বিশ্বজুড়ে বিচিত্র যত স্কুল

পাহাড়ের গুহা যখন শ্রেণিকক্ষ। অরেঞ্জ স্মাইল

চওড়া খেলার মাঠ, টিনের চৌচালা বা দালান, সেখানে সারি সারি কক্ষ, কক্ষের মাঝে ব্ল্যাকবোর্ড এবং বারান্দায় ঘণ্টা। মোটাদাগে এই হলো স্কুল সম্পর্কে আমাদের সাধারণীকৃত ধারণা।

কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিচিত্র কারণে এই সাধারণ ধারণার বাইরেও অসাধারণ সব স্কুল গড়ে উঠেছে। তেমনই কয়েকটি স্কুলের কথা থাকছে এই লেখায়।

বাংলাদেশের ভাসমান বিদ্যালয় 

নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের সিধুলাই গ্রামটি প্রায়ই বন্যায় জর্জরিত থাকে। মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করাই সেসময় দায়, পড়াশোনা চলবে কী করে? এই যখন পরিস্থিতি, তখন এ গ্রামেরই সন্তান, স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান বন্যাকবলিত শিশুদের জন্য বেশ কিছু নৌকা নিয়ে গড়ে তোলেন ভাসমান বিদ্যালয়। ২০০২ সালে স্কুলটির যাত্রা শুরু হয়।
সাধারণ স্কুলের মতো বোর্ড, শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, বেঞ্চ ইত্যাদি সবই নৌকা-স্কুলে রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন কম্পিউটার, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ইত্যাদি। প্রতিটি নৌকায় একত্রে ৩০ জন শিশু পাঠ নিতে পারে। বই, খাতা, কলমসহ শিক্ষার যাবতীয় সামগ্রীও এ বিদ্যালয় থেকে সরবরাহ করা হয়।
বিখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা গ্লেন বেকার বিদ্যালয়টি নিয়ে 'ইজি লাইক ওয়াটার' নামে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। শুধু নাটোরেই নয়, হাওড় অঞ্চলগুলোতেও বর্তমানে এমন বিদ্যালয় গড়ে উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে বাইরের বিভিন্ন দেশেও।

ভাসমান বিদ্যালয়ে পাঠদানরত শিক্ষক। সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা/ হাফিংটন পোস্ট

ডংঝং গুহা বিদ্যালয়

শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য বিদ্যালয়ে প্রচুর ফাঁকা জায়গা দরকার। তাদের ছোটাছুটি করার জন্য মাঠ ও আকাশ দেখবার জানালা দরকার- প্রচলিত জ্ঞান আমাদের তাই বলে। কিন্তু চীনের গুইঝোউ প্রদেশের মাও গ্রামে অবস্থিত ডংঝং বিদ্যালয়ে এসবের কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ এর অবস্থান পাহাড়ি এক গুহায়।     

বিদ্যালয়টির এমন অবস্থান কিন্তু নির্মাণশৈলীর অপূর্ব কোনো নিদর্শন তৈরির জন্য বা শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আবহ সৃষ্টির কারণে নয়। বরং প্রাথমিক শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণের তাগিদেই এর স্থাপন। চীনের অন্যতম দরিদ্র একটি অঞ্চল হলো এই গুইঝোউ প্রদেশ। এখানে সরকারি উদ্যোগে শিক্ষার তেমন প্রচার-প্রসার ছিল না। তাই এখানকার অধিবাসীরা নিজ উদ্যোগে ১৯৮৪ সালে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। জায়গার অভাবে বিদ্যালয়টি স্থাপন করতে হয় একটি গুহায়। ১৮৪ জন শিক্ষার্থী ও ৮ জন শিক্ষককে নিয়ে বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ২০১১ সালে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।

অ্যাবো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মুখভাগ। কেটি মিংগেল/ স্লেট

অ্যাবো প্রাথমিক বিদ্যালয়

স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেকোনো সময় বোমাবর্ষণ করতে পারে—এই শঙ্কায় আমেরিকার নিউ মেক্সিকোতে ভূগর্ভস্থ একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। যাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এর ভেতর মানুষ আশ্রয়গ্রহণ করতে পারে। এতে রয়েছে একটি দূষণ পরিশোধন কেন্দ্র এবং ২০০০ লোককে জায়গা দেওয়ার সক্ষমতা। 

