এআইয়ের সাহায্যে মানুষের জ্ঞানের বাইরে তথ্য তৈরির দাবি
এলএলএম (লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল) ব্যবহার করে বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দাবি করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) গবেষকরা। অনুসন্ধানটি 'গুগল ডিপমাইন্ড' থেকে করা হয়েছে।
জনপ্রিয় চ্যাটজিপিটি কিংবা বার্ডের মতো প্রোগ্রামগুলো এই এলএলএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলে। এলএলএম প্রযুক্তি যে মানুষের জ্ঞানের বাইরেও তথ্য তৈরি করতে সক্ষম, সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে যুগান্তকারী এই আবিষ্কারটি।
ওপেন এআই'র চ্যাটজিপিটি এবং গুগলের বার্ডের মতো আধুনিক চ্যাটবটগুলো সাধারণত আগে থেকে প্রশিক্ষণে শেখা তথ্য পুনরায় সাজিয়ে আমাদের দেখায়। তবে বিজ্ঞানীরা দেখতে চেয়েছিলেন যে, লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো এর চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে পারে কি না কিংবা নতুন জ্ঞান আবিষ্কার করতে পারে কি না।
ডিপমাইন্ডের এআই ফর সায়েন্সের প্রধান পুষ্মিত কোহলি বলেন, 'প্রকল্পটি শুরু করার সময় এমন কোনো ইঙ্গিত ছিল না, যা থেকে বোঝা যাবে এটি প্রকৃতপক্ষেই নতুন কিছু তৈরি করবে। আমাদের জানামতে, এই প্রথমবারের মতো একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করে একটি প্রকৃত, নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করা হয়েছে।'
লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম এক ধরনের শক্তিশালী নিউরাল নেটওয়ার্ক। যা বিপুল পরিমাণ টেক্সট এবং অন্যান্য ডেটার মাধ্যমে কম্পিউটার কোড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষার প্যাটার্ন শিখতে সক্ষম। তাই চ্যাটজিপিটি প্রযুক্তি ত্রুটিপূর্ণ সফটওয়্যার ডিবাগ, বিখ্যাত কোনো কবির মতো করে যেকোনো বিষয়ে কবিতা লেখা, কলেজের প্রবন্ধ লেখাসহ প্রায় যেকোনো বিষয়ে টেক্সট তৈরি করতে পারে।
তবে এই চ্যাটবটগুলো আসলে নতুন জ্ঞান তৈরি করে না। পূর্বে থেকে শেখা টেক্সটগুলোকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের কাছে উপস্থাপন করে। এ ছাড়া, চ্যাটবটগুলো বেশ বিভ্রান্তি-প্রবণও হয়। যার ফলে দেখা যায়, আগের উত্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুলো সাবলীল এবং যুক্তিযুক্তভাবে ত্রুটিপূর্ণ উত্তর দেয়।
গুগলের ডিপমাইন্ড গণিতের জন্য 'ফানসার্চ' তৈরি করতে গিয়ে একটি এলএলএম ব্যবহার করে। যা সমস্যার সমাধানগুলোকে কম্পিউটার প্রোগ্রাম আকারে প্রকাশ করে। এই এলএলএমটিকে একটি এভালুয়েটর বা মূল্যায়নকারীর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রোগ্রামগুলোকে সেগুলোর পারফর্মেন্সের ওপর ভিত্তি করে সাজায়। পরবর্তীতে এভালুয়েটর থেকে সেরা প্রোগ্রামগুলোকে একত্রিত করে সেগুলোকে উন্নত করার জন্য এলএলএমে ফেরত পাঠানো হয়। যার মাধ্যমে সিস্টেমটি ক্রমাগতভাবে দুর্বল প্রোগ্রামগুলোকে আরও শক্তিশালী প্রোগ্রামে পরিণত করে। যা থেকে এটি নতুন জ্ঞান আবিষ্কার করতে পারে।
গবেষকরা ফানসার্চকে দুটি ধাঁধা দেন। প্রথমটি ছিল, ক্যাপ সেট সমস্যা হিসেবে পরিচিত বিশুদ্ধ গণিতের একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং কিছুটা রহস্যময় চ্যালেঞ্জ। এটি মহাকাশে বিন্দুর বৃহত্তম সেট খোঁজার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেখানে কোনো তিনটি বিন্দু একটি সরলরেখা তৈরি করে না। ফানসার্চ এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেছে, যেটি অনেক বড় নতুন ক্যাপ সেট তৈরি করতে পারে। যা মানব গণিতবিদদের তৈরি সেরা ক্যাপ সেটগুলোর থেকেও অনেক বড়।
