পর্যালোচনা

অন্য এক সুফিয়া কামালের ছায়া

মহিলা কবি হিসেবে নয়, সুফিয়া কামাল নিজের অবস্থান নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের প্রধান সারির কবি হিসেবে। শুধু কবি হিসেবেও নয়, সমাজসেবক হিসেবেও অগ্রগামী। নারীমুক্তি আন্দোলন থেকে তার অবদান মুক্তবুদ্ধিচর্চা, মানবাধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত। ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে স্বদেশের নানা প্রয়োজনে তিনি সোচ্চার থেকেছেন, প্রয়োজনে রাজপথে নেমেছেন অধিকার আদায়ের দাবিতে।
 
তার জীবনকাল পরিব্যাপ্ত ছিল প্রায় ৯০ বছর। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি দেহত্যাগ করেন। দীর্ঘজীবনে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, শেরে বাংলা, সোহারাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ গত শতাব্দীর প্রায় সব যুগপুরুষকেই। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে বোন বানিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়াও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বড়বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। দেশভাগোত্তর পূর্ববাংলার অনেক কবি, সাহিত্যিকই তার, স্নেহ-মমতা সান্নিধ্য পেয়েছেন। সব মিলিয়ে  কালের সাক্ষী সুফিয়া কামাল।

আলোচ্য গ্রন্থ 'সুফিয়া কামাল: অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্য' প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালে। ২০১১ সালে সুফিয়া কামালের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বইটির নতুন সংস্করণ। বইটির প্রযত্নে ছিল প্রাবন্ধিক-গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী। শতবার্ষিক সংস্করণে সুসম্পাদনার পাশাপাশি অসামান্য একটি ভূমিকা লিখেছেন। আলাপচারিতার পাশাপাশি বইটিতে রয়েছে চিঠিপত্র, জীবনপঞ্জি এবং সুফিয়া কামালের গ্রন্থপঞ্জির তালিকা।

চিঠিপত্র অংশে আছে 'সওগাত'-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজলসহ মেয়ে সুলতানা কামাল এবং সাঈদা কামালকে লেখা সুফিয়া কামালের চিঠি। সুফিয়া কামালকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামেরও দুটো করে চারটি চিঠি আছে। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে আরও অনেক চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত তিনি সেসব হারিয়ে ফেলেছিলেন, সেটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেছেন সাক্ষাৎকারে।

উল্লেখিত সাক্ষাৎকারটি সত্যিই তেমন অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্যের মধ্য দিয়েই সুফিয়া কামাল কথা বলেছেন। প্রশ্নকর্তা আবুল আহসান কবির জীবনের শুরু থেকেই জানতে চেয়েছেন, এবং প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামালের জীবনের গভীর বিষয়গুলোই তুলে আনতে চেয়েছেন। ২৭ পৃষ্ঠা থেকে ৮০ পৃষ্ঠা অবধি সাক্ষাৎকারের ব্যাপ্তি হলেও বলতেই হয় সুফিয়া কামালে দীর্ঘজীবনের তুলনায় সাক্ষাৎকারটি খুব ছোটই। এত বড় জীবন অবশ্য একটি সাক্ষাৎকারে তুলে আনাও সম্ভব নয়, তাও এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামালের মানসলোকের অনেকখানিই প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথমেই আবুল আহসান চৌধুরী জানতে চেয়েছিলেন সুফিয়া কামালের জন্ম, পরিবার, পরিবেশ নিয়ে। কথার পিঠে কথায় সুফিয়া কামাল বিস্তৃতভাবে সেসবের উত্তর দেন। তিনি বলেন ১৯১১ সালের কোনো এক মাসে তাঁর জন্ম, মাস-তারিখ মনে নেই, সেটা ২০ জুন বলে চালু হয়ে গেছে। তার পিতৃভূমি ত্রিপুরায়, কিন্তু, বড় হয়েছেন বরিশালে, মায়ের বাপের বাড়িতে। মায়ের বাপের বাড়ি ছিল সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার। পরিবারটির হালচালন, চালচলন, শিক্ষাদীক্ষা সবই অন্যরকম ছিল। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলা-ইংরেজির চল ছিল না বাড়িতে। তবে আরবি-ফার্সি-উর্দুর চর্চা ছিল। বাংলা শিখেছেন তিনি মায়ের কাছে। এক সময় নদীভাঙনে নানাবাড়ির সবই বিলীন হয়ে যায়। তারা কলকাতা পাড়ি জমান। সুফিয়া কামালের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। লেখাপড়া সবই বাড়িতে। বাড়িতে সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল। সেসময়ের সব পত্রিকাই বাড়িতে রাখা হতো। তার মামারা সবাই বেশ উচ্চশিক্ষিত ছিলেন।

আবুল আহসান চৌধুরী যখন জানতে চান সুফিয়া কামালের লেখালেখির শুরু কীভাবে তখন তিনি বলেন, মনের খেয়ালে হাবিজাবি লিখতে লিখতেই লেখার অভ্যাস হয়ে গেল। বিয়ে হয় ১১ বছর বয়সে, মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। বরিশালে তখন একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো- তরুণ। অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলেরা বের করেছিলেন। সেখানে তার স্বামী তাঁর একটি লেখা নিয়ে জমা দেন। অবাক করা বিষয়, সেটি কোনো কবিতা ছিল না, ছিল একটি গল্প। গল্পের নাম 'সৈনিক বধূ'। তখন তার বয়স তেরো- চৌদ্দ কি পনেরো। তরুণ-পত্রিকায় মাঝে মাঝে তিনি কবিতাও লিখতেন। তাতে বাড়িতে একটা দুর্নাম রটে গেল।

