রাসায়নিক ছাড়াই যেভাবে মশামুক্ত হলো মালদ্বীপের এই দ্বীপ
ধরুন আপনি কোথাও ঘুরতে গেছেন, নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন কিংবা উঠছেন পাহাড়ে। এমন সময় যদি কানের কাছে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে মশারা গান শোনায়, ভালো লাগবে? নিশ্চয়ই না। উপরন্তু ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া কিংবা জিকার মতো ভয়ঙ্কর ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির বর্তমান চিত্র বেশ খারাপ। চলতি বছর এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৬১০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া, এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ লাখ ১০ হাজার ৪৬ জন। মশার হাত থেকে নিস্তার পেতে সরকারি কোনো উদ্যোগই তেমন কাজে আসছে না।
এই অবস্থায় আপনাদের যদি বলা হয় সম্পূর্ণ মশাশূন্য এক দ্বীপের কথা, হয়ত অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু সত্যিই কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে মশার 'ম' পর্যন্ত মুছে ফেলেছে মালদ্বীপের কুনফুনাধো দ্বীপের রিসোর্ট 'সোনেভা ফুশি'। তাও আবার কোনো রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে।
কিন্তু তারা কীভাবে করল এই অসাধ্য সাধন? চলুন জেনে আসা যাক-
জার্মানভিত্তিক কোম্পানি বায়োজেন্টস-এর সঙ্গে মিলে সোনেভা তৈরি করেছে মশা ধরার ফাঁদ। এজন্য স্থানীয় নানা উদ্ভিদকে তারা কাজে লাগিয়েছে।
সোনেভার সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা বিষয়ক পরিচালক আর্নফিন ওইনেস জানান, কোনো রাসায়নিক ব্যবহার না করেই তারা মশা নিধনের উপায় খুঁজছিলেন।
একসময় দ্বীপটিতে মশা ছিল প্রচুর। বিশেষ করে মে থেকে নভেম্বরের মধ্যে বর্ষা মৌসুমে মশার প্রজনন অনেক বেড়ে যেত।
মশার বংশবিস্তার রোধে তারা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন, ফাঁদ পেতেছিলেন, তবে সেভাবে কাজে দিচ্ছিল না এসব।
এর বাইরেও তারা 'হট ফগিং' কিংবা 'মিস্ট ব্লোয়িং' এর মতো পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখেছিলেন। ওইনেসের ভাষ্যমতে, মশা নিধনের জন্য কোনো কীটনাশক ব্যবহার করেননি তারা। পর্যটকদের অস্বস্তির বিষয়টিও তাদের মাথায় ছিল, যে কারণে তাদের বিরক্তির কোনো কারণ তারা তৈরি করতে চাননি।
তিনি জানান, প্রচলিত এই পদ্ধতিগুলো কেবল প্রাপ্তবয়স্ক মশা নিধনের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায়। রাসায়নিকে সাময়িক কাজ হলেও দীর্ঘমেয়াদে কাজ করে না। বরং রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কুনফুনাধো দ্বীপের অন্যান্য পতঙ্গ, যেমন: মৌমাছি, প্রজাপতি ও ফড়িঙয়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছিল।
সোনেভা তাদের এই 'বায়োজেন্টস' পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ করে ২০১৯ সালে। পুরো দ্বীপজুড়ে ভিন্ন দুই ধরনের ৫০০টির মতো ফাঁদ পাতা হয়। প্রথম ধরনটির নাম 'বিজি-গ্যাট', যা 'টাইগার' মশা ধরতে ব্যবহার করা হয়। 'টাইগার' মশা হলো- যারা ইতোমধ্যে কারও রক্ত পান করেছে ও ডিম দেওয়ার জন্য জায়গা খুঁজছে।
দ্বিতীয় ধরনটি 'বিজি-মসকিউটায়ার সিও২'। যেসব মশা রক্ত খুঁজছে সিও২ তথা কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে তাদের ফাঁদে ফেলা হয়। ইস্ট ও চিনি ব্যবহার করে গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ল্যাকটিক এসিড, যা মশারা মানবদেহের ত্বক ভেবে ভুল করে।
