স্মরণে নয় যাপনে তুমি জাহিদুর রহমান পিপলু
১৯৮৮ সাল। এরশাদ ভ্যাকেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ, বন্ধ সেখানে সব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। লোক নাট্যদল বসে লাকী ভাইয়ের কাজী অফিস গলির বাসায়। নতুন নাটক বের্টোল্ড ব্রেখটের 'বিধি ও ব্যতিক্রম'র মহড়া চলছে। এক বিকেলে আসলাম শিহির মহড়ায় এলো এক বন্ধুকে নিয়ে। বন্ধুটির পরনে ক্রিকেটের সাদা পোশাক, কাঁধে ব্যাগ, হাতে ব্যাট। মঞ্চনাটকে তার নাকি খুব আগ্রহ।
নাম তার পিপলু, জাহিদুর রহমান পিপলু। গানের গলা চমৎকার। প্রথম দিনেই তাকে বসিয়ে দেওয়া হলো নতুন নাটকের গানের মহড়ায়। সেই থেকে পিপলুর যাত্রা শুরু লোক নাট্যদলে, সম্পর্কের শুরু আমার সঙ্গেও। প্রায় ৩৬ বছরের সেই যাত্রা আর সম্পর্কের যতি টেনে গত ১৮ নভেম্বর অদম্য পিপলু ক্যানসারের কাছে হার মেনে যাত্রা শুরু করে অনন্তের পথে। পিপলুকে স্মরণ করে আমাকে কিছু বলতে বা লিখতে হবে, তাও এতো তাড়াতাড়ি—দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। হায় রে জীবন!
সারাদিন ক্রিকেট আর বিকেলে মহড়া। মহড়ায় দারুণ মনোযোগী। পিপলুর চমৎকার সুরেলা কণ্ঠ লাকী ভাইকে মুগ্ধ করে। তাকে এই নাটকে যুক্ত করেন। অল্প সময়েই লোক নাট্যদলের সবার আপন হয়ে ওঠে পিপলু। ১৯৮৯ সালে পিপলু অভিনীত প্রথম নাটক 'বিধি ও ব্যতিক্রম' মঞ্চে আসে। পরপরই আসে মনোজ মিত্রের নাটক 'টাপুর টুপুর'। অভিনয়ে এবং দলের কাজে আরও জড়িয়ে যায় পিপলু। তার নান্দনিক ভাবনা ও সৃষ্টির তীব্র উন্মাদনার কারণে লোক নাট্যদলের পরবর্তী নাটক ইউরিপিডিসের 'হেলেন'এ পিপলু ও আমাকে যৌথভাবে পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে বলি, দলের অর্থ কম থাকায় নীলক্ষেতের ফুটপাতের এক বয়স্ক দর্জির কাছে পোশাক বানাতে হয়। পোশাকের ডিজাইন শতবার বোঝালেও দর্জি যখন বোঝে না, তখন পিপলু নিজেই কাপড় কেটে দেয়, কিভাবে সেলাই করতে হবে তা দেখিয়ে দেয়। ১৯৯০ সালে মঞ্চে আসা 'হেলেন' নাটকের পোশাক আলোচিত হয়। আর টিউসার চরিত্রে পিপলুর অসাধারণ গেটআপ ও অভিনয় বিপুল প্রশংসিত হয়। লোক নাট্যদলেও আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পিপলু।
'কঞ্জুস' ১৯৯০ সালে নতুন করে আবার মঞ্চে আসে। এতে পিপলু প্রথমে ফচলু চরিত্রে এবং পরবর্তীতে কাযিম চরিত্রে টানা ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয় শতাধিক প্রদর্শনীতে অভিনয় করে। কাযিম চরিত্রে তার দুর্দান্ত অভিনয় ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটা মাইলফলক।
১৯৯১ সালে লোক নাট্যদল মঞ্চে আনে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি'। সহজ সরল বোকা দরিদ্র জেলে গনেশ চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে পিপলু। শুধু পিপলুর চমৎকার গানের গলা থাকায় নির্দেশক গনেশের জন্য একটা গান দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কার্জন হলের মহড়া কক্ষে মোস্তফা আনোয়ার স্বপন তাৎক্ষনিক লিখলেন এবং সঙ্গীত পরিচালক মুজাহিদুল হক লেনিন সুর করলেন পিপলুর জন্য গান 'মন কান্দে গো যে বন্ধুর লাইগ্যা, তারে নাহি পাই....'। পিপলুর দরদী কণ্ঠে গভীর আবেগে গাওয়া এই গান নাটকে আলাদা একটা মাত্রা যোগ করে। শেষের দিকে বেশ কয়েকটা প্রদর্শনীতে পিপলু কুবের চরিত্রেও অভিনয় করে। এই নাটকেও পিপলু ও আমি যৌথভাবে পোশাক পরিকল্পনা করি।
