প্রশ্নের মুখে ইসরায়েলের গর্বের আয়রন ডোম
আয়রন ডোম ইসরায়েলি সামরিক প্রযুক্তির পোস্টার বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আয়রন ডোম যুক্ত করেছে। এ ছাড়া কানাডা, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আজারবাইজান, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, মিয়ানমারসহ অনেক দেশ আয়রন ডোম কেনার ঘোষণা দিয়েছে।
এবার ইসরায়েলি সামরিক সক্ষমতার প্রতীক আয়রন ডোমের 'আভিজাত্যে' আঘাত হেনেছে হামাস। এমন অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির আয়রন ডোমকে রীতিমতো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে ফিলিস্তিনের এই সংগঠন। 'ব্যবসা সফল' ইসরায়েলের গর্বের প্রতীক আয়রন ডোমের কার্যকারিতা আসলে কতটা? এ সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়া যাক। এ জন্য প্রথমে আমাদের ঘুরে আসতে হবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঠ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পরপরই আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পেতে মরিয়া হয়ে উঠে ইউক্রেন। কারণ রাশিয়া এবং ইরানের রকেট-ড্রোন হামলায় বিপর্যস্ত কিয়েভের ভরসা ছিল আয়রন ডোমের প্রতি। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের একটি চুক্তি ইউক্রেনের আয়রন ডোমের স্বপ্ন ভেঙে দেয়। সেই চুক্তির দিকে একটু নজর দিতে চাই। তার আগে চুক্তির প্রেক্ষাপট জেনে নেওয়া যাক।
লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মিশরের হোসনি মোবারকের মতো প্রভাবশালী শাসকদের একের পর এক পতন ঘটতে থাকে। এ তালিকায় যুক্ত হন তিউনিশিয়া, বাহরাইন, ইয়েমেনের শাসকরা। যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে থাকা আরব দেশগুলোর শাসকদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অ্যাকশনে নেমে পড়ে পশ্চিমা বিশ্ব। কখনো অস্ত্র দিয়ে, কখনো সরাসরি সামরিক উপস্থিতি। কথিত আরব বসন্ত, আরব বসন্ত ঘিরে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া গৃহযুদ্ধ এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরব বিশ্বের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র।
এরমধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ। অন্য আরব নেতাদের পরিণতি বরণ করতে হয়নি তাকে। কারণ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি বাসার আল আসাদকে আলাদা আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। সিরিয়ার রণাঙ্গনে এস-৪০০ এর মতো অগ্রসরমান অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাসার আল আসাদের টিকে যাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার ছিল এস-৪০০।
২০১৫ সালে সিরিয়াতে সামরিক অভিযান শুরুর আগে ক্রেমলিন তেল আবিবের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। চুক্তিতে সিরিয়াতে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সিরিয়ান আর্মির ওপর যখন ইসরায়েল হামলা করবে, সে সময় রাশিয়ার নাগরিক ও সামরিক স্থাপনা সুরক্ষিত রাখা হবে বলে অঙ্গীকার করেছিল ইসরায়েল। এর বিনিময়ে রাশিয়া নিশ্চয়তা দিয়েছিল তারা ইসরায়েলি হামলার ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ রাখবে। ইসরায়েলি হামলা প্রতিরোধ করবে না এস-৪০০। বলে রাখা ভালো, সিরিয়া, লেবানন এবং জর্ডানে নিজেদের টার্গেটে বিমান হামলা চালানোর রেকর্ড রয়েছে ইসরায়েলের।
যে জন্য এই চুক্তিনামা সামনে আনা সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ইউক্রেনকে আয়রন ডোম দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ঠিক তখনই রাশিয়া ইসরায়েলকে সাফ জানিয়ে দেয়, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঠে আয়রন ডোমের উপস্থিতি ঘটলে তার চড়া মূল্য দিতে হবে তেল আবিবকে। কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন আয়রন ডোমের মুখে পড়লে সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলাও রুখে দেবে এস-৪০০। এমন প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের আয়রন ডোম প্রজেক্ট ঝুলে যায়।
এবার আয়রন ডোম সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। ইসরায়েল আয়রন ডোমের প্রথম ইউনিটটি সার্ভিসে যুক্ত করে ২০১১ সালে। তখন দাবি করা হয়েছিল, এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সফলতার হার ৭০ শতাংশ। এই প্রকল্পে মার্কিন আর্থিক সহায়তাও পায় ইসরায়েল। পরে এর সক্ষমতা ৯০ শতাংশে উন্নীত করার দাবি করে দেশটি।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা দুর্গের অন্যতম মেগা প্রজেক্ট এটি। দেশটির সামরিক সক্ষমতার অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে এই আয়রন ডোম, যা নিয়ে দেশটির গর্বেরও শেষ নেই। সামরিক প্রযুক্তির পরিচয় ছাপিয়ে আর্ন্তজাতিক রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার শুরু হয় আয়রন ডোমের। এমনকি আয়রন ডোমকে ইসরায়েলের 'নিরাপত্তা শিল্ড' বলেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
আয়রন ডোম চার থেকে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে উড়ে আসা রকেট বা মর্টার শেল কিংবা ড্রোন ধ্বংস করতে পারে। আয়রন ডোমের একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে, এটি উড়ে আসা রকেটের গতিপথ বিশ্লেষণ করে দ্রুত বলে দিতে পারে সেটি বিপজ্জনক কি না। যদি রকেটটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পড়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে আয়রন ডোম একটি ইন্টারসেপ্টর লঞ্চ করে, সেইসঙ্গে বাজে সাইরেন। ইন্টারসেপ্টরটি আকাশে উড়ে আসা রকেটটির কাছে গিয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং রকেটটিকে ধ্বংস করে। এ সব কিছুই সম্পন্ন হয় রকেট ছোড়ার মাত্র ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে।
আয়রন ডোমে ইসরায়েলকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলার দাবি করে আসছিল তেল আবিব। এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মানেই যুদ্ধের মাঠে এগিয়ে থাকা এমন একটি ধারণা প্রচার করে আসছে ইসরায়েল। এমন প্রচারণার আসলে বাস্তবতা কতটুকু?
