শতবর্ষে খলিল জিবরানের ‘সামাজিক সম্পর্ক’ ভাবনা

খলিল জিবরান, ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বসাহিত্যে খলিল জিবরান এক অনন্য নাম। তার কবিতায় গল্প খেলা করে। সঙ্গে পাঠকদের নীতিশিক্ষা ও দর্শনের স্বাদও দেয়। জনশ্রুতি আছে, তার বই উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও চীনের কবি লাওতসের পর সর্বাধিক বিক্রিত। রহস্যময় আরবি সাহিত্য ও ইংরেজি কবিতার জন্য দুনিয়াজুড়ে সমাদৃত জিবরানের শতবর্ষ আগে প্রকাশিত 'দ্য প্রফেট' বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম মাস্টারপিস। ১০০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত জিবরানের উল্লেখযোগ্য রচনা।

আমরা দেখি, প্রকৃত কবিতা মানুষের মনোজগতে নাড়া দেয়, জীবন নিয়ে ভাবায়। আমাদেরও একইভাবে প্রভাবিত করে। তার কবিতায় জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ বিয়ে, সন্তান, মৃত্যু, বন্ধুত্ব ও ধর্ম প্রভৃতি সামাজিক বিষয়। অধিকাংশ রচনায় দার্শনিক ব্যাখ্যার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়াও নিয়ে যায় জাতিসত্ত্বা ও প্রকৃতি প্রেমের অলিগলির দিকে। এক কথায় জিবরান পাঠ আমাদের জীবন দর্শন ও সমাজ ভাবনায় অভাবনীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম। 

একটি সমাজ-সংসারে অন্যতম উপাদান বিয়ে। এই নিয়ে দৈনন্দিন নানা আলাপে মেতে উঠি। প্রসঙ্গে খলিল জিবরানের 'বিয়ে' কবিতাটি নতুন দিকের সন্ধান দেয়। নব দম্পতির উদ্দেশ্যে কবি বলেন, তোমরা একই সাথে জন্মেছিলে, বাঁচবেও এক জীবন একসাথে।' অর্থাৎ কবি বিবাহিত দম্পতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন দুইজন নর-নারী যখন পরস্পরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন তাদের নতুন করে জন্ম হয় এবং এর সফল সমাপ্তি হলো বাকি জীবন একসাথে কাটিয়ে দেওয়া। 

ইংরেজ কবি জন ডানের 'দ্য গুড ম'রো' কবিতায়ও আমরা এই একই বার্তা পাই। কবি নব দম্পতির উদ্দেশ্যে আরও বলছেন, 'পরস্পর ভালোবাসবে, তবে ভালোবাসাকে প্রথায় রূপ দেবে না।' অর্থাৎ, কবি বলেছেন ভালোবাসা মিলনে মলিন না হয়ে উজ্জ্বলতর হবে। কবি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, বিবাহিত দম্পতি পরস্পরকে হৃদয় দেবে, তবে কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে না কারণ হৃদয়ের নিয়ন্ত্রিত একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। ইংরেজ প্রাবন্ধিক ফ্রান্সিস বেকন স্ত্রীকে তুলনা করেছেন যুবক বয়সে স্বামীর প্রেমিকা, মধ্য বয়সে সঙ্গী এবং বুড়ো বয়সে সেবিকার রূপে। জিবরানের কবিতা পড়ে আমরা জীবনের এই অনিবার্য অধ্যায় সম্পর্কে বহুমাত্রিক ধারণা পাই।


সংসার জীবনে সন্তানের জন্ম  যে কোনো দম্পতির জীবনে পরিপূর্ণতা আনে। শিশুর উপস্থিতি আমাদেরকে জগৎ-সংসারের  যাবতীয় যাতনা ও দুর্দশার কথা ভুলিয়ে দেয়। জিবরানের 'শিশু' কবিতাটা যে কোনো মা-বাবার জন্য এক দার্শনিক দীক্ষা। কবিতার শুরুতে জিবরান বলেছেন, 'তোমার সন্তানের তোমার নয়। /তারা জীবনের প্রয়োজনে জীবনের পুত্র ও কন্যা সন্তান।' লাইন দুটো স্মরণ করায় আমাদের সন্তানেরা আমাদের ওরসে জন্ম, আমাদের হাতে বেড়ে উঠলেও তারা আমাদের মালিকানাধীন জাগতিক কোনো সম্পদ নয়। বাহ, চিন্তার দারুণ বিষয়।

