মজুরির হিসাব-নিকাশ: পোশাক শিল্পের অগ্রগতি ও শ্রমিকের জীবন

চট্টগ্রামে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির মিছিল। ছবি: সংগৃহীত

জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পা রাখতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ৪০ লাখ তরুণ পোশাক শ্রমিক। সেই অধ্যায় স্বস্তির না পুরোনো ঘানি জিইয়ে রাখার—তা এখনই বলা মুশকিল। একদিকে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন, অন্যদিকে মালিক-সরকার ও তাদের আস্থাভাজন শ্রমিক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ক্ষিপ্রগতিতে তৎপরতা চলছে। নিকট সময়েই নতুন মজুরি নির্ধারণেই সব পরিষ্কার হবে। সবাই জানে, গত পাঁচ বছরে করোনা-মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপসহ নানা সংকট মোকাবিলা করেছে দেশ। এতসবের মাঝেও পোশাক খাত অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা হয়ে থেকেছে। অন্যসব খাতের পতন হলেও এই খাতের অগ্রযাত্রা থামেনি।

শ্রমিকদের অক্লান্ত শ্রম ও অমানবিক জীবনের বিনিময়ে গেল অর্থবছরে ৮৪ শতাংশ রপ্তানি আয় হয়েছে এই খাত থেকে। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ বছরে ৩৩ থেকে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি শিল্পে পরিণত হয়েছে এটি। নতুন বাজারে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়েছে। ডলারের বিনিময়ে টাকার দাম কমে যাওয়ায় গত এক বছরে মালিকরা বাড়তি পেয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। এসবই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি।

ভাবনা আসে, তবে কি এই অগ্রগতির হিস্যা পেতে যাচ্ছে শ্রমিকরা নতুন মজুরিতে? যে জীবন হাঁসফাঁস করে আট হাজার টাকার বেড়াজালে, তা থেকে কি এবার পরিত্রাণ জুটবে? এবার কি শ্রমিকরা ডিম-ডাব-মাছ-মাংস-ফলমূল-দুধ খাওয়ার অধিকার পাবে? প্রিয় সন্তানকে কাছে রাখা বা যথাযথ শিক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন কি ন্যায্যতা পাবে? অসুস্থ হলে সস্তা-হাতুড়ে চিকিৎসার বদলে তারাও কি মানসম্মত চিকিৎসা পাবে? শ্রমিকরা তাদের দাবি অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকা বা তার কাছাকাছি ২৩ বা ২৪ হাজার টাকার মতো মজুরি কি পাবে? শেষ হতে যাচ্ছে কি দুনিয়ার সস্তা মজুরের পরিচয়, তারা কি পেতে যাচ্ছে নাগরিক মর্যাদার ছিটেফোঁটা?

এসব প্রশ্নে মালিক-সরকার পক্ষ বা তাদের সহচরীদের মনে হতে পারে শ্রমিক 'বড্ড' বেশি চায়। অতি সহজে শ্রমিকদের তারা 'অতি-উৎসাহী' বা 'অপরাধী' হিসেবে গণ্য করতে পারে। কেউ বা বলে বসতে পারে, 'শ্রমিক অতশত ২৫ হাজারের দাবি বোঝে না, বরং "দুষ্টু" বুদ্ধির নেতা বা "উসকানিদাতা"রা মগজ ধোলাই করছে', 'শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র' করছে। তারা এটা খেয়াল করেন না যে, শ্রমিকরা মেশিন না, মানুষ। অমানবিক আর্থিক টানাপোড়ন ও মেশিন জীবনই তাদের অজান্তে তাদের চিন্তাকে কখনো সক্রিয় করে তোলে। অগ্রসর নেতৃত্বের কাজ মগজ ও শরীরের এই আটক দশা থেকে বেরিয়ে আসার পথ যৌথভাবে খোঁজা। ন্যূনতম মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিতই মানসম্মত মজুরির প্রাথমিক শর্ত। মজুরি বৃদ্ধিতে শিল্প ধ্বংস নয়, বরং উৎপাদনশীলতা বাড়ে। শিল্প রক্ষার স্বার্থেই এটি অনিবার্য।