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ভূর্গভস্থ এই স্কুলটির বায়ু চলাচল পদ্ধতি বয়সের সঙ্গে দুর্বল হতে থাকে। ফলে এটি পরিচালনার জন্য খরচও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। জানালা, দরজা ও মুক্ত বাতাসবিহীন একটি পরিবেশ শিক্ষার্থীদের পাঠদানে কতটা সহায়ক হচ্ছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাছাড়া, সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে এর গুরুত্বও হয়তো তেমনভাবে কর্তৃপক্ষ অনুভব করেনি। তাই ১৯৯৫ সালে ভূর্গভস্থ স্থাপনাটিকে বন্ধ করে ঠিক পাশেই বিদ্যালয়টির নতুন ভবন গড়ে তোলা হয়।

বাসে দুই খুদে শিক্ষার্থী। সিইডিএফ

করাচির ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়

বাসে করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেকের হয়েছে। কিন্তু বাসই যদি বিদ্যালয় হয়ে ওঠে? তেমনটিই ঘটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে একটি বাস। করাচিতে সিটিজেনস এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (সিইডিএফ) নামক একটি সংস্থা দৈনিক ৪ শিফটে ৫-১৪ বছরের শিশুদের জন্য এ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

শুরুতে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ জায়গা থেকে বাসে তুলে সেটিকে একটি ফাঁকা পার্কিং লটে দাঁড় করানো হয়। তারপর শুরু হয় শিক্ষাদান কার্যক্রম। বাসে রয়েছে বেঞ্চ ও বোর্ড। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার স্তর অনুযায়ী পড়ানো হয়। এখানে মূলত শিশুদের প্রাথমিক লিখন ও পঠন শেখানো হয়। সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকেন একজন শিক্ষক ও শিক্ষক সহকারী। এছাড়াও আগ্রহী শিক্ষার্থীদের প্রথাগত বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতিতে সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনাও দেওয়া হয়ে থাকে। বাসটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয়। 

কম্বোডিয়ার নারিকেল বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ। ডয়চে ভেলে

কম্বোডিয়ার নারিকেল বা আবর্জনা বিদ্যালয়

কিরিরম জাতীয় উদ্যানের আবর্জনাময় পরিবেশ দেখে যারপরনাই মন খারাপ হয় কম্বোডিয় তরুণ অউক ভ্যান্ডের। সেই খারাপ লাগা আরও বেড়ে যায় যখন তিনি সেখানকার দরিদ্র শিশুদের শিক্ষাবিহীন, ক্ষুদ্র ব্যবসা করে কাটানো জীবনের দিকে তাকান। তার মাথায় চিন্তা ঘোরে কী করে এ দুটোকেই একসঙ্গে নির্মূল করা যায়। আর এ চিন্তা থেকেই উৎপত্তি কোকোনাট বা নারিকেল বিদ্যালয়ের- যত্রতত্র আবর্জনা না ফেলে সেগুলো দিয়ে বরং একটি বিদ্যালয় তৈরি করা যাক, যেখানে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা ইংরেজি ও কম্পিউটার শিখতে পারবে। এবং, বেতনের জায়গায় বিদ্যালয়কে তাদের দিতে হবে বস্তাভর্তি আবর্জনা।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফেলে দেওয়া বিচিত্র সব আবর্জনা দিয়ে বিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে বোতলের ছিপি, কাচ ও প্লাস্টিকের হরেকরকম বোতল, গাড়ির টায়ার, নারকেলের ভাঙা টুকরো ইত্যাদি। শুরুতে চেয়ার-টেবিলের বদলে নারকেল গাছ ব্যবহৃত হতো দেখে স্কুলটির এই নাম রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই স্কুলে পড়ে নিজেদের নতুন যুগের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলবে ও সেইসঙ্গে পরিবেশ বিষয়েও সচেতন হবে, এমনটাই প্রত্যাশা প্রতিষ্ঠাতা অউক ভ্যান্ডের।

তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, ওয়াইজটেপ, কোকোনাটস্কুল ফাউন্ডেশন

গ্রন্থনা: কৌরিত্র তীর্থ

Comments

The Daily Star  | English

Parties agree on chief justice appointment, limiting emergency powers

Manifesto provision allows top-two judge choice; cabinet to approve emergency declaration

1h ago