মানুষ যেভাবে বাঁচতে চায় পারছে না, আইনের শাসন পাচ্ছি না কোথাও: ড. ইউনূস

‘আমার মাঝে মাঝে দুঃখ হয় এটা নিয়ে, সারা দুনিয়া বাংলাদেশ থেকে শিখতে চায়। আমাদের গৌরব বোধ করার কথা। তা না করে আমরা এমন কাজ করছি, যেন একটা পাপের কাজ করে ফেলেছি আমরা।’
আদালত প্রাঙ্গণে ড. ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

আইনের শাসন বলে যে একটা জিনিস, সেটা আমরা পাচ্ছি না কোথাও বলে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত প্রাঙ্গণে তিনি এ মন্তব্য করেন।

সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, মানুষ বিশ্বাস করে এটাতে, তারা এটাতে এগিয়ে এসেছে। দেশ-বিদেশের মানুষ এটাতে বিশ্বাস করছে। যে কারণে তারা উৎসাহিত হয়ে সারা দুনিয়ার থেকে এটা করার জন্য যেটাকে আমরা সামাজিক ব্যবসা বলছি। কী জিনিস, কী ব্যাপার, এটা কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য আমরা হাজির করি নাই যে, এখানে বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়েছে। এটা মনে হয়েছে, এতে মানুষের মঙ্গল হবে। মানুষের মঙ্গলের জন্য আমরা করি। সেই জন্য দেশ-বিদেশের নেতারা এটা জানতে চায়, বুঝতে চায়, কর্মীরা বুঝতে চায়, দেশে প্রয়োগ করতে চায়। সেই জন্য নানা দেশে যাই। এই যে নানা দেশে যেতে হয় এটা শুধু নিজের ফুর্তির জন্য যাওয়া তো না, এটা তাদের নেহাত আগ্রহ, যেহেতু তারা করছেন।

'আমার মাঝে মাঝে দুঃখ হয় এটা নিয়ে, সারা দুনিয়া বাংলাদেশ থেকে শিখতে চায়। আমাদের গৌরব বোধ করার কথা। তা না করে আমরা এমন কাজ করছি, যেন একটা পাপের কাজ করে ফেলেছি আমরা। এমন অনুভূতি হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না। আমরা চাই, দেশের মানুষ আনন্দ পাক যে, আমরা জাতি হিসেবে গর্ব করতে পারি। সারা দুনিয়ার সামনে এমন সব জিনিস নিয়ে এসেছি, তারা আমাদের কাছ থেকে জানার জন্য, বোঝার জন্য সেটা তাদের দেশে করার জন্য; সেটা উন্নত দেশ হোক, সেটা অনুন্নত দেশ হোক—কোনো পার্থক্য নেই, সবাই চায় আমাদের কাছ থেকে শিখতে। যে জিনিস সারা দুনিয়া শিখতে চায়, তাদেরকে তো আমরা বাধ্য করছি না! উৎসাহ নিয়ে তারা আসছে। সেই সুযোগটা আমরা দেবো না কেন?'

গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আপনাদের কাছে এটাই অনুরোধ, দেশের মানুষের কাছেও জিজ্ঞেস করেন আমরা সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছি না কেন? কোথায় বাধা আমাদের? সেই জিনিসটা জানার জন্য। আমরা যেহেতু এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পেরেছি যে, মানুষ আমাদের কাছে শিখতে চায়। দেশ-বিদেশে, সারা দুনিয়ার এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত শিখতে চায় এবং সেটাতে তাদের জাতির মঙ্গল হচ্ছে বলে তারা মনে করে।

'আমরা বলছি যে, বর্তমানে যেভাবে আমরা অগ্রসর হচ্ছি, সারা দুনিয়া অগ্রসর হচ্ছে। তাতে দুনিয়া সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেটা থেকে উদ্ধারের একটা রাস্তা আমরা তৈরি করছি। সেই জন্য মানুষের এত আগ্রহ। তারা বিশ্বাস করছেন যে, এই রাস্তা করলে সারা দুনিয়া উদ্ধার পাবে। যে জন্য আমরা তিন শূন্যের পৃথিবীর কথা বলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে কী একটা তিন শূন্য, কিন্তু মানুষ মনে করছে এটাতেই আমাদের মুক্তি। কাজেই মুক্তির পথ হিসেবে তারা মনে করছে।'