বর্তমানে বাজার ও মালিকদের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকের মজুরি নেই—সেটা সবাই জানে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে এবার ছিল সর্বোচ্চ। সরকারি তথ্যমতে, কেবল খাদ্যে আগস্ট পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শ্রমিক ও শ্রমজীবীর ওপর। ফলে বিশেষভাবে খাদ্যমান ও পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছেন শ্রমিকরা। কম মজুরি ও কম পুষ্টি গ্রহণ করায় তারা পুষ্টিহীনতাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। ভাতের পর শ্রমিকের নিত্যদিনের তরকারি হিসেবে একমাত্র ভরসা যে আলু (শর্করা), তার দামও এখন কেজিতে ৫০ টাকা। শ্রমজীবীর আমিষ হিসেবে পরিচিত পাঙাশ মাছ, ফার্মের মুরগি কিংবা ডিমও আগের মতো কেনার সামর্থ্য নেই। এমন পরিবারও আছে যারা এক পোয়া গুঁড়া মাছ ভাগ করে দুদিন খাচ্ছে। কখনো সেটুকুও জুটছে না। শাক-সবজির দামও চড়া। এ ছাড়া, গত পাঁচ বছরে দফায় দফায় জ্বালানি-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় চারদিক থেকে যেন বিপদ ধেয়ে আসছে শ্রমিকদের দিকে। ধার-কর্জ, কিস্তি পরিশোধে টানাপোড়েন, সঞ্চয় ভাঙা, সন্তানের শিক্ষা ও মৌলিক চাহিদার নানা দিক কাটছাঁট করেও চলা কঠিন হচ্ছে।

সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ ২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিসিবির দাম পর্যালোচনায় দেখিয়েছেন, চালের দাম ১৫ শতাংশ, ডাল ১২০ শতাংশ, আটা ৮৮ শতাংশ, আলু ৮০ শতাংশ, খোলা সয়াবিন ৯৫ শতাংশ, লবণ ৬৮ শতাংশ, ডিম ৬৭ শতাংশ, দুধ ১০০ শতাংশ, চিনি ১৮০ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ৪৮ শতাংশ ও মাছ ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থায় দারিদ্রসীমার উচ্চতর রেখার জন্য প্রয়োজনীয় দুই হাজার ২০০ ক্যালরি খাদ্য খরচ চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য দরকার কমপক্ষে ২৩ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ কম করে ধরলেও মাসে প্রয়োজন প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি। (বাঁচার মতো মজুরিও গণতান্ত্রিক অধিকার: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, প্রথম আলো)।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি চলতি বছরের মার্চে দেখিয়েছে, ঢাকায় এমনি একটি পরিবারের শুধু খাদ্য খরচ ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। গত এক বছরে সেই ব্যয়ও বেড়েছে ২৫ শতাংশ (ঢাকা শহরে এক পরিবারের খাবার খরচ ২২,৬৬৪ টাকা: ২৭ মার্চ ২০২৩, প্রথম আলো)। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের গবেষণায় দেখা গেছে, এই খরচ ১৪ হাজার। শ্রমিক জোট 'গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন'র হিসাবে তা ২১ হাজারেরও বেশি। প্রায় সব গবেষণায়ই দেখা গেছে, খাদ্য ও অন্যান্য খরচ মিলে শ্রমিকের মাসে অন্তত ৪০ হাজার টাকা দরকার। সন্দেহ নেই, উৎপাদনশীলতা, অন্যান্য তুলনীয় খাত ও অন্যান্য দেশের মজুরি, উৎপাদন ব্যয় ও মালিকের মুনাফা, মূল্য ও মূল্যস্ফীতি, পোশাক শ্রমিকের জীবন যাত্রার ব্যয় ইত্যাদি সব বিচারেই শ্রমিকের মজুরি অনেক বেশি হওয়ার কথা। তারপরও দেশের ও মালিকদের সামর্থ্য বিবেচনায় ১১ সংগঠনের জোট 'মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন'র দাবি শ্রমিকের মজুরি ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা করা।