ওইনেস জানান, 'বিজি-মসকিউটায়ার সিও২' কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার ও মানুষের ঘামের গন্ধ তৈরি করে মশাকে আকৃষ্ট করে। এতে প্রতিদিন হাজারো রক্তসন্ধানী মশা ধরা পড়ে তাদের ফাঁদে।
এই দুই ধরনের ফাঁদ ব্যবহারের পাশাপাশি, রিসোর্টটি তাদের কর্মীদের মশার বাস্তুসংস্থান সম্পর্কেও সম্যক ধারণা দিয়েছে। এখন সোনেভা টিম পুরো দ্বীপেই তল্লাশি চালিয়ে দেখতে পারে যে, কোথাও পানি জমে আছে কি না বা পানি জমতে পারে এমন কিছু কোথাও পড়ে আছে কি না। কেননা স্থির পানিতে এডিস মশাসহ অন্যান্য কীট-পতঙ্গের বংশবিস্তারের সম্ভাবনা থাকে।
সোনেভা মনে করছে, এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা বেশ সফল হয়েছে। তাদের চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক বছরে মশার বংশবৃদ্ধি শতকরা ৯৮ ভাগ কমে এসেছে।
ওইনেস বলেন, 'আমরা প্রতিদিন ফাঁদে পড়া মশার সংখ্যা গুনতাম, তবে ধীরে ধীরে গণনার কাজটি সহজ হয়ে গেল, কারণ মশার সংখ্যা দিন দিন কমে যেতে থাকল। যেসব অতিথিরা প্রতি বছরই এখানে আসেন, তারাও আমাদের কাজের খুব প্রশংসা করেছেন।'
মশা নিধনে 'বায়োজেন্টস' ফাঁদ পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদেও কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে, কেননা এই পদ্ধতির সঙ্গে কীটদের মানিয়ে নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। উপরন্তু রাসায়নিকের ব্যবহার কমে যাওয়ার ফলে মালদ্বীপের স্থানীয় পতঙ্গগুলোর সংখ্যাও ফের বাড়তে শুরু করেছে।
ওইনেস বলেন, 'প্রাকৃতিক পরাগবাহী পতঙ্গেরা আবার ফিরছে। তার মানে আরও বেশি ফুল-ফল উৎপাদন হবে। ফল আর কীটের সংখ্যা বাড়লে পাখির সংখ্যাও বাড়বে। এর ফলে কুনফুনাধোর তীরে আবারও অনেক পাখি ভিড় জমাবে, রাতে জোনাকির মেলা বসবে।'
পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উন্নতির এই ভাবনা অবশ্য জড়িয়ে আছে রির্সোটটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গেই। ১৯৯৫ সালে সোনু ও ইভা শিবদাসানি পরিবেশের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই রিসোর্টটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অঞ্চলে এই দম্পতির মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ, শক্তি সংরক্ষণ ও বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটে।
বর্তমানে আতিথেয়তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি বর্জ্য ও কীটনাশক থেকেও সচেতন দূরত্ব বজায় রেখে উদাহরণ তৈরি করেছে সোনেভা ফুশি।
বায়োজেন্টস-এর সঙ্গে পরিবেশবান্ধব মশা নিধন কর্মসূচির মাধ্যমে মালদ্বীপের প্রথম মশামুক্ত দ্বীপের স্বীকৃতি চায় সোনেভা। কিন্তু তারা এখানেই থেমে যেতে চায় না।
রাজধানী মালেতে অবস্থিত মালদ্বীপের সংসদেও মশা ধরার ফাঁদ পাঠিয়েছেন তারা, পাশাপাশি সেখানকার কর্মীদের শিখিয়েছেন এর ব্যবহারবিধি।
এ ছাড়া, কাছেই নোন্যু আটোলে অবস্থিত মেধুফারু দ্বীপে থাকা তাদের ব্রান্ড রিসোর্ট 'সোনেভা জানি'-তেও বায়োজেন্টস পদ্ধতি প্রয়োগ করে একইরকম ফল পেয়েছেন তারা। ২০২৪ সালে চালু হতে যাওয়া নতুন রিসোর্ট 'সোনেভা সিক্রেটেও' এই ফাঁদগুলো ব্যবহার তারা দেখেছেন যে, টানা কয়েক মাস ধরে সেখানে আর কোনো মশা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ওইনেস বলেন, 'নতুন বছরে মশামুক্ত একটি রিসোর্ট চালু করতে পারার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। অন্যান্য রিসোর্টগুলোও আমাদের অনুসরণ করছে। খুব সুখের ব্যাপার হবে যদি পুরো মালদ্বীপই এটি করে।'
তথ্যসূত্র: সিএনএন
গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়
Comments