যশোরের সম্ভাবনাময় হ্যাচারি শিল্প সংকটে
মাছ চাষে জড়িতরা জানেন যশোরের চাঁচড়ার হ্যাচারির কথা। দেশের অন্যতম বড় এই হ্যাচারি পল্লী থেকে সারা দেশের সাদা মাছের রেণুর মোট চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ সরবরাহ করা হয়।
১৯৮০ দশকে শুরু হলেও ২০১০ সালের পর থেকে চাঁচড়ার হ্যাচারিগুলোয় দেশি ও বিদেশি জাতের মাছের পোনা উৎপাদনে বিপ্লব ঘটতে শুরু করে।
সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এবং স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পোনা চাষিরা। অস্বাভাবিক গরমে এ বছর হ্যাচারিগুলোয় রেণু ও পোনার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যশোরের হ্যাচারিগুলো রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাসকার্প, বিগহেড, থাই সরপুঁটি, মিরর কার্প, চিতল, আইড়, তেলাপিয়া, মনোসেক্স তেলাপিয়া, শিং, কৈ, থাই কৈ, পাঙাশ ইত্যাদি মাছের ডিম উৎপাদন করে।
রেণু উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারি থেকে শুরু হওয়া সংকট এখনো কাটেনি। তাছাড়া শ্রমিক সংকট, পোনার দাম কমে যাওয়া ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই শিল্প এখন সংকটে।
করোনার প্রভাবে দুই বছর হ্যাচারিগুলো বন্ধ রাখতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন।
দেশের মোট চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রেণু যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। অথচ নানা কারণে চাঁচড়া মৎস্য পল্লীতে হ্যাচারির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
গত বছরও ৩৪ হ্যাচারিতে রেণু উৎপন্ন হয়েছিল। এ বছর ২৫ হ্যাচারি উৎপাদনে গেছে। বাকিগুলো বন্ধ। পাঁচ বছর আগেও এখানে ৭৮টি হ্যাচারি ছিল।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মার্চ মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত রেণু ও পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। কিন্তু এ বছর ওই দুই মাস তীব্র দাবদাহে ডিম উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যে কারণে চলতি মৌসুমে রেণু উৎপাদন কমেছে।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ৭০ টন মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়েছিল। এ বছর এর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮ টনে।
অন্যদিকে যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির নেতাদের দাবি, চলতি বছর ১০০ টন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ১১৮ টন মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়েছে।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ও ফাতিমা হ্যাচারির মালিক ফিরোজ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রচণ্ড গরমের কারণে রেণু ও পোনার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়েছে। যশোরে গত বছর আমরা ১১৮ মেট্রিক টন রেণু ও পোনা উৎপাদন করেছিলাম। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। কেননা মৌসুমের শুরুতে দুই মাস তাপপ্রবাহ ছিল।'
'সব মিলে ২৫ হ্যাচারি উৎপাদন শুরু করেছে। আমরা বিদ্যুৎ বিল ও পোনার হরমন ইনজেকশন পিজি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আগে আমরা বিদ্যুৎ বিল দিতাম কৃষির দামে। এখন দিতে হচ্ছে শিল্পের দামে। এতে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। এ ছাড়া মাছের হরমন ইনজেকশন পিজি আগে প্রতি পিস ছিল আট টাকা, এখন তা কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়।'
তিনি আরও বলেন, 'করোনার প্রভাবে যশোরে ৩৪ পোনা হ্যাচারি দুই বছর বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেই ক্ষতি আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।'
সংশ্লিষ্টরা জানান, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা এর কাছাকাছি থাকলে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত রেণু নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
দেশ হ্যাচারির মালিক আতিকুর ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তিন বছর ধরে রেণু উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, 'প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। রেণু বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তোলা যাচ্ছে না। আমি উৎপাদন খরচের অর্ধেকও আয় করতে পারছি না।'
তিনি জানান, এ বছর ৩৮০ কেজি মাছের ডিম উৎপাদন করতে পেরেছেন। গত বছর তা ছিল ৫০০ কেজির বেশি। প্রতি কেজি মাছের ডিম বিক্রি হয় গড়ে প্রায় তিন হাজার টাকায়।
সম্প্রতি চাঁচড়া মোড়ে মুজিব সড়ক ও যশোর বাস টার্মিনাল সড়কে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কয়েক শ মানুষ মাছের পোনা কিনতে এসেছেন। বিশাল এলাকাজুড়ে রাস্তার দুই পাশে অনেক ট্রাক, পিকআপ, হিউম্যান হলার, ইজি বাইক ইত্যাদি মাছ বোঝাইয়ের কাজে ব্যস্ত। এসব গাড়িতে করেই কাছে-দূরের গন্তব্যে রেণু-পোনা নিয়ে যাচ্ছেন ব্যাপারীরা।
যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যশোরের রেণু মাছের গুণগত মান ভালো হওয়ায় দেশব্যাপী এর সুনাম আছে। এসব পোনা বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো হয়।'
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মুহাম্মাদ রফিকুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাঁচড়ায় সাদা রঙের সব ধরনের মাছের ডিম বা রেণু চাষ হয়। উন্নতজাতের ও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে জেলা ও সদর উপজেলা মৎস্য বিভাগ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চাঁচড়ায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ করা হয়েছে মাছের পোনা বিক্রির আধুনিক বিক্রয়কেন্দ্র।'
Comments