কিন্তু শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে পুরোনো রেকর্ড বেজে চলার মতো মালিকপক্ষ অপারগতা-সামর্থ্যহীনতার গল্প করছে। মালিকদের প্রবৃদ্ধি বা লাভের ভাগ যেন শ্রমিকদের দিতে না হয়-তাই। অথচ সরকারি ও আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী, এই খাতে গত পাঁচ বছরে লক্ষণীয় মাত্রায় অগ্রগতি হয়েছে। চিত্রটি আরেকটু খোলাসা করতে আরও কিছু তথ্য পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউরোপের বাজারে ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করে এগিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এই বছর এগিয়ে। এমনকি এগিয়ে ডেনিম রপ্তানিতেও। ১০ বছর আগে এ দেশে সবুজ কারখানা ছিল মাত্র একটি। বর্তমানে প্রায় ২০০টির বিশ্বের নিরাপদতম সবুজ কারখানার স্বীকৃতি রয়েছে। (পোশাক ও বস্ত্র খাতে এখন ২০০ পরিবেশবান্ধব কারখানা: ৯ আগস্ট ২০২৩, প্রথম আলো)। এই খাতকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে মালিকরা। সম্প্রতি তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির আড়ালে ৮২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। এই ঘটনাকে শুল্ক গোয়েন্দারা পুরো বড় ঘটনার ছোট অংশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে (তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে অর্থপাচারের আসল চিত্র কী?: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বিবিসি বাংলা)। এতসবে 'ঘরের লক্ষ্মী' শ্রমিককে পায়ে ঠেলছে মালিকরা মানসম্মত মজুরি না দিয়ে।

পোশাক শ্রমিকরা দিনরাত খেটে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম-ডাক বাড়ালেও দেশে তারা অবহেলিতই। যার নজির করোনাকালে আরও স্পষ্ট হয়েছিল। সেই সময়ে সরকারি সব কর্মকর্তাদের স্ব-বেতনে ছুটি দেওয়া হলেও পোশাক শ্রমিকরা অর্থনীতির চাকা চালিয়েছে। তাতে পুরস্কৃত হওয়ার বদলে তারা মুখোমুখি হয়েছিল লে-অফ, মজুরি-বোনাস কর্তন, ছাঁটাই ও নির্যাতনের। 'সামাজিক দূরত্ব' কিংবা 'স্বাস্থ্য সচেতনতা' তাদের জন্য বিলাসী শব্দ ছাড়া কিছু ছিল না।

দেশের মাথাপিছু আয়ে গড়মিল থাকলেও এখন তা দুই হাজার ৭৭৫ ডলার। অর্থাৎ প্রায় তিন লাখ ৬২ হাজার ২৮০ টাকা, যার অর্থ মাসে আয় প্রায় ২৫ হাজার ৫২৩ টাকা। স্মার্ট বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ ডলার। এসবের ধারে-কাছে নেই শ্রমিক। দেশের অন্যান্য অনেক খাতের শ্রমিকের চেয়ে তাদের মজুরি অনেক কম। বর্তমানে সরকারের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বেতন ১৬ হাজার ৯৫০ টাকা, ব্যাংকের পরিচ্ছন্নতাকর্মী-পিয়নসহ নিম্নপদের কর্মকর্তাদের বেতন ২৪ হাজার টাকা, স'মিলের শ্রমিকরা পান ১৭ হাজার ৯০০ টাকা, জাহাজভাঙা শ্রমিকরা মজুরি পান ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু পোশাক শ্রমিকদের মাসিক আয় সেই আট হাজারেই আটকে আছে।

সব তুলনায়ই তরুণ পোশাক শ্রমিকরা বঞ্চিত। বর্তমানে চীনে শ্রমিকদের মজুরি ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা, ভিয়েতনামে ১৫ হাজার ৬৬০ টাকা, তুরস্কে ২৯ হাজার ১৬৫ টাকা, মালয়েশিয়ায় ২৫ হাজার ৯৩৫ টাকা ও ফিলিপাইনে ২৩ হাজার ১৮০ টাকা। সম্প্রতি কম্বোডিয়ার শ্রমিকদের জন্য ২৪ হাজার ২৮১ টাকার নতুন মজুরি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ভিয়েতনামকে অতিক্রম কর বিশ্বের দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশ। এ বছর ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানিতে শীর্ষে থাকায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে গর্ব করছে দেশ। অথচ সস্তা মজুরের পরিচয় যেন পিছু ছাড়ছে না।

