় ১০০ টাকা বেড়ে যায়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশের বাজারে অভিযান চালায় সরকারি সংস্থা এবং অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। পরে পেঁয়াজের দাম কমে যায়।

এরপর সাম্প্রতিক সময়ে আলু, মুরগি, গরুর মাংস, ডিম, ভোজ্যতেল, চিনি- এমনকি রমজানের শুরুতে হঠাৎ করে খেজুরের দামও বেড়ে যায়। ভালো মানের খেজুরের দাম রীতিমতো অনেক ভোক্তার ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়।

ভোক্তাদের দাবি, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এভাবে নানা সময়ে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

বাজার বিশ্লেষকরাও ভোক্তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তারা বলছেন, বাজারে প্রতিযোগিতার অভাবের কারণে এমনটা হচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে দেশের বাজারে এক ধরনের "অলিগোপলি" কাজ করছে।'

'কিছু কিছু বড় কোম্পানির কারণে বাজারে প্রতিযোগিতা দিন দিন কমছে। ফলে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাজার থেকে বিতাড়িত হয়েছেন,' বলেন তিনি।

আগের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'কিছু ব্যবসায়ী ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদা ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে পণ্য আমদানি করছেন।'

'তাই বলা যায়, বাস্তবে মাত্র চার থেকে পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে, অথচ নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে- বাজারে অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন', যোগ করেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, 'ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়।'

তার পরামর্শ, 'সরকারের উচিত এসব দিকে নজর দেওয়া, যেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রবেশে কোনো সমস্যার মুখে না পড়েন।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় কার্যকরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

তিনি অভিযোগ করেন, 'কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী প্রতিযোগিতা-বিরোধী আচরণের সঙ্গে জড়িত, এজন্য তারা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে থাকে।'

সেলিম রায়হানের মন্তব্য, 'এ কারণে সরকার কখনোই তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয় না।'

সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বড় করপোরেটের বিপরীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা চলমান মার্কিন ডলার সংকটের মুখে আমদানি অব্যাহত রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

তার ভাষ্য, 'ফলে এসব বড় কোম্পানি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর আরও আধিপত্য বিস্তার করছে, যা সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য মোটেও সহায়ক নয়।'

জানতে চাইলে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, প্রযুক্তির অগ্রগতি বৃহত্তর উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সামগ্রিক উপকরণের ব্যয় কমাতে সহায়তা করেছে।

'ফলে বাজারে বড় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতির কারণে ভোজ্যতেলের গড় দাম তুলনামূলক কম রাখা হচ্ছে', বলেন তিনি।

তাই বড় কোম্পানিগুলো তাদের বিক্রির পরিমাণ থেকে ভালো লাভ করে, প্রতি ইউনিট মূল্য থেকে নয় জানিয়ে এনামুল হক বলেন, 'সুতরাং আমরা যদি বড় রিফাইনারিগুলো বন্ধ করে দিই, তাহলে ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে।'

তিনি মনে করেন, প্রধান পণ্যগুলোর প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো যোগসাজশ হয়নি।

এনামুল হকের ভাষ্য, 'তাই আমরা বলতে পারি, যখন প্রত্যেক কোম্পানির বাজার শেয়ার বেশ কয়েক বছর ধরে স্থির থাকে, তখন আঁতাত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বাজার শেয়ার স্থির নয়। সুতরাং এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, এখানে আঁতাত হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'নতুন নতুন কোম্পানি বাজারে প্রবেশ করছে, তবে আমাদের মতো ক্রমবর্ধমান বাজারে যোগসাজশ করা কঠিন।'

স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ ও দেশের বৃহত্তম কৃষি প্রক্রিয়াজাতকারী প্রাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোজ্যতেল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা স্থাপন করেছে।

অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, বিভিন্ন কারণে বাজার প্রতিযোগিতায় প্রভাব পড়তে পারে। তাই কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা-বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে প্রতিযোগিতা আইন প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ।

পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান।

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে সিপিডি বলেছিল, কার্টেল বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনের শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত এবং যোগসাজশের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলতে হবে।

তারা আরও বলেছিল, প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ সংশোধন করে একচেটিয়া ব্যবসা মোকাবিলা করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট আইন লঙ্ঘনকারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট জরিমানা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম বলেন, 'কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে যেকোনো সরকারি সংস্থার পলিসি সাপোর্ট, অবকাঠামো, বাজেট ও দক্ষ জনবল এই চারটি জিনিস থাকতে হয়। কিন্তু প্রতিযোগিতা কমিশনের ক্ষেত্রে চারটিতেই মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। ফলে কমিশন আশানুরূপ ফল দিতে পারছে না।'

তিনি বাজার প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

প্রতিযোগিতা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তারা একমত।

তিনি জানান, কমিশনকে সব দিক থেকে শক্তিশালী করতে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, বলেন তিনি।

চক্রবর্তী আরও বলেন, 'অর্থ বিভাগ মনে করে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় কমিশনকে শক্তিশালী করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

প্রতিযোগিতা কমিশনের এত দিনের প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কমিশনে অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু মামলা জরিমানাসহ নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং অন্যগুলো আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিলের জন্য নেওয়া হয়েছে। বাকি কিছু মামলা শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।'

Comments