বড়মামা পছন্দ করলেন না বাড়ির কোনো মেয়ের নাম বাইরে প্রকাশিত হোক, তাও আবার বাংলা কাগজে। তার নানা একেবারে বারণ করে দিলেন। তিনিও লেখালেখি বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু, তার ছোটমামা তার একটি লেখার খাতা নিয়ে গেলেন ঢাকায়, অভিযান পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা দিলেন। কবি নজরুল তখন ঢাকায় এসেছেন, মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সম্মেলনে, কবিতা পড়ে তো তিনি একেবারে হৈহৈ করে উঠলেন, লম্বা- চওড়া মস্ত বড় একটি চিঠি লিখলেন সুফিয়া কামালকে, "মুসলিম মেয়ে এ রকম একটা কবিতা লিখেছে, এটা প্রশংসার কথা। এত সুন্দর কবিতা তোমার, প্রকাশিত হচ্ছে না, এটা বড়ই দুঃখের কথা।'

১৯২৬-২৭ সালের পর সুফিয়া কামাল পরিবারের সাথে কলকাতা চলে যান, সেখানেই একদিন তাদের বাড়িতে এসে হানা দেন কাজী নজরুল ইসলাম, একেবারে অন্দরমহলে ঢুকে যান, সুফিয়া কামালের মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করেন এবং সুফিয়া কামালকে বোন বলে সম্বোধন করেন। সুফিয়া কামালকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দেন এবং প্রতিদিন অন্তত একটি করে কবিতা লিখতে বলেন। কবিতা দিতে বলেন 'সওগাত' পত্রিকায়। সেই থেকেই সুফিয়া কামালের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি। ১৯৩০ সালে সওগাত-এর প্রথম মহিলা সংখ্যায় ছবিসহ তাঁর লেখা ছাপা হলো। সে-সময়ের প্রেক্ষাপটে এটা ছিল একটা প্রায় বৈপ্লবিক ঘটনা।

সাক্ষাৎকারের বেশ বড় অংশ জুড়ে আছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিজীবন, অসুস্থতার কথা, এমন কি নারী-সান্নিধ্যের কথাও উঠে এসেছে অন্তরঙ্গ আলাপে। পরবর্তীতে সুফিয়া কামাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও স্নেহ -সান্নিধ্য পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাকে নানাভাবে কাব্যচর্চায় উৎসাহিত করতেন। শান্তি নিকেতনে কোনো অনুষ্ঠান হলে তাকে নিমন্ত্রণ করতেন।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সুফিয়া কামালের নানা দিকে মিল। বেগম রোকেয়াও অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন, লেখাপড়া শিখেছিলেন নিজের ও স্বামীর উৎসাহে, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। বেগম রোকেয়ার সান্নিধ্য সুফিয়া কামালের মধ্যে অন্যরকম এক আগুন জ্বালিয়ে দিল। বেগম রোকেয়ার উৎসাহেই তিনি বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে নারীশিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আবুল আহসান চৌধুরী ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, "সুফিয়া কামাল বেগম রোকেয়ার কাছে দীক্ষা পেয়েছিলেন সমাজের কাজে, রবীন্দ্র-নজরুলের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন সাহিত্যচর্চার, আর লেখার জগতে বিকশিত হয়ে ওঠেন সওগাত-এর সৌজন্যে।"

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সুফিয়া কামাল ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তার লেখালেখিতে সাময়িক বিঘ্ন ঘটে। কারণ, তার লেখালেখির জীবন ছিল কলকাতাতেই। সেখানেই সুযোগ-সুবিধা বেশি পেয়েছেন। ঢাকায় তখন ভালো পত্রপত্রিকাও ছিল না। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সাহিত্যচর্চার জন্য ভালো পত্রিপত্রিকা খুব দরকার। 

ঢাকায় তখন একটার পর একটা আন্দোলন। বাংলাভাষা আন্দোলন চলছে পুরোদমে। রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলনে জড়িয়ে যান তিনিও। ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা একাডেমি, সেই বাংলা একাডেমির কার্যক্রম নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন, একটা ভালো পত্রিকা কি বেরোচ্ছে বাংলা একাডেমি থেকে? উল্লেখ যে, সাক্ষাৎকারটি তিনি দেন ১৯৯৫ সালে, তখন তার ৮৫ বছর বয়স, ফলে অনেক কথাই অস্পষ্ট থেকে যায়, তা ছাড়া, অতীত-বর্তমান মিলিয়ে অনেক কথাই তিনি বলেন, যাতে আলোচনার ধারাবাহিকতা বিঘ্ন হয়। 

তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় নিয়েও অনেক কথা বলেন। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক দুঃখ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ, যে উদ্দেশ্য ছিল, আজকে আমরা কি তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "অনেক দূরে সরে এসেছি। এখন মুক্তিযুদ্ধের কোনো আদর্শ নেই, এখন আছে নিজের পদের আদর্শ। কে কতখানি পদ আঁকড়ে থাকতে পারবে- গালাগালি, কাদা-ছোড়াছুড়ি এসব নিয়ে। একটা মানুষের মধ্যেও আমি দেখছি না যে কেউ দেশের কথা ভাবছে।'

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

3h ago