শিশুদের নিজস্ব চিন্তাধারা থাকে এবং মা- বাবা চাইলেও তাদের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই তো জিবরান বলছেন, সন্তানদের তুমি ভালোবাসতে পারো, কিন্তু তাদের চিন্তাধারাকে তুমি প্রভাবিত করতে পারো না/ কারণ তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা আছে।' মানব সন্তানের বেড়ে উঠা, পারিবারিক দীক্ষা ও তাদের মানসপট গঠনে মা- বাবার ভূমিকা কী হবে সে বিষয়ে  একটা পরিষ্কার ধারণা পাই আমরা জিবরানের 'শিশু' কবিতায়। 

'প্রকৃত বন্ধু পরিবারের চেয়েও নিকটজন' বলেছেন হযরত আলী। বন্ধু ও বন্ধুত্ব ছাড়া মানব জীবন অচল। তো, 'কেমন বন্ধু চাই'- এই নিয়ে আমাদের মধ্যে যুগে যুগে বিস্তর আলাপ হয়ে আসছে। জিবরান 'বন্ধুত্ব' ও বা 'বন্ধু' কবিতায় বন্ধুকে তুলনা করেছেন 'দুঃসময়ের কাণ্ডারির' সাথে। সত্যিকার বন্ধু আসলে আমাদের আত্মার খোরাক যোগায়। সুখে দুঃখে আমরা বন্ধুর কাছে ফিরে যাই। পরামর্শ করি। দুঃখ ভাগাভাগি করি। একজন বন্ধু তার বন্ধুর হৃদয়ের কথা শুনতে পায় এমনকি মৌনতায়- বলেছেন জিবরান।

ইংরেজি সাহিত্যের পাঠক মাত্রই ফিলিপ সিডনি ও এডমুন্ড স্পেন্সারের বন্ধুত্বের সাথে পরিচিত। সিডনি তাঁর সর্বোচ্চটুকু দিওয়ে স্পেন্সারের কবি হওয়া ও কাব্যচর্চায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বেকন 'অব ফ্রেন্ডশিপ' প্রবন্ধে বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ ক'রে বলেছেন, যার বন্ধু নেই, যিনি নির্জনবাস পছন্দ করেন, সে হয় পশু, নয়তো দেবতা। একজন সত্যিকারের বন্ধুর উপস্থিতি জীবনের অনেক কিছু সহজ করে দেয়। জিবরানের 'বন্ধু'  কবিতা আমাদেরকে বন্ধুত্বের অপরিহার্যতা ও বন্ধুত্বে করণীয়  জানার সুযোগ দেয়। 

মৃত্যু অনিবার্য সত্য। জিবরান 'মৃত্যু' কবিতায় জীবন ও মৃত্যুকে এক সত্তা হিসেবে তুলনা করেছেন। যেটা নদীর সাথে সাগরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্য। পেঁচা যেমন কখনো আলোর রহস্য উদঘাটন করতে পারে না, তেমনি মানুষ জীবনের গহীনে গিয়ে এর অর্থ না খুঁজলে মৃত্যুর রহস্য জানতে পারবে না- বলেছেন জিবরান।

ফ্রান্সিস বেকন 'অব ডেথ' প্রবন্ধে মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের ধারণা নিয়ে বলেছেন, 'Men fear death as children fear to go in the dark'। মৃত্যু মানুষের জীবনে মুক্তি আনে জাগতিক যন্ত্রণা ও গ্লানি। টেনিসনের তিথোনাস কবিতায় তাই তো নায়ক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চান কারণ জিবরানের ভাষায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ নিঃশ্বাসকে অস্থির উঠানামা থেকে মুক্তি দেয়। একই কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় প্রাচীন প্রবাদ- বেঁচে থাকতে জোটে ছল, মরে গেলে গোলাপজল।

