সম্পর্কে স্পেস কী, কেন প্রয়োজন, কতটা প্রয়োজন

প্রতীকী ছবি/ স্টার

জাবির ও সুনাইরা দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক পরিণয়ে রূপ নেয় পারিবারিকভাবেই। এই দম্পতিকে বাইরে থেকে দেখলে স্বাভাবিক আর সুখী মনে হলেও জাবিরের মাঝেমধ্যেই এই সম্পর্কে দমবন্ধ লাগে। জাবিরের মনে হয়, সে আগে যেভাবে নিজের মতো সময় কাটাতে পারত, নিজেকে সময় দিতে পারত এখন সেটি পারছে না বরং সব সময় একটা কৈফিয়তের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

অপরদিকে রাফি (ছদ্মনাম) বয়স ১৪, বয়:সন্ধির এই সময়টাতে বাবা মায়ের অতিরিক্ত নজরদারি শাসন তার কাছে দম বন্ধ লাগে। তার ইচ্ছে হয় মাঝেমধ্যে নিজের মতো করে সময় কাটাতে, নিজের পছন্দমাফিক বই পড়তে, বন্ধুদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। কিন্তু বাবা-মা একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে যেমন অন্য বই পড়া পছন্দ করেন না তেমনি সময়ের বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াও পছন্দ করেন না।

সেঁজুতি ও রুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে পড়ে এবং হলে একই রুমে থাকে। সেঁজুতি অনেক সময় রুমির কাছে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে এবং নিজের মতো মতামত দেয়। তারা দুজন বেশ ভালো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও রুমির কাছে সেঁজুতির এই উপযাচক আচরণ মোটেও ভালো লাগে না।

উপরে তিনটি ঘটনা আমাদের জীবনে কিংবা আমাদের আশেপাশের কারো না কারো সাথে মিলে যাচ্ছে নিশ্চয়ই। আমরা সারা জীবন কোনো না কোনো সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে থাকি। সেটি হতে পারে দাম্পত্য, পারিবারিক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একটি সম্পর্কে থাকার অর্থ হলো 'একে অপরের পাশে থাকা', যে কোনো সমস্যায় নিজেদের সামনে এগিয়ে নিয়ে চলা। সম্পর্কে থাকার পরও পরস্পরের মধ্যে 'ব্যক্তিগত পরিসর' থাকা খুবই জরুরি আর সেটি সব ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

সম্পর্কে নিজস্ব পরিসর থাকা দরকার। সম্পর্কে রয়েছে বলে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কেউ সময় কাটাতে পারবে না, এমন কথা কোথাও লেখা নেই। দু'জনেরই নিজের জগতে নিজেকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। জাবির আর সুনাইরা দম্পতি হলেও মনে রাখা উচিত তারা দুজন আলাদা মানুষ। অপরদিকে রাফির বাবা মাকে মনে রাখতে হবে ১৩ বছর বয়স থেকেই বয়সন্ধিকাল শুরু হয়। এই সময়টা ব্যক্তিত্ব গঠনে উপযুক্ত সময়। সব সময় নিজের মতামত চাপিয়ে না দিয়ে সন্তানের কথা শোনা, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। যা তাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক হবে। এদিকে রুমি ও সেঁজুতি খুব ভালো বন্ধু হলেও এই অযাচিত অনধিকার চর্চার ফলে তাদের বন্ধুত্বেও ফাটল ধরতে পারে।

সম্পর্কে ব্যক্তিগত স্পেস কী

একটি সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত পরিসর বলতে বোঝায় প্রতিদিনের সম্পর্ক থেকে কিছুটা সময় বের করে নিজেকে দেওয়া বা নিজের মতো করে খানিকটা সময় কাটানো। এতে ব্যক্তি নিজেকে নিজের কাছে পায়, তেমনি নৈমত্তিক সম্পর্ক ভালো থাকে। সম্পর্কে স্পেস মূলত সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করে, সেই সম্পর্ক দু মাসের হোক কিংবা ২০ বছরের। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সম্পর্কে থাকা মানে এই নয় যে আপনি সব ব্যাপারে নাক গলাবেন। এটি একটি সুন্দর সম্পর্ককে অসুস্থ সম্পর্কের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পেস প্রয়োজন দুই জনেরই।'