১৯৯৩ সালে সম্পূর্ণ গাননির্ভর ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে 'সোনাই মাধব' নাটকে নিজেকে আরও বেশি করে প্রকাশ করার সুযোগ পায় পিপলু। মঞ্চ ব্যবস্থাপনা ও মঞ্চ পরিকল্পনার পাশাপাশি গ্রন্থিক ও বাঘরা চরিত্রে তার হৃদয় ছোঁয়া গান, নাচ ও অভিনয় দর্শক হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। কয়েকটা প্রদর্শনীতে দেওয়ান ভাবনা চরিত্রেও অভিনয় করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লোক নাট্যদল আমার নির্দেশনায় মঞ্চে আনে 'বৈকুণ্ঠের খাতা'। এ নাটকে ৬০ বছরের বৃদ্ধ বৈকুণ্ঠ চরিত্রে পিপলুর অভিনয় ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জে কী দারুণভাবেই না সফল হয়েছে সে। নাটকে পিপলুর সেট ডিজাইনও হয় খুবই নান্দনিক ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ ছাড়া, বুদ্ধদেব বসুর 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী', 'নির্মূল', 'রয়েল বেঙ্গল টাইগার', 'নির্মাণ' নাটকে অভিনয় করে পিপলু।
২০১৬ সালে পিপলু প্রথমবারের মতো নির্দেশনা দেয় আবদুল্লাহ আল হারুন রচিত 'পরগাছা' নাটক। নাটকটি সুধীমহলে বেশ আলোচিত হয়। ২০১৮ সালে মঞ্চে আসা উৎপল দত্ত রচিত 'ঠিকানা' নাটকের নির্দেশক যখন শারীরিক অসুস্থতার জন্য নির্দেশনার কাজটি শেষ করতে পারছিল না, তখন পিপলু নির্দেশনার দায়িত্বটি নিজের কাঁধে নিয়ে সফলভাবে নাটকটি মঞ্চে উপস্থাপনা করে। 'ঠিকানা'র চমৎকার মঞ্চ পরিকল্পনাও তার।
সহজে সবাইকে আপন করার সহজাত গুণটি পিপলুকে অনন্য করেছে। দলের সবচেয়ে জুনিয়র থেকে সিনিয়র সদস্যের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ। জুনিয়রদের কাছে বিরাট এক ভরসার নামও পিপলু। কারিগরি কোনো সমস্যায় কেউ আটকে গেলে পিপলুর কাছে তার তড়িৎ সমাধান। দেশের বাইরে বা ঢাকার বাইরে শো করতে গেলে দেখা যায় অনেক মঞ্চই অভিনয়ের উপযোগী নয়। কিন্তু পিপলুর কারিশমায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তা যথার্থ মঞ্চের রূপ ধারণ করে। এ রকম অনেক ঘটনার একটি এখানে উল্লেখ করি। ২০১৮ সালে ত্রিপুরার বিলোনিয়ায় 'বৈকুণ্ঠের খাতা'র ৩টি প্রদর্শনী করার আমন্ত্রণ পাই। বলতে গেলে সেখানকার কোনো মঞ্চই নাটক মঞ্চায়নের উপযুক্ত নয়। এমন হয়েছে, একটা সিমেন্টের বেদীর মতো নিরাভরণ মঞ্চ, কোনো উইংস বা লাইট লাগানোর ফ্রেম বা ফ্লাই কিছুই নেই। দলের ছেলেদের সঙ্গে আমিও চরম হতাশ। পিপলু সবাইকে ডেকে নিয়ে বাঁশ-কাঠ-কাপড় যোগাড় করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চমৎকার মঞ্চ তৈরি করে ফেলে এবং সেখানে সফল মঞ্চায়ন করি। মঞ্চনাটকের কারিগরি জ্ঞান তার অসামান্য।
