একটি সেলফি কি রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিলো?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে সেলফি নিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে কে কত ক্ষমতাবান কিংবা কার সঙ্গে কত বেশি প্রভাবশালী মানুষের সম্পর্ক বা খাতির আছে, সেটি বোঝানোর কিংবা দেখানোর সহজ তরিকা হলো সেলফি। অর্থাৎ ওই মানুষটির সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে একটি ক্যাপশন লিখে দেওয়া হয় যে, অমুকের সঙ্গে অমুক স্থানে। এর মাধ্যমে তিনি নিজস্ব বলয়ে কিংবা পরিচিতজনদের এই বার্তাটি দিতে চান, তার সঙ্গে অমুক পুলিশ অফিসারের, অমুক আমলার কিংবা অমুক রাজনীতিবিদের সুসম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ তিনি যে ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে আছেন, সেটি জানানো।

কিন্তু যিনি নিজেই একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, তার সঙ্গে আরেকটি দেশের প্রেসিডেন্টের ছবি বা সেলফি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়? কেননা, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন কোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন, সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবেই তারা অনেক ছবি তোলেন বা তুলতে হয়।

অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও ছবি তুলতে পারেন। যেমন: আফ্রিকার কোনো দরিদ্র দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও মার্কিন প্রেসিডেন্টের ছবি থাকতে পারে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেও বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য এগিয়ে যেতে পারেন, আগ্রহ দেখাতে পারেন। এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বরং এগুলোই সৌজন্য।

শুধু তাই নয়, শত্রুভাবাপন্ন দুটি রাষ্ট্রের সরকার প্রধানও কোনো অনুষ্ঠানে মিলিত হলে তাদের হাসিমুখে কথা বলা, পরস্পর কুশল বিনিময় করা, ছবি তোলা, এমনকি সেলফি তোলাও কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়।

পররাষ্ট্র ও কূটনীতির ভাষা সব সময় আক্ষরিক হয় না। শত্রুভাবাপন্ন দুটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কথা বললেই চট করে ওই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। কেননা হাসিমুখে কথা বলা, ছবি তোলা, কুশল বিনিময়—এগুলো ভদ্রতা, সৌজন্য। শুধু হাসিমুখ আর মিষ্টি কথা দিয়ে পররাষ্ট্র নীতি হয় না, কূটনীতি হয় না। কূটনীতিতে যা বলা হয়, তারও অধিক বলা হয় না। যা দেখানো হয়, তারও অধিক গোপন রাখা হয়।

এত কথা বলার কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেলফি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সেলফি নিয়ে এর আগে এত আলোচনা হয়নি।

কিন্তু কেন?

হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। কিন্তু তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেলফি কি কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার? এই সময়ের পৃথিবীতে, এই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতিতে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে শেখ হাসিনা নিজেও অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। শুধু বিশ্বের প্রভাবশালী নারীর তালিকা নয়, বরং প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের তালিকায়ও তার নাম থাকবে।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র ইস্যুতে সমালোচনা থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের গত তিন মেয়াদে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে; করোনা মহামারির ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ধসে পড়েনি; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বের নিত্যপণ্যের বাজারও যেরকম অস্থির, সেই তুলনায় ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে সবাই যে এখনো অন্তত খেয়েপরে টিকে আছে, সেটির অনেকখানি কৃতিত্ব শেখ হাসিনার—এটি নিশ্চয়ই তার বিরোধীরাও স্বীকার করবেন। সুতরাং এমন একজন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ছবি বা সেলফি থাকলো কি থাকলো না, তাকে কী আসে যায়?

হয়তো কিছুই আসে যায় না। কিন্তু, এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। ভিন্ন এই কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের একটা টানাপোড়েন চলছে অনেক দিন ধরেই এবং বিশ্বাস করা হয়, এই টানাপোড়েনের পেছনে রয়েছে শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইস্যু।

যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ড. ইউনূসের সখ্য বহুদিনের এবং সামাজিক ব্যবসা, ক্ষুদ্র ঋণ এবং গরিব মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ড. ইউনূসের কাজকে যুক্তরাষ্ট্র শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে এবং সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্কটিও সর্বজনবিদিত; যেহেতু ড. ইউনূসের প্ররোচনাতেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে অর্থায়ন প্রত্যাহার করেছে বলে বাংলাদেশ সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের তরফে বহুবার অভিযোগ করা হয়েছে; উপরন্তু ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে ড. ইউনূস একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে দীর্ঘমেয়াদে দেশের শাসনক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন বলেও কথা চালু আছে; যেহেতু ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলাগুলো স্থগিত করার দাবি, তথা তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার—অতএব এই ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের শাসক দলের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই বাস্তবতায় যখন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু প্রভাবশালী সদস্যের বিরুদ্ধে স্যাংশন দেওয়া হয় এবং আরও অনেকের বিরুদ্ধে স্যাংশনের গুঞ্জন ওঠে; যখন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি ভিসানীতি ঘোষণা করে, যার ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়; যখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেন যে আমেরিকা চাইলে যেকোনো দেশের সরকার ফেলে দিতে পারে; যখন তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'হয়তো আমেরিকা চায় না আমি (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় থাকি'—তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের এই বৈরিতার সুযোগ নিতে চায় মাঠের রাজনীতিতে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি।

অনেক দিন ধরেই এটা দৃশ্যমান যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও বিএনপির ভাষা মোটামুটি অভিন্ন। এতে সরকারি দলের অনেক নেতা বিএনপির বিরুদ্ধে এই অভিযোগও এনেছেন যে তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বাংলাদেশের সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সবকিছু মিলিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের দূরত্ব বাড়ছিল এবং বিএনপিও সেই সুযোগটি নিচ্ছিলো—তখনই সামনে আসে এই সেলফি ইস্যু।

নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে তোলা একটি সেলফি নিয়েই মূলত দেশের রাজনীতিতে এই তোলপাড়। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে টানাপোড়েন চলছিল, তার বোধ হয় অবসান হলো। অনেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ভালো হয়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে এই সেলফিকে বর্ণনা করছেন। অনেকে এটিকে দেখছেন 'নয়াদিল্লির সাফল্য' হিসেবে। তবে এই সেলফি নিয়ে সবচেয় বেশি সোচ্চার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা। বসে নেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি মহাসচিবও।

শেখ হাসিনার সঙ্গে জো বাইডেনের এই সেলফি 'বিএনপি নেতাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে' বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিএনপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, 'আজ নতুন একটা খবর আছে। দিল্লিতে কী হচ্ছে? জি-২০ (সম্মেলন)। এত দিন বিএনপি আটলান্টিকের ওপারে হোয়াইট হাউসের দিকে তাকিয়ে ছিল—বাইডেন সাহেব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। এই না? কী দেখলেন আজকে? বাইডেন সাহেব নিজেই সেলফি তুললেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। তুলেছেন না? সঙ্গে আবার পুতুলও (সায়মা ওয়াজেদ) ছিল।'

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেছেন, 'ছবি অনেক কথা বলে। এই ছবির ভাষা নিশ্চয়ই সাংবাদিক এবং বোদ্ধা ব্যক্তিরাও বুঝতে পারছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আগামী দিনে আরও ঘনিষ্ঠ হবে।'

এই ইস্যুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'সেলফির জন্য র‍্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা-নীতি উঠে যায়নি। দেউলিয়া হয়ে গেছে বলেই বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলে ঢোল পেটাচ্ছেন।' ভোট ঠিকমতো না করলে কোনো সেলফিই রক্ষা করতে পারবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি ওবায়দুল কাদেরকে এই ছবিটা বাঁধিয়ে গলার মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে 'গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার' অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান ছয় কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর গত মে মাসে তারা নতুন ভিসা-নীতি ঘোষণা করে জানায়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের আমেরিকার ভিসা দেওয়া হবে না। মূলত ওই ঘোষণার পরই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি সামনে আসে।

প্রশ্ন হলো, একটি সেলফি কি পুরো রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জো বাইডেন সেলফি তুলেছেন বলেই কি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও অন্যান্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলে যাবে বা তারা কি তাদের এতদিনের অবস্থান থেকে সরে আসবে? তাদের ভিসানীতি কি বদলে যাবে?

অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সেলফি কি রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে কিছুটা হতাশ করলো? বিশেষ করে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কি এটা মনে করতে পারেন যে, সরকারের সঙ্গে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে, অতএব আগামী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভূমিকা না রাখলে এই দফায়ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে এবং আরও পাঁচ বছর তাদেরকে রাজপথে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে?

বস্তুত এই সেলফির সঙ্গে পলিটিক্সের সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, দুটি শব্দ জোড়া দিয়ে 'সেলফিটিক্স' হয়ে যাচ্ছে—যার পরিণতি দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আমীন আল রশীদ, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Govt won’t raise power tariff despite pressure from IMF: energy adviser

The energy adviser explained that while the IMF recommended a tariff hike to ease the subsidy burden in the power sector, the government emphasised the adverse effects such a move would have on citizens already grappling with high inflation

8m ago