মানুষের জীবনের অন্যতম প্রভাবক হলো ধর্ম। লেবাসে ধর্ম না, কর্মে ধর্ম  এই নিয়ে পুরনো বিতর্কের সমাধান মিলে জিবরানের 'ধর্ম' কবিতায়। তিনি ধর্মকে দেখেছেন আমাদের সকল কাজ ও কাজের প্রতিফলন হিসেবে। কারণ কর্মকে থেকে বিশ্বাসকে আলাদা করা মানে কর্মীর আনুগত্য বা সমর্পণ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। তিনি বলেছেন, 'আপনার নিত্য জীবনই আপনার মসজিদ ও ধর্ম।/ যখন এতে প্রবেশ করবেন তখন নিজের সবটুকু নিয়ে যাবেন।" মোদ্দাকথা, ধর্মের প্রতিফলন হলো আমাদের কর্ম। বসনে নয়, কর্মেই হোক আমাদের ধর্মের পরিচয়। পাঠকরা এই বার্তা পান।

আলমগীর মোহাম্মদ অনূদিত খলিল জিবরানের বাচাই কবিতার বই

মার্কিন দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক হেনরি ডেভিড থরো 'সিভিল ডিসওভিডিয়েন্স' প্রবন্ধে রাষ্ট্র , সরকার ও জাতি নিয়ে সবিস্তারে আলাপ করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা সরকার, রাষ্ট্র ও জাতি এই তিনের সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা কী সে বিষয়ে একটা ধারণা পাই। জিবরানের ' সেই জাতির জন্য করুণা' কবিতাটাও একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। পরনির্ভরতা, দুষ্টের লালন,স্বপ্নহীনতা, দুর্দিনের মৌনব্রত পালন ও সুবিধাবাদী আচরণ এবং  রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যহীনতা একটা জাতিকে কতটা করুণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয় 'ধর্ম' কবিতায় সেটা তুলে ধরেছেন। জিবরান বলেছেন, 'সেই জাতির জন্য করুণা যাদের বুদ্ধিজীবীরা বছরের পর বছর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে/ এবং যাদের বলবানরা এখনো দোলনারত।/ সেই জাতির জন্য করুণা যারা অর্ন্তকোন্দলে জড়িত, / প্রত্যেক দল নিজেদেরকে জাতি মনে করে।' 

'দ্য প্রফেট' তে জিবরান একজন শিক্ষককে একজন জ্যোতির্বিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যার কাজ হলো একজন শিক্ষার্থীকে অর্জিত বিদ্যার আলোকে বিদ্যা অর্জনের পথে নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু, তার বিদ্যা কখনো অন্যের মধ্যে প্রোথিত করার চেষ্টা করবেন। তার এই কবিতার মূল কথা হলো শিক্ষকের কাজ  হলো মূলত শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করতে শেখানো এবং শেখার পথে সহযোগী হিসেবে কাজ করা। যা এই সময়ে দুর্লভ! ফলে এই কবিতা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক আমাদের সমাজে...

'কবিতা পাঠ মানুষকে বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলে' কথাটি ইংরেজ দার্শনিক বেকনের। সত্যি, জিবরানের কবিতাও দার্শনিকতার  দীক্ষা দেয়। সংস্কারাচ্ছন্ন দেশে তার রচিত 'শিশু', 'বিয়ে', ' মৃত্যু', 'বন্ধু', জাতির জন্য করুণা' কবিতাগুলো প্রভাব রাখতে পারে জ্ঞানে ও ধ্যানে। সারা দুনিয়ার মানবিক সংকটে জিবরান পাঠ হতে পারে 'অন্ধজনে আলো দান' এর মতো।      

Comments

The Daily Star  | English
fire at Secretariat

Secretariat fire sabotage or accident still not known: Fire service DG

Muhammad Jahed Kamal, director general of the Fire Service and Civil Defence, today said the cause of the devastating fire at Building No. 7 of the Bangladesh Secretariat still remains unknown

1h ago