দেশে চিংড়ি চাষে বিপ্লব ঘটাবে যে নতুন আবিষ্কার

ফাইল ছবি স্টার

পেশায় চিকিৎসক আফতাবুজ্জামান ১৯৬৮ সালে সাতক্ষীরা জেলায় চিংড়ি চাষ শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে তার হ্যাচারির চিংড়িতে মারাত্মক এক রোগের সংক্রমণ না হওয়া পর্যন্ত তার প্রজেক্টটি খুব ভালো চলছিল। সংক্রমণে তার বেশিরভাগ চিংড়িই মরে যায়। তখন জানা যায়, হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের কারণে এটি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ডা. আফতাবুজ্জামান বলেন, 'প্রথমবারের মতো আমরা জানতে পারি যে কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট এলাকার প্রকল্পগুলোতে একটি মারাত্মক ভাইরাস চিংড়িকে আক্রমণ করেছে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে এই ভাইরাসের আক্রমণে অনেক চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।'  

'হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস এখনও দেশের চিংড়ি চাষীদের জন্য বড় হুমকি, কারণ এটি প্রতি বছর ব্যাপক ক্ষতি করছে, বলেন ডা. আফতাবুজ্জামান।

তিনি বলেন, 'এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না।'

তবে চিংড়ি চাষিদের জন্য আশার কথা হলো দেশের গবেষকেরা, যাদের বেশিরভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের জিনগত গঠন আবিষ্কার করেছেন এবং এর একটি নতুন রূপও শনাক্ত করেছেন।

গবেষকদের মতে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা। তারা বলেন, হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনগত বিন্যাস সম্পন্ন করার মাধ্যমে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস চিংড়ি খাত। হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস চিংড়ির অন্যতম শত্রু। এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে ওই এলাকার সব চিংড়ি মারা যায়।

তারা বলেন, এই ভাইরাসের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন নেই। এর পেছনে একটি কারণ হলো বাংলাদেশে এই ভাইরাসের জিনগত গঠন সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না।

এই ভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্প্রতি দেশে পাওয়া গেছে এবং তা প্রথমবারের মতো হোয়াইট স্পট সিন্ড্রোম ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনগত বিন্যাস উন্মোচন করার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন দেশের একদল গবেষক।

কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের জিনগত বিন্যাস উন্মোচন করে তারা আবিষ্কার করেন যে ভাইরাসটির একটি সম্পূর্ণ নতুন ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানে বাংলাদেশে সক্রিয় যা ভারত, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশের ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এর জিনগত গঠন অনেক বেশি স্বতন্ত্র।

হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস প্রধানত চিংড়িতে সাদা বৃত্তাকার দাগ সৃষ্টির জন্য দায়ী, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান।

তিনি বলেন, এটি একটি অত্যন্ত প্রাণঘাতী ও সংক্রামক ভাইরাস এবং বিশ্বব্যাপী চিংড়ি খাতে বছরে প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির জন্য এটি দায়ী।

এই ভাইরাস সংক্রমণের দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো চিংড়ি ঘের বা প্রকল্প নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

গবেষকরা বলেন, হোয়াইট স্পট সিন্ড্রোম ভাইরাস ক্রাস্টেসিয়ানদের সংক্রমিত করে। যেমন: চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া প্রভৃতি। অন্য কোনো মাছকে আক্রমণ করে না।

এই ভাইরাসটি মূলত চিংড়ি কোষের আনুষঙ্গিক প্রোটিন হিসাবে 'র‍্যাব ৭' নামক পরিবাহকের সাহায্যে কোষে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান। তিনি এই গবেষণার একজন প্রধান গবেষকও।

অধ্যাপক আদনান বলেন, ভাইরাসের প্রতিষেধক কিংবা টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ভাইরাসের জিনগত ধরন এবং চিংড়ির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জানা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাগদা চিংড়ি চাষ হয় কক্সবাজার ও সাতক্ষীরাতে এবং ইতোপূর্বে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের হার ছিল এই দুই জেলাতেই যা মহামারী আকারেও রূপ নেয়।

তিনি বলেন, তাই এ গবেষণার জন্য কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্ভুক্ত সবগুলো উপজেলা থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে।

অধ্যাপক আদনান বলেন, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রথমবারের মতো দেখা যায় কক্সবাজারের হ্যাচারিতে। ১৯৯৮ সালে খুলনা অঞ্চলের ৯০ ভাগ চিংড়ি হ্যাচারিতে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় এবং ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি ও মাইকোলজিতে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী প্রতি বছর দেশের ২০ ভাগ উৎপাদিত চিংড়ি নষ্ট হয়ে যায় এই ভাইরাসের কারণে।

এই ভাইরাসের কারণে ১৯৯৮ সালে রপ্তানিকৃত চিংড়ির পরিমাণ ২৬ হাজার টন থেকে কমে ১৮ হাজার টনে হ্রাস পায়, জানান অধ্যাপক আদনান।       

গবেষণার একজন সহ-প্রধান গবেষক চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি অ্যান্ড প্যারাসাইটলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জোনায়েদ সিদ্দিকী বলেন, এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশে হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের প্রকরণ কেমন, এর জিনগত বিন্যাসের মাধ্যমে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা শনাক্তকরণ এবং এই ভাইরাসের কোনো বিষাক্ত প্রোটিন বা জিন চিংড়ির সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে মূল ভুমিকা রাখে, তার রহস্য উদঘাটন করা।

তিনি বলেন, এই গবেষণার ফলাফল থেকে চিংড়ি চাষিরা জানতে পারবেন এই ভাইরাসের উৎস কী, কীভাবে ছড়ায়। এই তথ্যগুলো পরবর্তীতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিকল্পনায় ও প্রতিষেধক তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।     

অধ্যাপক আদনান বলেন, ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে জুন-জুলাই মাসে দেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে  এবং ৩৫ ভাগ হ্যাচারি বা চিংড়ি প্রজনন ক্ষেত্রে এটি পাওয়া যায়।

চবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম রফিকুল ইসলাম এবং চবির মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম শরীফুজ্জামান এবং ড. শাহনেওয়াজ চৌধুরীও এই গবেষণায় প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেন এবং সহ-প্রধান গবেষক হিসেবে আরও কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের ড. আনোয়ার হোসেন এবং আইসিডিডিআর,বি এর বিজ্ঞানী এনায়েত হোসেন।

এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক না থাকায় এর নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব ছিল, বলেন অধ্যাপক আদনান। ভাইরাসটির জিনগত বিন্যাস উন্মোচনের মাধ্যমে একটি এমআরএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিন বা এই জাতীয় যেকোনো ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পথ সুগম হলো।

তিনি বলেন, এই জিনোম সিকোয়েন্স তথ্যটি সম্প্রতি ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন (এনসিবিআই) এবং আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি কর্তৃক গৃহীত হয়েছে।

'আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা,' বলেন অধ্যাপক জোনায়েদ সিদ্দিকী। 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago