উদ্বাস্তু মানুষের বিশ্বস্ত চিত্রকর
আধুনিক সাহিত্যের সূচনা ও বিকাশে ফরাসীরা ঊনিশ শতক থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশ্ব সাহিত্যে ফরাসীদের তুলনামূলক আধিপত্য অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজি কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল এলিয়ট, ইয়েটস, এজরা পাউ-, ওয়ালেস স্টীভেন্স প্রমুখের হাতে এবং বাংলা কাব্যে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণূ দে প্রমুখের কলমে, তার অঙ্কুরোদগম হয়েছিল ফরাসী কবি চার্লস্ বদল্যেয়রের কলমে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে।
পৃথিবীর সবদেশে মহৎ সাহিত্য-স্রষ্টা আবির্ভূত হতে পারে, হয়ে থাকে। এক শতাব্দীর অবসরে সব জাতিই এক-আধজন গুণী সাহিত্যিকের জন্ম দিতে পারে, দিয়ে থাকে। কিন্তু ঊনবিংশ শতক থেকে শুরু করে গত এক শতাধিক বৎসরে বিশেষ ক'রে উপন্যাসের ক্ষেত্রে ফরাসীরা উপর্যুপরি বহুমাত্রিক শিখরস্পর্শীতার প্রমাণ দিয়েছে। অভিনব স্থাপত্য, নবতর ভাষাশৈলী, বিচিত্র বিষয়বস্তু ও অনন্ত নিরীক্ষাধর্মীতা ফরাসী উপন্যাসকে দিয়েছে তুলনারহিত সমৃদ্ধি। এই যৌথ অর্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুজনের ব্যক্তিগত বিস্ময়কর প্রতিভা। এদের মধ্যে একজন জিন-মারি গুস্তাভ লে ক্লেজিও। কথাসাহিত্যিক লে ক্লেযিও ২০০৮ সালের সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
২.
লে ক্লেযিওর জন্ম ১৯৪০ সালে ফ্রান্সে হলেও আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডে যৌবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত করেছেন তিনি। অন্যদিকে মরিশাসের সঙ্গে তাদের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল নিবিড়। মরিশাসের অ্যাংলো-ফরাসি ক্রিওল লোকজনদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্টতা ছিল। তাঁর রচনার অবয়বে মেসোআমেরিকা, কালো আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকার পাশাপাশি ফ্রান্স এবং নগর সভ্যতা লে ক্লেযিও -- যার উপন্যাস, উপন্যাসিকা ও ছোটগল্প সংগ্রহের সংখ্যা ৫১ ও প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা ২১, যার রচনায় গত ষাট বৎসরে একাধিকবার ঋতু বদলের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হয়, তাকে কোন একটি বিশেষ অভিধায় পরিচায়িত করা দুরূহ। কিন্তু বহুধা নিরীক্ষাধর্মীতা সত্বেও লে ক্লেযিও'র সামগ্রিক রচনায় বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি ধারাবাহিকতা পরিলক্ষ্য করা যায়। তিনি মানুষকে নিয়ে লিখেছেন। তার রচনার আখ্যান জুড়ে রয়েছে মানুষের অনন্য ইতিাহস ও ভৌগলিক অতিসরণ। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে ১৯৮২-এ প্রকাশিত তাঁর একটি গল্প সংকলনের প্রচ্ছদনাম "লা রোন এ ওতরো ফে দিভ্যার"; বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় "চক্কর এবং অন্যান্য শীতল কঠিন সত্য"।
এই শিরোনামেই লে ক্লেযিও'র সাহিত্যিক গূঢ়ৈষা অবধৃত হয়েছে। মানবজীবনের তুষার শীতল, নিয়তিলাঞ্চিত, মরিচাবৃত দিকের প্রতি রয়েছে লে ক্লেযিও'র অনপনেয় পক্ষপাত। বিপন্ন মানুষের অসহায়ত্ব লে ক্লেযিও তুলে এনেছেন তাঁর রচনায় পরিব্যাপ্ত মানব জীবনের নানা পরিচ্ছদ ঘেঁটে। উত্তর আফ্রিকার মরুবাসীরা অভিবাসীরা ফ্রান্সে এসে অবাঞ্চিত হয়ে পড়ে। তাদের যন্ত্রণাদগ্ধ বিড়ম্বনার কথা লে ক্লেজিও লিখেছেন সততার সঙ্গে। আধুনিক নগর জীবনের কদর্যতা ও নিষ্ঠুরতা, অভিবাসীদের স্বপভঙ্গের হাহাকার, এবং ক্ষমতাধরের প্রতাপ ও শঠতা তিনি তার রচনায় ধারণ করেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে।
এক অর্থে মাতৃজরায়ু থেকে পৃথিবীতে আগমনের সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয় মানুষের উন্মূল জীবন; ধাত্রীর হাতে নাড়ী কাটার সঙ্গে-সঙ্গেই মানুষ বিতাড়িত হয় তার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় থেকে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক সভ্যতা এমন একটি পর্যায়ে প্রবেশ করেছে যেখানে আক্ষরিক অর্থেই মানুষকে স্বগৃহ ত্যাগ করে পরবাসী হতে হয়। কখনো হতে হয় বিতাড়িত, কখনো মানুষ স্বদ্যোগে ঘর ছাড়ে ভাগ্যান্বেষণে যার পর শুরু হয় এক অনিশ্চিত জীবনের অচেনা অধ্যায়। নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নতুন জীবনরীতি - সবমিলিয়ে এক অচেনা ভূবনে, অনিশ্চিত এক জীবন বেছে নিতে হয় অভিবাসী মানুষকে। নতুন পরিচয়ের মোড়কে গড়িয়ে চলে জীবন কিন্তু হৃদয়াভ্যন্তরে চলতে থাকে আত্মার নিরলস সংঘর্ষ। আধুনিক সভ্যতায় উদ্বাস্তু মানুষের এই সংঘাতসংকুল জীবন লে ক্লেযিও'র বহু রচনায় চিত্রায়িত হয়েছে মূল প্রতিপাদ্য হিসাবে।
জন্ম সূত্রে ফরাসী হলেও সেই শৈশব থেকে লে ক্লেযিও পরিব্রাজকের মতো ভ্রমণ করেছেন নানা দেশ, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যাপন করেছেন জীবন। তাঁর মতো পরিব্রাজক কথাসাহিত্যিক পৃথিবীতে আর নেই। তার রক্তে আছে মরিশাসে অভিবাসী পূর্বসূরীদের বীজ। অন্যদিকে শৈশবেই বাবার সঙ্গে নাইজেরিয়ায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। পরবর্তীতে থেকেছেন বিভিন্ন দেশে মেক্সিকো ও পানামা যার মধ্যে অন্যতম। পানামায় আদীবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তিনি উপলব্ধি করেছেন কীভাবে বৈশ্বিকরণের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত পরিচয় চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে লে ক্লেযিও অনুভব করেছেন কী নিবিড়ভাবে অভিবাসী মানুষের আত্মা স্বদেশের মাটিতে, পরিত্যাক্ত পরিবারের চৌহদ্দিতে, পূর্ব পুরুষদের স্মৃতির গহনে শেকড় মেলে থাকে। এই অভিজ্ঞতার প্রণোদনায় উদ্বাস্তু মানুষের নিরালম্ব জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিকটি তিনি তাঁর রচনায় ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। অনেক রচনার মধ্যে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত "ডেস্যার" (ডেসার্ট - মরুভূমি) এবং ১৯৯২-এ প্রকাশিত "ইতোয়াল এরান্ত" (ওয়ানডারিং স্টার - ভেসে চলা নক্ষত্র) উদ্বাস্তু নিরালম্ব মানুষের বিশ্বস্ত উপখ্যান।
৩
ভীন দেশী সংস্কৃতির প্রতি ব্যাপারে লে ক্লেযিও'র আগ্রহ গভীর। বিশেষ করে আফ্রিকার ইতিহাস ও উত্তর আফ্রিকার অভিবাসী মানুষের মানবেতর জীবন তাঁকে ভাবিয়েছে। তার লেখায় উত্তর আফ্রিকা ও ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক বিভেদ উচ্চকিত। তাঁর "ডেস্যার" উপন্যাসে মরক্কো ও ফ্রান্স, "ওনিতশা"-তে নাইজেরিয়া, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স, "ইতোয়াল এরান্ত" উপন্যাসে ফ্রান্স ও প্যালেস্টাইন এবং "লে শারশা দো" উপন্যাসে মরিশাস ও ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক বিভেদ ও তজ্জনিত মানবিক বৈষম্য অন্যতম মূল উপজীব্য। তবে একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন যে ভীনদেশী সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে তুলে ধরার ব্যাপারে সব লেখকেরই সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। তবে যদি আত্ম-সচেতনতা থাকে, থাকে পক্ষপাতহীনতা ও বিনয়, তবে একজন লেখক আধুনিক বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, উত্তর-ঔপনিবেশী সম্পর্ক এবং মানুষের আত্মপরিচয় নিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে বিশ্বমানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব পারনে সক্ষম।
ভাবলে অবাক হতে হয় যে লে ক্লেযিও'র সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাস "ডেস্যার" (ডেসার্ট- মরুভূমি) নোবেল পুরস্কার পূর্বপর্যন্ত ইংরেজীতে অনূদিত হয়নি। অথচ আধুনিক সভ্যতার উন্মূল, উদ্বাস্তু মানুষের যে নি:শব্দ আহাজারি তার এক অপূব নিদর্শন এই উপন্যাস। অবৈধ অভিবাসীর দৃষ্টিতে পশ্চিমা সভ্যতার খোলস খুলে নিয়েছেন লে ক্লেযিও এ উপন্যাসে।
উপন্যাসটির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র লায়লা। তার আলজেরীয় পূর্বপুরুষেরা ফরাসীদের আক্রমণে মরক্কোর রিও ডি ওরো মরুভূমির উত্তর থেকে দক্ষিণে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু রেহাই পায়নি গণহত্যা থেকে। তবে লায়লা বেঁচে গিয়েছিল কোনক্রমে। সমুদ্রবর্তী বিরাট এক শহরের সন্নিকট ক্ষুদ্র এক বস্তিতে এই মুসলমান যুবতীর জীবন সর্বদাই দুটি তলে বয়ে চলে। জীবনসংগ্রামের অবতলে তাকে সর্বদা ধাওয়া করে পূর্বপুরুষদের গহন সঙ্গীত।
মরুসন্তান লায়লা। এক মূক রাখালের সংসর্গ তাকে গর্ভবতী করে, যার নাম হারতানি। ভাঙ্গাচোরা একটি হোটেলে কাজ করে লায়লা। তারপর একদিন জীবন পাল্টে যায়। এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে সে হয়ে ওঠে আধুনিক 'মডেল'। পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদে তার ছবি মুদ্রিত হতে থাকে। কিন্তু ফেলে আসা মরুভূমি তার অবচেতনে প্রলোভনী গান গেয়ে চলে। মানুষের গড়া নরক থেকে মুক্তি পেয়ে একদিন আপন আশ্রয়ে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখে সে সর্বদা।
লে ক্লেযিও কেবল ভিন্ন ধারার লেখক নন, তাঁর রূপবন্ধ ও ভাষাশৈলী বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই সূত্রে "ডেস্যার" থেকে একটি উদ্বৃতি দেয়া যেতে পারে: "... একটি জায়গা আছে যেখানে যেতে ভালোবাসে লায়লা। সেখানে যেতে সাগর ছেড়ে ধরতে হয় সোজা পূব দিকের পথ এবং মরা নদীর বালুবেলা পার হয়ে যখন পাথুরে পাহাড়গুলো চোখে পড়ে তখন লাল পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় আর অনুসরণ করতে হয় ভেড়ার পালের হাঁটাপথ। মাথার ওপর সূর্য জ্বলছে কিন্তু বাতাস বইছে বরফঠান্ডা কেননা তা আসছে এমন দেশ থেকে যেখানে কোন গাছ বা পানি নেই, বাতাস বইছে মহাশূন্যের তলদেশ থেকে। এখানেই থাকে সেই যুবক লায়লা যাকে 'সঙ্গোপন' বলে ডাকে কেননা তার নাম কী কেউ তা জানে না।
সাদা পাথরের একটি বড়-সড় ডিবির কাছে পৌঁছালো সে, যার ব্যাপ্তি দিগন্ত ছাড়িয়ে প্রায় আকাশের কাছাকাছি বিস্তৃত। চারদিকে ধাঁধানো আলো, শীতল বাতাসের ঝাপটায় ঠোঁট ফেটে যায় আর চোখে পানি ভ'রে ওঠে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে লায়লা। তার হৃৎপিন্ড লাফিয়ে কণ্ঠ অবধি ওঠে, কপালে শিরা দপদপ করে যতক্ষণ না লাল অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়ে আকাশ আর শোনা যায় অনেকগুলো অচেনা কণ্ঠস্বরের শোরগোল।
তখন সে সামনে পা ফেলে, সেখানে - যেখানে বিচ্ছু আর সাপখোপের বাসা। আর কোন পথ নেই, কেবল ভাঙ্গা প্রস্তর খন্ড যার প্রান্তগুলো চাকুর মতো চোখা। আলো ঝলসাচ্ছে, কোন বৃক্ষ নেই, নেই কোন তৃণচত্বর, কেবল মহাশূন্যের কেন্দ্র থেকে ধেয়ে আসছে বাত্যপ্রবাহ।
এখানেই যুবকটি কখনো-কখনো তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে চেনে না তাকে, জানে না কী তার ঠিকানা। কখনো তাকে দেখে ভয় ধরে, কখনো সে কোমল ও প্রশান্ত, স্বর্গীয় সৌন্দর্যে রূপবান। সে শুধু তার চোখ দুটো দেখতে পায় কারণ তার মুখাবয়ব বেদুঈন যোদ্ধার ন্যায় অবগুণ্ঠিত। তার গায়ে সাদা আলখাল্লা যা সূর্যের আলোয় স্ফটিকের মতো ঝকঝকে। নীল পাগড়ীর ছায়ায় তার চোখ দুটি জ্বলে আর লায়লা তার মুখ ও দেহের ওপর অনুভব করে তার দৃষ্টির উত্তাপ অগ্নিকু-ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় যেমন লাগে। ..." ["ডেস্যার"]
এই বর্ণনা ক্যামেরাধৃত ছবির মতো বিশদ, আবার সেই সঙ্গে এর ভাষা কাব্যিক ও কুয়াশাচ্ছন্ন। এ উপন্যাসে লে ক্লেযিও কেবল নির্বাসনের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেন নি, অভিবাসন এবং নির্বাসন মানুষের জন্য যে পরিচয় সংকট সৃষ্টি করে তার ওপর নিবিড়ভাবে আলোকপাত করেছেন। অভিবাস মানেই নতুন ভাষা, নতুন সমাজ ব্যবস্থা, নতুন আইন, বিশ্বাস ও জীবনরীতি। অভিবাসী জানে যে সংখ্যালঘু, তাই তার জাতিচেতনা তীব্র হয়ে ওঠে। সে জানে সে অনাকাক্সিক্ষত, তাই সে প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে পরিত্যাক্ত দেশে, পরিবারে, সমাজে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুতি তীব্র হয়ে ওঠে হ্রদয়াভ্যন্তরে।
৪.
লে ক্লেযিও'র পুরো নাম জঁ-মারি গুস্তাভ লে ক্লেযিও হলেও তাকে স্রেফ 'জে. এম. জি.' বলেই সম্বোধন করেন অনেকে। তার প্রথম গ্রন্থ "লে প্রসে-ভেরবাল" (ইন্টারোগেশান ─ সওয়াল-জওয়াব) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে যখন তাঁর বয়স সবে ২৩। প্রথম হলেও এই উপন্যাসটিতে একজন পরিণত ও শক্তিমান এবং প্রথাবিরোধী লেখকের সব চিহ্নই অবধৃত ছিল যা সমালোচকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। পশ্চিমী জীবন দর্শনের বিরূদ্ধে প্রথম গ্রন্থেই অবস্থান নিয়েছিলেন তরুণ লে ক্লেযিও। প্রথম গ্রন্থটিই লাভ করেছিল ফরাসী সাহিত্যের একটি মর্যাদাবান পুরষ্কার। তার লেখনী আর থামেনি। ২০০৮ সালে নোবেল প্রাপ্তির কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় "রিতুরনেল দে লা ফেম" (রিফ্রেইন ফ্রম হাঙ্গার- ক্ষুধা দাবিয়ে রাখো) যা পরিণত বয়সে রচিত খুব জনপ্রিয় একটি উপন্যাস।
লে ক্লেযিও স্বভাবগতভাবে গম্ভীর ও খানিকটা নিভৃতিপরায়ণ। মজার কথা ১৯৭৮ পর্যন্ত তিনি তাঁর কোন ক্লোয-আপ ফটো তুলতে দিতেন না ─ ফটোগ্রাফারকে অন্তত: তিরিশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হতো। তবে সাক্ষাৎকার দিতে বা রেডিও-টেলিভিশনের সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে তিনি অনীহা দেখান নি কখনো। এমনকী ৮ অক্টোবর ২০০৮ মধ্য-ইয়োরোপীয় সময় দুপুর ১টায় নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেও রেডিও ফ্রান্সের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারে লে ক্লেযিও বলেছিলেন, তিনি চিন্তা করেন ক্রেওল ভাষায় আর লিখেন ফরাসীতে।
পরিণত বয়সেও লে ক্লেযিও যুবকের মতো নির্ভার, ঋজু এবং অকুণ্ঠ। বয়স তাকে বার্ধক্যের শৃঙ্খলে বাঁধতে পারেনি এখনো। তার জনপ্রিয়তা এখনও ব্যাপক। তার জনপ্রিয়তার নানা কারণ আছে। প্রাসঙ্গিক হবে যে সেই ১৯৯৪-এ গৃহীত একটি পত্রিকার সমীক্ষায় জীবিত ফরাসী লেখকদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ বলে জনগণ রায় দিয়েছিল। কিন্তু কেবল লেখক হিসাবেই নয়, একজন প্রতিবাদী মানুষ হিসাবেও তিনি ফরাসীদের প্রিয়ভাজন। সাধারণের কাতারে প্রয়োজনে নিঃসংকোচে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে একটি আইন পাসের উদ্যোগ নেয়া হয় যে কেউ কোনো অবৈধ অভিবাসীকে আশ্রয় দিলে তা সরকারকে জানাতে ফ্রান্সের নাগরিক বাধ্য থাকবে। তিনি এই আইনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন।
বিংশ শতকের আধুনিক বিশ্বজীবনের গভীর সত্যকে আলিঙ্গন করেছেন লে ক্লেযিও ভাষা ও কাঠামোর সুঠাম শৈলীতে। তার লেখায় বাস্তবতার নিবিড় উপলব্ধির সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে সমৃদ্ধ কল্পনার জারক। ফলে তার লেখনী একই সঙ্গে সত্যাশ্রয়ী ও রমণীয়। দেশ, জাতিসত্বা, ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি ভেদে যে অভিন্ন মানব সত্বা সর্বত্র বিরাজমান তারই অন্তর্লীন সমধর্মীতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন লে ক্লেযিও বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। আবার রূঢ় বাস্তবের চিত্রায়নের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের সুখ-ঝলমল স্বপ্নের ব্যাপারেও তিনি সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
Comments