দ্বিতীয় ধাঁধাটি ছিল বিন প্যাকিং সংক্রান্ত সমস্যা। যেখানে বিভিন্ন আকারের আইটেমকে পাত্রে প্যাক করার সর্বোত্তম উপায় খোঁজা হয়। এটি মূলত ভৌত বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেমন একটি শিপিং কন্টেইনারে বাক্সগুলো সাজানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী হতে পারে। তবে একই গণিত অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়, যেমন- ডেটাসেন্টারে কম্পিউটিংয়ের কাজের সময় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত জায়গা আছে এমন প্রথম দিকের বিনে আইটেমগুলো প্যাক করা হয়। আরেকটি উপায় হচ্ছে, যে বিনে সবচেয়ে কম জায়গা আছে কিন্তু কোনো একটি আইটেম যেখানে এখনো মাপসই হবে, সেখানে রাখার মধ্যে দিয়ে সমস্যাটি সমাধান করা হয়। তবে নেচার জার্নালে প্রকাশিত ফলাফল অনুসারে, ফানসার্চ আরও ভালো নতুন একটি পদ্ধতির সন্ধান করতে পেরেছে।
এ বিষয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক স্যার টিম গাওয়ারস বলেন, 'গত দুই বা তিন বছরে মানব গণিতবিদদের বিভিন্ন অমীমাংসিত সমস্যায় অগ্রগতি পেতে এআইর সহযোগিতা নেওয়ার কিছু উত্তেজনাপূর্ণ উদাহরণ রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'উদ্যোগটি সম্ভাব্যভাবে আমাদের এই ধরনের কাজের জন্য আরেকটি খুবই আকর্ষণীয় টুল দেবে। যার মাধ্যমে গণিতবিদরা দক্ষতার সঙ্গে চতুর এবং অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে পারবেন। তার চেয়ে ভালো কথা, এই বিষয়গুলো মানবিকভাবেও ব্যাখ্যাযোগ্য।'
ফানসার্চ কী পরিমাণ বৈজ্ঞানিক সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে এখন গবেষকরা তা পরীক্ষা করে দেখছেন। তবে এ ক্ষেত্রে একটি প্রধান বাধা হচ্ছে সমস্যাগুলোর সমাধান থাকা প্রয়োজন। যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করা যাবে। যে কারণে জীববিজ্ঞানের অনেক প্রশ্নই বাতিল হয়ে যায়। কেননা এ ক্ষেত্রে অনুমানগুলো প্রায়শই ল্যাবে পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে হয়।
তবে কম্পিউটার প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে এটি তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলবে। কোহলি বলেন, 'মানুষ কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং অ্যালগরিদমিক আবিষ্কারকে যেভাবে দেখে, এ ক্ষেত্রে এটি রূপান্তরমূলক হতে চলেছে। প্রথমবারের মতো আমরা দেখছি যে, এলএলএমগুলো কাজ দখল করে নিচ্ছে না। বরং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে যা সম্ভব ছিল, তার সীমানা ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে।'
উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক এবং গবেষণাটির সহ-লেখক জর্ডান এলেনবার্গ বলেন, 'আমরা যে নির্দিষ্ট ফলাফলগুলো পেয়েছি, সেগুলোর চেয়েও আমি বেশি উত্তেজনা বোধ করছি ভবিষ্যতে গণিতে মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার জন্য এর প্রস্তাবিত সম্ভাবনাগুলোর জন্য।'
'শুধু একটি সমাধান তৈরির পরিবর্তে ফানসার্চ একটি প্রোগ্রাম তৈরি করে, যা সমাধান খুঁজে বের করে। একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান আমাকে একই ধরনের অন্যান্য সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করতে হয়, সে সম্পর্কে কোনো অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে না। কিন্তু একটি প্রোগ্রাম যখন সমাধান খুঁজে বের করে, তখন সেটি একজন মানুষ পড়তে এবং ব্যাখ্যা করতে পারে। সেখান থেকে একজন ব্যক্তি এর পরবর্তী সমস্যা এবং তার পরবর্তী সমস্যাগুলোর জন্য ধারণা তৈরি করতে পারবে', বলেন তিনি।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি
Comments