বিপজ্জনক অধ্যায়ে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ

ইসরায়েলের ভূমিকা কী হবে? ইরানের মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা কী হবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেন—হোয়াইট হাউসের ভূমিকা নিয়ে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়ার মতে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে—প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অবস্থা যেন মারিও পুজোর বিখ্যাত উপন্যাসের সেই 'গডফাদার' ভিটো কর্লিওনির মতো।

অনাথ সিসিলিয়ান থেকে পরাক্রমশালী মাফিয়া সাম্রাজ্যের প্রধান পুরুষ হয়ে ওঠা ওই গডফাদারকে একসময় আক্ষেপের সুরে বলতে শোনা যায়—'যতই চাচ্ছি সংঘাত থেকে দূরে সরে থাকতে, ততই ওরা সংঘাতের ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছে।'

উল্লিখিত উপন্যাসের পাঠক বা এই উপন্যাস নিয়ে তৈরি সিনেমার দর্শক মাত্রই জানেন যে, 'সংঘাত' সৃষ্টি করে 'সংঘাত থেকে দূরে থাকার আশা' বৃথা। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে হত্যা-নির্যাতনের যে পথ বেছে নেওয়া হয়, সেই পাঁকে একসময় নিজেদেরই পা পড়ে।

বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়া সেই 'ফাঁদে পড়া' প্রবীণ গডফাদারের প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভেতর।

'বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়'

আজ বৃহস্পতিবার দুবাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলআরাবিয়ার শীর্ষ প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়, 'বাইডেনের আশঙ্কা ইসরায়েলে হামলা চালিয়েও ইরান টিকে গেলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে।'

এতে আরও বলা হয়, গতকাল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন লিখেছেন—'বন্ধুদের ত্যাগ করার সময় এখন নয়। কংগ্রেসকে অবশ্যই ইউক্রেন ও ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে এখনই আইন পাস করতে হবে। পাশাপাশি, ফিলিস্তিনের গাজায় জরুরি ত্রাণ সহায়তা দিতে হবে।'

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, 'ইসরায়েলে হামলা চালিয়েও যদি ইরান টিকে যায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এতে (যুদ্ধে) জড়িয়ে পড়তে পারে।'

ইসরায়েলের নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের মুখ বুজে থাকাটা 'অচিন্তনীয়' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে গত রোববার প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস'র সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়—সরাসরি হামলার মধ্য দিয়ে ইরান ও ইসরায়েলে—এই দুই পুরোনো শত্রুর এক 'বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়ের' সূচনা হলো। এতে আরও বলা হয়, যদিও বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে ইরান চায়নি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ুক। তবে এ কথা সত্য যে, এখন থেকে দেশ দুটি সরাসরি হামলার পথকেই বেছে নেবে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলি ভায়েজ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'ইরান সরকারকে দেখে মনে হচ্ছে দামেস্ক মিশনে হামলার প্রতিবাদ একটি কৌশলগত বিষয় ছিল। সেই হামলার প্রতিহামলা না হলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হতো।'

আলি ভায়েজ মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পরোক্ষভাবে যে 'প্রক্সি যুদ্ধ' চলছিল এখন তা দিনের আলো মতো সত্য ও আরও বেশি ধ্বংসাত্মক। কেননা, এই সংঘাত হয়ত এক সময় যুক্তরাষ্ট্রকেও টেনে আনবে এক অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের ময়দানে।

আশঙ্কাই হলো সত্য

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাসী শুনে আসছেন—ইসরায়েল যেকোনো সময় ইরানে হামলা চালাতে পারে। অথবা ইরান যেকোনো সময় ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে। কেননা, বিপ্লবের পর তেহরান তেল আবিবকে প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে তেল আবিব এক সময়ের মিত্র তেহরানকে নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি প্রধান হুমকি বলে বিবেচনা করতে শুরু করে।

এভাবে একে একে ৪৫ বছর কেটে গেলেও সেই আশঙ্কাই সত্য হলো গত ১৩ এপ্রিল রাতে।

গত রোববার সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক বিশ্লেষণে ইসরায়েলে ইরানের হামলাকে 'ঐতিহাসিক' উল্লেখ করে বলা হয়, ইরান যে হামলা চালিয়েছে তা বিশ্বে সবচেয়ে বড় ড্রোন হামলা। এ ছাড়া, এই হামলা ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।

তবে ইরানের মাটি থেকে ইসরায়েলে সরাসরি হামলার যে সূচনা হয়ে গেল তা এখন আরও গভীরতম সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর বিশ্লেষণে কলাম লেখক স্ট্যানলি জনি বলেন, ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ইরান 'ছায়াযুদ্ধ'র ছায়া থেকে বের হয়ে সরাসরি সংঘাতের যুগে প্রবেশ করলো।

'অজানা ভবিষ্যৎ'

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন মনে করেন ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর তেল আবিবের হাতে অপার সুযোগ এসে গেছে। তিনি সিএনএনকে বলেন, এখন ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে পারে বা তেলশিল্প ধ্বংস করে দিতে পারে।

এমনকি, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিও এখন ইসরায়েল গুড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলেও মনে করেন এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ।

তিনি এও মনে করেন যে, মিত্র ইসরায়েলের প্রতিহামলা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে আসবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এ বিষয়ে তেল আবিবকে সমর্থন দেওয়া। তার মতে, ইসরায়েলকে ইরান হামলা থেকে বিরত থাকতে বলে বাইডেন প্রশাসন ওয়াশিংটনকে 'বিব্রতকর' অবস্থায় ফেলেছে।

বল্টনের এমন বক্তব্যে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, 'যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে' ইরানে হামলা হোক এমন ভাবনা নিয়ে হয়ত অনেকে কাজ করছেন। তবে তা যে আরও ধ্বংস ডেকে আনতে তা বলাই বাহুল্য।

গত রোববার সিএনএনের এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়—মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত বাইডেন এড়িয়ে যাওয়ার আশা করেছিলেন, ইসরায়েলে ইরানের হামলার কারণে তিনি তাতেই জড়িয়ে গেলেন।

সংবাদমাধ্যমটির মতে, ইসরায়েলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলা মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর পরিসরে সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মিত্র দেশের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, ইরানের হামলার পর কী ঘটবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এমন হামলার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এক 'অজানা ভবিষ্যতে' প্রবেশ করলেন।

এই হামলা যেসব প্রশ্ন রেখে গেল সেসবের মধ্যে আছে—এখন ইসরায়েলের ভূমিকা কী হবে? ইরানের মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা কী হবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেন—হোয়াইট হাউসের ভূমিকা নিয়ে।

গত শনিবার ইরানের হামলার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন খুবই স্পষ্টভাষায় বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, তেহরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবে না ওয়াশিংটন। আবার গতকালের মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি 'যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার' আশঙ্কার কথা জানান।

তার এই দুই ধরনের বক্তব্য বিশ্ববাসীকে কী বার্তা দেয়?

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের রক্তক্ষয়ী হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা গেছে। তাদেরকে সংঘাতে জড়াতে হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে।

এ ছাড়া, ইসরায়েলে ইরানের ছোড়া ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্রের বেশিরভাগ ধ্বংস করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকেই। আসলে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র কোন পথে এগোবে?—সেই প্রশ্ন ভবিষ্যতের কাছেই রাখা থাকলো।

Comments

The Daily Star  | English
What constitutes hurting religious sentiments

Column by Mahfuz Anam: What constitutes hurting religious sentiments?

The issue of religious tolerance have become a matter of great concern as we see a global rise in narrow-mindedness, prejudice and hatred.

8h ago