নাটকের বিভিন্ন শাখায় শেখার আকাঙ্ক্ষাটা পিপলুর বরাবরই তীব্র। দেশের ও বিদেশের প্রখ্যাত নাট্যজনদের অভিনয় ও সেট ডিজাইনের উপর অনেক কর্মশালায় অংশ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে অংশ নিতে হংকং ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অনেকগুলো এলাকা সফর করেছে। লোক নাট্যদলের অধিকাংশ নাটকের সহস্রাধিক প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছে পিপলু। লোক নাট্যদলে যোগ দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই সাংগঠনিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে পিপলু। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত 'পিপলস্ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং থিয়েটার ব্যাংকের সচিব। লোক নাট্যদলের সব ধরনের সিদ্ধান্তে তার থাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছে। সর্বশেষ দলের অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছে পিপলু।
দুজনের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা বোঝাপড়া খুব কাছাকাছি থাকায় আমার আর পিপলুর মাঝে সখ্যতাটা অন্যদের তুলনায় একটু বেশি। লোক নাট্যদলে সবার কাছে নূর-পিপলু একটা জুটি। আমরা জুটি বেঁধে 'হেলেন' ও 'পদ্মা নদীর মাঝি'র পোশাক পরিকল্পনা ও তৈরিতে কাজ করেছি, তেমনি সেট বা সজ্জা বা ট্যুর পরিকল্পনার কাজ করেছি।
লোক নাট্যদলের প্রায় সব ট্যুরে বাসে বা ট্রেনে আমি আর পিপলু পাশাপাশি আসনে। সব ট্যুরেই আমরা রুমমেট। এক সময়ে পিপলু মাস্টার্স করতে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে আমার ক্লাসে। আমরা হয়ে যাই ক্লাসমেট। ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, দলের মহড়ায়, মঞ্চে, গ্রিনরুমে আমাদের সম্পর্কের বন্ধন হয় আরও দৃঢ়।
পরীক্ষার সময়গুলোতে পিপলু আমার সাথে সলিমুল্লাহ হলে এসে উঠে। রাতে হলের সরু খাটে চাপাচাপি করে আনন্দে ঘুমাই দুজন। মাঝে মাঝে পিপলু আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। ওর পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচয় হয়। একটা সময়ে লোক নাট্যদলের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের সম্পর্ক দুজনের পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দুই পরিবার এক অপরের সুখ-দুঃখের সাথী হই। নূর আর পিপলু কখন যেন একে অপরের আত্মার অংশ হয়ে যাই। হাসি-ঠাট্টা-আড্ডা-আনন্দ-বেদনায় কেটে যায় আমাদের ৩৬ বছর।
'বৈকুণ্ঠের খাতা'র ৫০তম মঞ্চায়নের কয়েকদিন আগে পিপলুর গলায় ভীষণ ব্যথা আর কাশি। আমিসহ দলের সবাই উদ্বিগ্ন। পিপলু এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বৈকুণ্ঠ। তাকে ছাড়া মঞ্চায়ন সম্ভব নয়। পিপলু আমাকে অভয় দিলো শো'র আগে শরীর ঠিক হয়ে যাবে। পুরোপুরি সুস্থ না হলেও শো'র আগে ৩ দিনই মহড়ায় অংশ নেয় এবং হল ভর্তি দর্শকের সামনে ২০২২ সালের ১৯ আগস্ট ৫০তম মঞ্চায়নে দুর্দান্ত অভিনয় করে। তুমুল করতালিতে মুখর হয় মিলনায়তন।
কে জানতো—ওটাই একজন শক্তিমান অভিনেতা জাহিদুর রহমান পিপলুর জীবনের শেষ মঞ্চাভিনয়!
কেন পিপলু, কী এমন তাড়া তোমার? আমার নির্দেশিত নতুন নাটক 'সুন্দর' তো তুমি এখনো দেখোইনি! লোক নাট্যদলের পরবর্তী নাটক না তুমি নির্দেশনা দেবে বলেছিলে? তাহলে? তুমি বিহীন আমি বা আমরা মঞ্চে দাঁড়াবো কী করে পিপলু? তোমার গাওয়া গান যে আজ আমার গান 'মন কান্দে গো যে বন্ধুর লাইগ্যা, তারে নাহি পাই....'।
ঘুমাও তুমি শান্তিতে হে আমার আত্মার আত্মীয়।
কামরুন নূর চৌধুরী; অভিনেতা, নির্দেশক ও সাধারণ সম্পাদক, লোক নাট্যদল
Comments