সবশেষ গাজা থেকে ইসরায়েলে ছোড়া হামাসের রকেট হামলায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। মূলত এরপরই আয়রন ডোমের সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র তৈরির মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই হামাসের। অবরুদ্ধ গাজায় সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ হামাসের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, এবার মাত্র ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে হামাস। একইসঙ্গে ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে ছুটে গেছে হামাসের বিপুল সংখ্যক ড্রোন। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল টার্গেট পূর্ণমাত্রায় সামাল দিতে পারেনি আয়রন ডোম। আর এ কারণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হতে হয়েছে ইসরায়েলকে।
অবশ্য এর আগে ২০২১ সালেও আয়রন ডোমের নিরাপত্তা বূহ্য ফাঁকি দিতে সক্ষম হয় ফিলিস্তিন থেকে ছোড়া রকেট। তখনই প্রশ্ন উঠে, আরও বড় হামলার পরীক্ষা দিতে হলে আয়রন ডোম কি তার পূর্ণ সক্ষমতা দেখাতে পারবে? বিশেষ করে ইরানের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে পড়লে আয়রন ডোমের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
এবারের হামাসের হামলাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় 'সারপ্রাইজ অ্যাটাক' হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিয়ে ইসরায়েলে যেভাবে হামাসের রকেট আঘাত হেনেছে সেটি তেল আবিবের সামরিক গৌরবে চিড় ধরানোর শামিল বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
এ ছাড়া এবারই প্রথমবারের মতো গাজা থেকে মানুষবিহীন ড্রোন হামলা চালিয়েছে হামাস। প্রথমবারের মতো নিজেদের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সার্ভিসে যুক্ত করেছে হামাস। খুব বেশি উন্নত প্রযুক্তির না হলেও 'মাতবর ওয়ান' নামের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইতোমধ্যে ইসরায়েলের হামলা প্রতিরোধে কাজ শুরু করছে। আয়রন ডোমের মতো অত্যাধুনিক না হলেও মতবর ওয়ান দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলেছে তেল আবিবে। কারণ ইসরায়েলের বিমান হামলাকে কিছুটা হলেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে মাতবর ওয়ান। এরই মধ্যে চারটি ইসরায়েলি হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে হামাসের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
গাজায় বিদ্যুৎ, পানি, খাবার ও ওষুধের মতো জরুরি পণ্য বন্ধ করে দিয়ে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। প্রায় ২০ লাখের মতো গাজাবাসীর জন্য এই মুহূর্তে নিরাপদ কোনো জায়গা নেই। এমনকি গাজা ছেড়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই। হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থাপনায়ও।
এদিকে ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা দাবি করছে, হামাসকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ড্রোন তৈরির প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে ইরান। ইতোমধ্যে হামাসের নজিরবিহীন হামলা নিয়ে মোসাদ এবং শিনবেতের মতো প্রভাবশালী ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নিয়েও সরব তেল আবিবের গণমাধ্যম। কারণ ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনকার জীবনযাপন নজরদারির জন্যও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষায়িত ইউনিট ব্যস্ত থাকে। এতকিছুর পর হামাসের এই হামলা সম্পর্কে কোনো পূর্বানুমান করতে না পারা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে নেতানিয়াহুর সরকার। যদিও প্রযুক্তি সরবরাহের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইরান।
আধুনিক সামরাস্ত্রের যুগে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুপূর্ণ। কারণ শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমে আসে প্রশ্নাতীতভাবে। আর ঠিক এ কারণেই রাশিয়া থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে ন্যাটোর অন্যতম সদস্য তুরস্ক। ন্যাটোর সদস্য হয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে এমন প্রযুক্তি কেনায় ক্ষুদ্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তুরস্ক। এরই জের ধরে আঙ্কারাকে আধুনিক যুদ্ধবিমান না দেওয়ার ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কেনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিষেজ্ঞার মতো হুমকিও হজম করতে হয়েছে ভারতকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান যুদ্ধের একটি বড় জায়গা দখল করে ফেলেছে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং মানুষবিহীন সামরিক ড্রোন। আগামী দিনে যার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যত শক্তিশালী, যুদ্ধের মাঠে তার অবস্থান তত জোরালো হবে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থাডের সফলতার হার প্রায় শতভাগ, সেখানে এবারের 'হামাস পরীক্ষায়' আয়রন ডোমের ফলাফল সন্তোষজনক নয়। এমন বাস্তবতায় আয়রন ডোম আরও উন্নয়নের দাবি উঠবে নাকি নতুন কোনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হবে ইসরায়েল, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
(লেখায় নিউ ইয়র্ক টাইমস, হারেয, মিডিলিস্ট আই, সিনহুয়া, নিউজউইকের সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে।)
হাবিব রহমান: সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন
Comments