রাজনীতিতে ‘চুবানো’র সংস্কৃতির অবসান কবে হবে?

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশ আজ স্মরণকালের ভয়াবহতম রাজনৈতিক অবস্থা পার করছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর ‘বধ’এর ধনুর্ভঙ্গ পণ দেশকে বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর এক প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে তুলছে—যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।

সম্প্রতি পরিবেশ নিয়ে কথা বলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপস ধোলাইখালে চুবাতে চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে 'বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।  এসডিজি বাস্তবায়ন নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সুলতানা কামাল বলেন, 'আমারই নির্বাচনী এলাকার মানুষ, অত্যন্ত স্নেহের পাত্র মেয়র তাপস; ছোটবেলা থেকে দেখেছি। কারণ, একই পাড়ায় থেকেছে। আমরা সবাই যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম, তিনি বললেন যে যদি বেশি কথা বলে ধোলাইখালে নিয়ে চুবাব।'

সুলতানা কামাল আক্ষেপ করে আরও বলেন, 'এই সংস্কৃতি তার একার মধ্যে না, অনেকের মধ্যে আছে। কথা বললে যদি চোবানোর ধমক খেতে হয়, তাহলে কোন রাজনীতিকের কাছে যেতে হবে?'

আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে অধঃপতনের কোন তলায় গিয়ে ঠেকেছে, এই একটি মাত্র ঘটনাই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। তবে মেয়র তাপস যে সুলতানা কামালের সঙ্গেই এমনটি করেছেন, বা এবারই প্রথম তিনি বিরুদ্ধ মত পোষণকারীকে চুবাতে চেয়েছেন—এমন কিন্তু নয়।

এর আগেও তিনি সুশীল সমাজকে বুড়িগঙ্গায় চুবানোর হুমকি দিয়েছিলেন। গত মে মাসে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, 'যে সব সুশীলরা আমাদেরকে বুদ্ধি দিতে যাবেন, সেই সব সুশীলদের আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেবো।'

সেই অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেছিলেন, 'মনটা চায় আবার ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি। যেখানে মুগুর দেওয়ার সেটাও জানি। একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম।' মেয়রের ওই বক্তব্য তখন বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা আপিল বিভাগের নজরে এনেছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম. আমীর-উল ইসলাম। কিন্তু পরে কী হয়েছিল, তা আর জানা যায়নি।

এবার অভিযোগমতে সুলতানা কামালের সঙ্গে তিনি যা করেছেন, এটিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো কারণই নেই। সুলতানা কামাল দেশের প্রথিতযশা একজন বুদ্ধিজীবী এবং নিজ পরিচয়েই তিনি দেদীপ্যমান। অনেক সময় অনেকেই তাকে আওয়ামী ঘরানার মানুষ বলেও বিবেচনা করেন। তবে  নিজের পরিচয় তো আছেই, তিনি আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া বেগম সুফিয়া কামালের মেয়ে—যাকে বলা হয় 'জননী সাহসিকা'।

সেই সুলতানা কামালকেই যদি চুবানোর কথা বলা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? অবশ্য এ-ও সত্যি যে মেয়র তাপসও শুধু একজন জনপ্রতিনিধিই নন, তিনি এমন একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে যে পরিবারটির অনন্য ও অসাধারণ ভূমিকা জাতির পক্ষে ছোট করে দেখার কোনোই অবকাশ নেই। সেই তিনি কেমন করে সুলতানা কামালের সঙ্গে 'চুবানো' কথাটা উচ্চারণ করতে পারলেন, তা বোধে আসে না। আর সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকে যায়।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে, মেয়র তাপসের বক্তব্যকে দেশে চলমান রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে—তার বক্তব্য এক অসুস্থ সময়ের অসুস্থ রাজনীতির ফসল, একই সঙ্গে রাজনৈতিক অসুস্থতারও প্রতীক। তবে এই অসুস্থতা একদিনে জন্ম নেয়নি।

একজন মানুষের রক্তের কোনো একটি অপরিহার্য উপাদান যখন কমতে শুরু করে, ঠিক সময়ে তা শনাক্ত করতে না পারলে সময়ে তা-ই ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যায়। তখন আর সাধারণ ওষুধে কাজ হয় না। একটা দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদানগুলো যখন দুর্বল হতে থাকে, এবং তা থেকে উত্তরণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, গণতন্ত্র জিনিসটাই তখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় কর্তৃত্ববাদ। আর দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর্তৃত্ববাদীতা ধারণ করে ভয়ংকর দানবীয় রূপ।