ইতোমধ্যে ক্রেতাদের পণ্যের দাম বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন বিজিএমইএ'র সভাপতি। তিনি ওই চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এবার মজুরি 'উল্লেখযোগ্য' হারে বাড়বে। ক্রেতাদেরও দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু তা থেকে শ্রমিকরা কত ভাগ পাবে, এখনো তা নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন মজুরি বাড়িয়ে ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছে। এসব দাবি বিবেচনায় এনে মজুরি বাড়ালে সেটি নিশ্চয়ই শ্রমিক ও শিল্পের কল্যাণে আসবে। দেশে-বিদেশে এই শিল্পের ভাবমূর্তি বাড়বে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার কারণে দুশ্চিন্তা রয়েই গেছে।

২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকরা মজুরি ১৬ হাজার টাকায় বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিল। তখন মজুরি ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। সেই সময়ে শ্রমিকদের দাবি উপেক্ষা করে বোর্ডের পক্ষ থেকে মালিকরা মাত্র এক হাজার ৬০ টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল মজুরি ছয় হাজার ৩৬০ টাকা করার। যেটা ছিল মূল্যস্ফীতি ও ইনক্রিমেন্ট হিসেবে মজুরি বৃদ্ধির বদলে হ্রাসের প্রস্তাব। অন্যদিকে, শ্রমিক প্রতিনিধির প্রস্তাব ছিল তা ১২ হাজার ২০ টাকা করার। দর-কষাকষিতে মালিকরা সাত হাজার টাকার বেশি দিতে চাচ্ছিল না। এরপর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আরও এক হাজার বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা করা হয়।

এবার ২০১৮ সালের মতো সরল অঙ্কের নাটক মঞ্চস্থ হলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। মালিকরা কেবল নিজেদের জীবনযাপনের ধরন কিছুটা বদলালে ও লাভের অঙ্কের সামান্য ভাগ শ্রমিকদের দিলেই শ্রমিকরা খেয়ে-পরে অন্তত বাঁচতে পারবে। ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষির সক্ষমতা বৃদ্ধিও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

এই 'উল্লেখযোগ্য' হারের পরিমাণ নিয়ে শ্রমিকরা চরম উদ্বেগ ও শঙ্কায় আছে। কারণ পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা মহল থেকে শোনা যাচ্ছে, আজ মজুরি বোর্ডের তৃতীয় সভায় মালিকরা খুব সামান্য বৃদ্ধির প্রস্তাব আনতে পারে। শ্রমিক প্রতিনিধিরা মজুরি বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করার দাবি করতে পারে। আর মালিকরা ১২ বা ১৩ হাজারের বেশি দিতে রাজি হবে না (পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে নির্বাচনের আগেই: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সারাবাংলা)। তাহলে কি কেবল শ্রমিকদের শান্ত রাখা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি রক্ষায় এই কথার কথা। বাস্তবে শেষ পর্যন্ত এমনটা হলে পরিস্থিতি জটিল হবে, শ্রমিক অসন্তোষও বাড়বে।। বরং এই অবস্থা থেকে শ্রমিকদের বের করতে ও উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে শ্রমিকদের দাবি বিবেচনা করাই সবার জন্য মঙ্গলের হবে।