তিনি বলেন, দুনিয়াতে পুঁজিবাদের কথা হয়েছে, কমিউনিজমের কথা হয়েছে-হচ্ছে, এখনো হচ্ছে। আমরা তো ওই রকম কোনো মতবাদ প্রচার করছি না! আমি শুধু বলছি, আপনি ইচ্ছা করলেই কাজটা করতে পারেন। করলে দুনিয়ার মঙ্গল হবে। আমরা এই বালা-মুসিবত থেকে—পৃথিবীর যে বালা মুসিবত, আমি তো নিজের বালা-মুসিবতের কথা বললাম, দেশের বালা-মুসিবতের কথা বললাম, পৃথিবীর একটা বালা-মুসিবত আমাদের চারদিকে ঘিরে আছে, সেই বালা-মুসিবত থেকেও আমাদের উদ্ধার করতে হবে এবং সেটা করার পথে আমরা কিছুটা আলোর নির্দেশনা দিতে পারছি যে, এই পথে গেলে আমরা সেই মুক্তিটা পাব। সেই পথে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু পদে পদে আমরা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি।

বাধাপ্রাপ্ত কেন হচ্ছেন—গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে ড. ইউনূস বলেন, 'সেটা আপনারা বিচার করেন। আমরা কী ব্যাখ্যা দেবো বলেন?'

দেশের বালা-মুসিবত কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আপনারা তো রোজ লিখছেন সেটা কী, আমাকে বলতে বলছেন কেন? বালা-মুসিবত হচ্ছে মানুষ যেভাবে বাঁচতে চায়, যেভাবে থাকতে চায়, সেভাবে থাকতে পারছে না। আইনের শাসন বলে যে একটা জিনিস, সেটা আমরা পাচ্ছি না কোথাও। রোজ আপনারা লিখছেন সেগুলো, আমরা আপনাদের কাছ থেকে তো শিখছি, বুঝে নিচ্ছি।'

আপনি কীভাবে দেখছেন—গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে ড. ইউনূস বলেন, 'আপনারা যেভাবে দেখছেন, আমিও সেভাবে দেখছি। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে দেখছি, আপনিও দেশের নাগরিক হিসেবে দেখেন। আমরা তো দেশের অংশীদার। আমরা সবাই মিলেই তো এ দেশ।'

আইনের শাসন কোথায় নেই—গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে ড. ইউনূস বলেন, 'এটা আপনি পাতা উল্টে উল্টে লিস্ট করেন, আমি বলে দেবো। অসুবিধা নেই তো। এগুলো আপনারা দেখবেন।'

আপনার দৃষ্টি থেকে জানতে চাচ্ছি, আপনি কোথায় দেখছেন আইনের শাসন নেই—জবাবে ড. ইউনূস বলেন, 'আমি কাগজের বস্তাটা আপনার হাতে তুলে দেই। এগুলো বক্তৃতা করে তো কোনো লাভ নেই!'

ড. ইউনূস বলেন, 'আমার অনুরোধ, এই রমজান মাসে আমরা সবাই মিলে নিজেদের দিকে তাকাই। আমরা নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারছি কি না? আমরা যেটা করতে চাচ্ছিলাম, সেটা করতে পারছি কি না? না করতে পারলে কীভাবে আমরা প্রতিবাদ জানাব। কীভাবে আমাদের কথাগুলো আমরা শোনাতে পারব, সেই শোনাবার পথ আমরা বের করি। পথ আমাদের বের করতেই হবে। এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই।'

আপনি এক মাস আগে বলেছিলেন, ছবি তুলে রাখার জন্য। আজ আদালত আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিলেন। আপনি ন্যায়বিচার পাচ্ছেন কি না? জানতে চাইলে জবাবে ড. ইউনূস বলেন, 'এখনো তো বিচার শুরু হয়নি।'

তিনি বলেন, 'আমি যে কথাটা আগে বলেছি, আবারও বলছি, এইটার থেকে আপনিও মুক্তি পাবেন না, দেশের কোনো মানুষ মুক্তি পাবে না। এটার কথা বলতে হবে, আমার কী ভূমিকা ছিল সেখানে? এই যে উনার হেনস্থাটা হলো, আমি কি হেনস্থা মনে করেছিলাম? আমি কি প্রতিবাদ করেছিলাম? যদি মানুষ হেনস্থা মনে করে থাকে। আর যদি মনেই করে থাকে যে হেনস্থা হয়নি, তাহলে তো ভিন্ন কথা। কিন্তু এর জবাব সবাইকে দিতে হবে একদিন।'

বর্তমান পরিস্থিতি কি আপনি খুব খাপছাড়া মনে করছেন? জবাবে তিনি বলেন, 'খাপছাড়া না, খুব নির্দিষ্ট একটা জিনিস। এটা খাপছাড়া বলব কেন? সুনির্দিষ্ট একটা জিনিস। কাজেই সেটার থেকে আমাদেরকে মুক্তি পেতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

An economic corridor that quietly fuels growth

At the turn of the millennium, travelling by road between Sylhet and Dhaka felt akin to a trek across rugged terrain. One would have to awkwardly traverse bumps along narrow and winding paths for upwards of 10 hours to make the trip either way.

11h ago