ব্যক্তিগত স্পেস শুধুমাত্র আপন মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয় বরং যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারো বিনা অনুমতিতে ফোন, ডায়েরি বা একটি ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ধরা উচিত নয়। তাছাড়া অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে অতিরিক্ত জানতে চাওয়া 'ব্যক্তিগত স্পেস' নষ্ট করে।

সম্পর্কে স্পেস কেন প্রয়োজন

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, দুজনের মধ্যে কথাবার্তা চলা উচিত এবং একে অপরের সম্বন্ধে ভালো করা জানা দরকার। তবে একটি সম্পর্কে থাকলেই যে একে অপরের ব্যক্তিগত পরিসরে পৌঁছে যেতে হবে, এমনটা উচিত নয়।

রিলেশনশিপ কোচ লারা মিন্ট এর মতে, সম্পর্কে এক অপরের জীবনে দখলদারি করতে শুরু করলে দেখা দিতে মারাত্মক সমস্যা। এমনকি সম্পর্কে দেখা দিতে পারে ভাঙন। তাই সতর্ক থাকা ছাড়া কোনো গতি নেই। সম্পর্ক রক্ষার জন্য প্রয়োজন 'মি টাইম'।

তবে অনেক যুগলই এই কথাটা বোঝেন। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসরে অন্যকে ঢুকতে দিতে চান না। সেক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে যদি এইটুকু বোঝাপড়া থাকে তবে সম্পর্ক দারুণ গতিতে এগিয়ে যেতে পারে।

সম্পর্কে স্পেস দেওয়া মূলত সম্পর্ককে সম্মানের একটি অংশ। সেটি যেকোনো সম্পর্কের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। একজন যদি সম্পর্কে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে তবে সেটি একসময় তিক্ত রূপ নেয়। আমরা অনেকেই ভালোবাসার আতিশয্যে সঙ্গীকে নিজের করে রাখতে চাই, তার চিন্তা-ভাবনাকে গ্রাস করে ফেলতে চাই, যাকে ভালোবাসি, পছন্দ করি তার বিষয়ে 'অবসেসড' হয়ে পড়ি, জোর খাটাই। আমরা হয়তোবা অতিরিক্ত আবেগ ভালোবাসা থেকে অন্যের জীবনে শতভাগ দখল নেবার চেষ্টা করি, কিন্তু দিনশেষে সেটি ভালো কিছু বয়ে আনে না। বরং অপরজন যদি বুঝতে পারে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে তবে ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। তাই সম্পর্কের বন্ধন শক্ত করার জন্য সীমারেখা টানা প্রয়োজন।

সম্পর্কে স্পেস দরকার কতটুকু

সম্পর্কে স্পেস যেমন দরকার তেমনি জানা দরকার এর পরিমিতিও। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করা মানে সম্পর্কের 'স্পেস' নয়। ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, 'সঙ্গী সপ্তাহে একদিন নিজের মতো কিছুটা সময় কাটাতে পারে এতে সম্পর্ক পুনরোজ্জীবিত হবে। তাছাড়া দিনের একটা নির্দিষ্ট অংশ নিজেকে দিতে পারেন।'

রিলেশনশিপ কোচ লারা মিন্টের মতে, 'ব্যক্তিগত স্পেস ব্যবহার করতে পারেন নিজেকে এক কাপ কফি ট্রিট দিয়ে কিংবা বছরে একবার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে। তবে আপনার যে সম্পর্কে স্পেস দরকার সেটি অবশ্যই সঙ্গীর সাথে আলোচনা করে নিতে হবে।'

সম্পর্কে স্পেসের দোহাই দিয়ে দায়িত্ববোধ এড়িয়ে গেলে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Have patience for election

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday said the government would issue a roadmap to the election as soon decisions on electoral reforms are made.

5h ago