মজুরি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গে মজুরি কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়টিও এবার গুরুত্বেও সঙ্গে সামনে এসেছে। যেটি বিগত মজুরি বোর্ড পাশ কাটিয়েছে। বেসিক, গ্রেড ও ইনক্রিমেন্টসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলাদেশের প্রায় শ্রমিক সংগঠন একমত হয়ে মজুরি কাঠামোয় পরিবর্তনের কথা তুলেছে। শ্রমিকের মজুরিতে বেসিকের পরিমাণ একটি জরুরি বিষয়। গত ১০ বছরে সেটি ক্রমশ কমছে। ১৯৯৪ সালে মোট মজুরি ৯৩০ টাকার মধ্যে বেসিক ছিল ৬৫ শতাংশ, ২০০৬ সালে এক হাজার ৬৬২ টাকার মজুরির মধ্যে বেসিক ৬৮ শতাংশ, ২০১০ সালে তিন হাজার টাকা মজুরির ৬৭ শতাংশ বেসিক ও ২০১৩ সালে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা মজুরির ৫৭ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ৮ হাজার টাকা বেতনের ৫১ শতাংশে নেমেছে। এভাবে শ্রমিকের প্রাপ্যতে এক বিরাট ধাক্কা এসেছে ২০১৮ সালে। শ্রমিকের মূল মজুরির ওপর অন্যান্য পাওনা যেমন: ওভার টাইম, গ্র্যাচুইটি, মাতৃত্বকালীন, বাৎসরিক ছুটির টাকাসহ অন্যান্য সুবিধার হিসাব হয়। তাই এবার মজুরি কাঠামোতে পরিবর্তন এনে মোট মজুরির ৬৫ শতাংশ বেসিক বা মূল মজুরি করা, গ্রেড সাতের বদলে পাঁচটি করা, ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ করার বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

আমরা লক্ষ্য করছি, গত তিনটি মজুরি বোর্ড নির্বাচনকালীন সময়ে গঠিত হয়েছে। বর্তমানেও মজুরি বোর্ড যখন গঠিত হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াও জটিলতর হচ্ছে। বাজারের বেসামাল অবস্থার সঙ্গে এবার ভোটাধিকার-গণতান্ত্রিক অধিকারও যেন বন্দিদশায়। সঙ্গে দূষিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পরিবেশে শ্রমিকরাও নাজুক দশায়। শ্রমিক সংগঠনগুলো আশা করছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক জাতীয় রাজনীতি ঘন হয়ে আসার আগেই নতুন মজুরি কার্যকর হবে। তাই বিভিন্ন শ্রমিক এলাকায় সভা-সমাবেশ হচ্ছে। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি হাজির হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির হার ও মালিকদের সামর্থ্য নিয়ে। আজ ১ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের তৃতীয় সভায় শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির ন্যায্য দাবি বিবেচনা করা হবে—এমন আশায় আছেন ৪০ লাখ শ্রমিক। আন্দোলন ছাড়া বরাবর আমাদের দেশে মজুরি পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। আর সেই আন্দোলন দমনের নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ হচ্ছে এবারও।

ভয় ছড়ানো ও নির্যাতন: বল প্রয়োগ ও আদর্শিক হাতিয়ার—দুই-ই ব্যবহার হয় শ্রমিক আন্দোলনে। শ্রমিকরা এখনো ভুলেননি ২০১৮ সালের মজুরি আন্দোলন দমনের কথা। একযোগে আশুলিয়ার অধিকাংশ শ্রমিক নেতা গ্রেপ্তার হয়েছিল। মামলা দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার। এবার বছরখানেক আগ থেকেই চলেছে হামলা-মামলা-নির্যাতন। মিরপুর-গাজীপুরের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে সরকারি-বেসরকারি লাঠিয়াল বাহিনী-হেলমেট বাহিনী একসঙ্গে দমন-পীড়ন চালিয়েছিল। এ বছর সরকার স্বচ্ছ ভোট নিশ্চিত প্রশ্নে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চাপের মুখে। শ্রমিকর আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন যাতে এক না হয়, তার জন্যই এই পর্যায়ে একটু ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করছে সরকার ও মালিকপক্ষ। সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করা, নেতৃত্বকে নানা কায়দায় ব্যস্ত রাখা, দেশে-বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে পাঠানো, উপঢৌকন-উৎকোচ দিয়েও দমনের চেষ্টা এবারও জারি থাকবে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে আন্দোলনই পথ দেখাবে।

তাসলিমা আখতার: গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও আলোকচিত্রী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

‘Salma was killed by tenant, not her son’

Salma was killed by her “drug peddler” tenant, not by her 19-year-old son, said police yesterday contradicting Rab’s claim.

5h ago