এই অবস্থাকে স্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী করতে বন্ধ করে দেওয়া হয় বিরোধী মত প্রকাশের সব বাতায়ন। আর তখনই অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয় 'চুবানো'র মতো অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে গত তিন দশকে দেশের রাজনীতিতে এই অসুস্থতার বাতাস ক্রমেই বেগবান হচ্ছে—যা বিপজ্জনক ভাইরাসের মতো রাজনীতির অঙ্গন তথা গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে সংক্রমিত করে চলেছে—যার অনিবার্য ফল হিসেবে জন্ম নিচ্ছে এই 'চুবানো' সংস্কৃতির বিষবৃক্ষ।

১৯৯১ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর আশা করা হয়েছিল যে দেশে কোনোরূপ বাধা ছাড়াই সুস্থ গণতন্ত্রের বাতাস বইবে, জন্ম নেবে নতুন প্রত্যাশার সংস্কৃতি—গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি—যেখানে মানুষ তার কষ্টগুলোকে অকপটে, দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারবে, পারবে শাসক শ্রেণি তথা শাসকদলের সমালোচনা করতে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এই যে গত ৩২ বছরে অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়নি। বরং ক্রমেই তা অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন রাজনীতিবিদদের মানুষ আগের মতো শ্রদ্ধা আর সম্মানের চোখে দেখে না, দেখে ভয়ের দৃষ্টিতে। যে রাজনীতিক প্রতিপক্ষের প্রতি যত বেশি খিস্তিখেউড় করতে পারেন, তিনি তত বেশি বড় আর কর্মীবান্ধব নেতা।

জনগণ নয়, দলীয়জন খুশি থাকলেই নেতা খুশি, সেই সঙ্গে খুশি দলীয় নেতৃত্ব। এমনটিই চলে আসছে গত ৩২ বছর ধরে। এই ৩২ বছরের মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রথম দফায় ৫ বছর এবং ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত টানা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায়। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে মতপ্রকাশ তথা গণতন্ত্রের সকল বাতাবরণ। মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রায় সব  গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।

গোটা জাতি আজ দলীয়ভাবে বিভক্ত। চলছে সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ। আর এই দলীয়করণ এমনই এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারি দলের বাইরের সবাই নিজেকে 'নিজ বাসভূমে' উদ্বাস্তু মনে করছেন—অনেকটা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো। আমলাতন্ত্র থেকে বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্রই এর বিস্তার। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা মস্তকহীন মুরগীর ঘুরপাক খাচ্ছি পুরোনো বৃত্তেই।

যখন যে দল ক্ষমতায় আসছে, তারাই বিরোধী মত দমনে হয়ে উঠছে খড়গহস্ত। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে দুর্নীতি, বাড়ছে অপশাসনের দৌরাত্ম্য। আর এ অবস্থারই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদীতা। সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতার কণ্ঠেই এর সুর স্পষ্ট। হয়তো এ ক্ষেত্রে মেয়র তাপস একটু বেশিই এগিয়ে আছেন।

কদিন আগেও তিনি রাজধানীর বনশ্রীতে এক সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আর ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন। এই কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতির চর্চায় তিনি একা নন। আরও অনেকেই আছেন। সম্প্রতি বিএনপির ঝিনাইদহ-যশোর হয়ে খুলনা অভিমুখী রোডমার্চের প্রাক্কালে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার হুমকি দিয়েছেন যে রোডমার্চ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের আর যশোরে ফিরতে দেওয়া হবে না। যশোর শহরের চৌরাস্তা মোড়ে ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন।

এ ছাড়া, গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতা সাম্প্রতিক বৃষ্টির সময়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহতদের স্মরণে সভা করতে গেলে স্থানীয় সরকার দলীয় কর্মীরা তাতে বাধা দেয় এবং ব্যানার ছিনিয়ে নেয়। প্রতিদিনই এমনতর কর্তৃত্ববাদী আচরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে। এ সবই দেশের ক্রম অবনতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার ইঙ্গিত—যা চলতে থাকলে দেশে 'চুবানো' সংস্কৃতি আরও বেশি প্রসার লাভ করবে—সুলতানা কামালের মতো মানুষের আক্ষেপ শুধু বেড়েই চলবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশ আজ স্মরণকালের ভয়াবহতম রাজনৈতিক অবস্থা পার করছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর 'বধ'এর ধনুর্ভঙ্গ পণ দেশকে বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর এক প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে তুলছে—যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, বিশেষ করে সরকার এবং সরকারি দলকে 'চুবানো'র সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে বিরোধী মতকে সম্মান করার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই মঙ্গল। তা না হলে, যদি ভয়াবহ কোনো অন্ধকার গ্রাস করে আমাদের ভবিষ্যতকে, কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

19h ago