পা বিহীন গিরগিটি থেকে পতঙ্গভুক ভিমরুল, এক হাজার নতুন প্রজাতির সন্ধান
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম ও ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমি অব সায়েন্সেসের বিজ্ঞানীরা গত বছর প্রায় এক হাজারের মতো নতুন প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কার করেছেন। তাদের এ আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, পৃথিবীতে অনেক বিস্ময়কর প্রাণী আছে যেগুলো এখনো আমাদের অজানা।
গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রের বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী রক্ষা আইনের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিপদাপন্ন প্রজাতিগুলোকে রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে এই আইন।
ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের নির্বাহী পরিচালক স্কট সিম্পসনের মতে, 'বসতি ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলে নিযুত পরিমাণ প্রজাতি সংকটে আছে। পৃথিবীর জীববৈচিত্রের তথ্য আমাদের সংগ্রহে রাখতে হবে, এতে প্রাণীদের রক্ষায় আমরা কাজ করতে পারব। এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত থাকতে পেরে ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস কৃতার্থ বোধ করছে।'
নতুন আবিষ্কৃত ৯৬৮টি প্রজাতির মধ্যে আড়ালে থেকে যাওয়া ডাইনোসর, মৌমাছি, মথ, সি স্লাগ, মাছ, ব্যাঙ, মাকড়সা, ছত্রাক, কৃমি ও পা বিহীন গিরগিটি রয়েছে।
কীট-পতঙ্গভুক ভিমরুল
২০২৩ সাল যেন ছিল ভিমরুলদেরই। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের আবিষ্কৃত ৮১৫টি নতুন প্রজাতির মধ্যে ৬১৯টিই ছিল পরাগবাহী, শিকারি ও পরজীবী ভিমরুল।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী ড. জন নোয়েস ও ক্রিস্টোফার হ্যানসনের প্রচেষ্টায় অসাধারণ সব আবিষ্কার হয়েছে। মৌমাছি, পিঁপড়া ও বোলতা নিয়ে কোস্টারিকায় চলছে তাদের গবেষণা।
নোয়েস বলেন, 'নতুন প্রজাতিগুলো নিয়ে নতুন নতুন তথ্য বের করে আনা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এদের অনেকেই তাদের পরিবেশের ওপর প্রভাব রাখতে সক্ষম। তাদের কী নামে ডাকা হবে তা না জেনেই আমরা তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারছি না।'
ভিমরুলদের নতুন প্রজাতিগুলোর কয়েকটি বিচিত্র ধরনের রঙের প্রদর্শনী দেখিয়ে চলছে, যার মধ্যে আছে নীল, গোলাপি ও কমলা রঙ। নোয়েস ব্রিটিশ টেলিভিশন সিরিজ 'ডক্টর হু' এর ভক্ত। ২০২৩ সালে ৬০ বছর পূর্ণ করা সিরিজটির প্রতি সম্মান জানিয়ে এখানকার খলনায়কদের নামে ভিমরুলের একটি 'গণ'র নাম তিনি রেখেছেন 'ডালেকস'।
ভিমরুলদের হুল ফোটানোর বাইরে আর তেমন কাজ নেই বলে মনে করা হয়। কিন্তু এরা ফসল ধ্বংস করা কীটদের শিকার করে তাদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখে।
'গত ৬০ বছরে তিনটি প্রজাতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, আফ্রিকায় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষকে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচিয়েছে, দ্বিতীয়ত, থাইল্যান্ডের রেইনফরেস্টকে ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। তৃতীয়ত, টোগোর অর্থনীতিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে', বলেন নোয়েস।
পা বিহীন গিরগিটি
অ্যাঙ্গোলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত সেরা ডা নেভের ঢালে দেখা মিলেছে পা বিহীন এক গিরগিটি প্রজাতির। এদের ইংরেজিতে বলে `স্কিঙ্কস'। দেখতে সাপের মতো, বনে-জঙ্গলে গাছ পালার আড়ালে থেকে পোকামাকড় শিকার করে।
সাপের সঙ্গে এদের তফাত দুটো জায়গায়। এদের কান রয়েছে ও চোখের পাতা নড়াচড়া করতে পারে।
বেশিরভাগ স্কিঙ্কস প্রায় একই রঙের। তবে নতুন পাওয়া অ্যাকোন্টিয়াস মুকওয়ান্ডোর ঘাড়ের কাছে একটি গোলাপি রিং আছে।
সেরা ডা নেভে সাধারণের বাইরে অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য নিজস্ব বাস্তুসংস্থান নিশ্চিত করেছে। নামিব মরুভূমির উত্তর প্রান্তে থাকা এই পর্বতে ঠাণ্ডা ও আর্দ্র পরিবেশ রয়েছে।
অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক অ্যারন বাউয়ার বলেন, 'এই পর্বত থেকে কিংবা এর মতো অন্যান্য পর্বত থেকে পাওয়া নমুনা এটাই প্রমাণ করে যে, এই জায়গাগুলো সংরক্ষণের জন্য বিবেচিত হওয়া উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'আলাদা হয়ে থাকা দ্বীপগুলোয় আমরা নতুন প্রজাতির সন্ধান পাচ্ছি। ফলে এদের রক্ষা করার জন্য এখনো খুব দেরি হয়ে যায়নি।'
উদ্ভট গাছপালা
মেক্সিকোর ডুরাঙ্গোতে থাকা ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। উদ্দেশ্য, সিয়েরা মাডরে পার্বত্য অঞ্চলে থাকা দুষ্প্রাপ্য একটি রসালো উদ্ভিদ বা সাকালেন্ট প্ল্যান্ট নিয়ে গবেষণা চালানো।
খাড়া উঁচু পাহাড়ের ধারে জন্মানো এই উদ্ভিদটি সেখানকার স্থানীয় ও'ডাম নৃগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত। তারা একে ডা'নপাকাল বলে ডাকে, যার অর্থ ন্যাড়া, নগ্ন কিংবা পিচ্ছিল।
বিজ্ঞানীরা এই উদ্ভিদের নাম দিয়েছেন প্যাকাইফাইটাম ও'ডাম। উদ্ভিদটির সঙ্গে স্থানীয় সেই নৃগোষ্ঠীর সম্পর্ককে মাথায় রেখেই এমন নামকরণ।
এর মাঝেই কোস্টারিকায় একটি ফুল গাছের সঠিক পরিচয় উদ্ধার করা গেছে। ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফুলটিকে মেক্সিকোর প্রায় কাছাকাছি কিন্তু ভিন্ন এক প্রজাতির বলে মনে করা হতো।
নতুন করে শনাক্ত করা এই উদ্ভিদের নাম স্টেনোসটিফানাস পারপিউরিয়াস, যা মেক্সিকোতে জন্মানো স্টেনোসটিফানাস সিলভাটিকাস এর থেকে ভিন্ন। কোস্টারিকায় প্রাপ্ত উদ্ভিদটিতে 'সমতল পাপড়ি' বা ফ্ল্যাট পেটাল থাকে না। ফলে এটিতে পরাগায়নের উদ্দেশ্যে আসা মৌমাছি, প্রজাপতি বসতে পারে না। স্টেনোসটিফানাস পারপিউরিয়াসের পরাগায়নের কাজটি সেক্ষেত্রে হামিং বার্ডেরা করে থাকে।
অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক রিকার্ডো ক্রাইবেল বলেন, 'মেক্সিকোর সেই উদ্ভিদের সঙ্গে খাপে খাপে সব মিলিয়ে দেখার আগে কোস্টারিকার এই প্রজাতির শনাক্তকরণ নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন তুলিনি। এই দুইয়ের ব্যবধান খুব সূক্ষ্ম। মৃত, শুকনো নমুনা নিয়ে কাজ করলে পার্থক্য ধরাও যায় না।'
অতীতে নতুন দৃষ্টিপাত
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষকরা জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করে চারটি নতুন প্রজাতির পাখিকে শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে আছে ডায়নোসর যুগের পাখিও। ২০২৩ সালের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর একটি হলো কুমিমানু ফোরডাইসেই। এটি পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ানো সবচেয়ে বড় পেঙ্গুইন। এই পাখিটি আজ থেকে ৬০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করতো, এর ওজন ছিল প্রায় ৩৩০ পাউন্ড (১৫০ কেজি)।
ডায়নোসরের দ্বীপ বলে খ্যাত যুক্তরাজ্যের আইল অব উইটে মিলেছে সাঁজোয়া ডায়নোসর প্রজাতির সন্ধান।
এই 'অ্যাঙ্কাইলোসর'টি এই দ্বীপে ১৪০ মিলিয়ন বছর আগে বাস করত। এর নামকরণ করা হয়েছে ভেক্টিপেল্টা ব্যারেটি। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অধ্যাপক পল ব্যারেটের প্রতি সম্মান জানিয়েই এমন নাম।
নতুন প্রজাতিগুলোর ওপর গবেষণা চালানো প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. সুসানা মেইডমেন্ট বলেন, 'আমাদের ডিসিপ্লিনে পল খুবই প্রভাবশালী একটি নাম।'
'তিনি (পল) সুবিখ্যাত ও এক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম। আমাদের সবার ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও তার প্রভূত অবদান আছে ও আমরা সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তাই ছোট, মন্থরগতির এই প্রজাতিটির নাম আমরা তার নামানুসারে রেখেছি', যোগ করেন তিনি।
গবেষকরা প্রাচীন এক ছত্রাকের নাম রেখেছেন শিশুসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী বেট্রিক্স পটারের নামে। ৪০০ মিলিয়ন বছর বয়স্ক পটেরোমাইসিস অ্যাস্টেরোক্সিলিকোলা নামের রোগসৃষ্টিকারী এই ছত্রাক জীবাশ্মে পরিণত হওয়া উদ্ভিদের শেকড়কে সংক্রমিত করেছিল। পিটার র্যাবিট সিরিজের বইগুলো লেখার বাইরে পটার নিজেও ছিলেন একজন মাইকোলজিস্ট তথা ছত্রাক বিশারদ, পড়েছিলেন এ সম্পর্কে, সবিস্তারে এঁকেছিলেন ছত্রাকের ছবি।
তথ্যসূত্র: সিএনএন
গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়
Comments