ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকা আর কতদিন চলবে

দেশকে এগিয়ে নিতে চাইলে ইস্যুর খেলা বন্ধ করতেই হবে। অন্যথায় গণতন্ত্র কখনো দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে না।

সেই ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে আমাদেরকে প্রবাদ বাক্য পড়তে হয়েছিল। এমনই এক প্রবাদ বাক্য ছিল—'শাক দিয়ে মাছ ঢাকা'। ঠিক কখন, কীভাবে বাংলা ভাষায় এর উৎপত্তি হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো আলোচনা না করলেও তুচ্ছ বিষয় দিয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ঢেকে দেওয়াই যে এই প্রবাদের তাৎপর্য, তা শিক্ষকরা আমাদের বুঝিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে কিছুটা বড় হয়ে এটুকু বুঝেছি, শুধু বাংলাদেশে বা বাংলা ভাষায়ই নয়, যুগে যুগে দেশে দেশে তুচ্ছ জিনিস দিয়ে বড় জিনিসকে ঢেকে দেওয়ার প্রয়াস সব সময়ই চলমান ছিল। আর সেই কাজটা করেছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষেরা সুবিধাবঞ্চিতদের ঠকানো, ক্ষেত্রবিশেষে শোষণ করার জন্য।

প্রাচীন গ্রিক আমল থেকে শুরু করে গত শতাব্দীর হিটলার, পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান—এরা সবাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কলাকৈবল্য চর্চা করে গেছেন। জার্মানির শাসক হিটলার উগ্রজাতীয়তাবাদের শাক দিয়ে স্বৈরাচারের মাছ ঢেকে রাখার কার্যকর কৌশলের সন্ধান পেয়েছিলেন তার তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের মাধ্যমে।

পাকিস্তানের সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ধর্মের শাক দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিল স্বৈরশাসনের মাছ। গত শতাব্দীর আশির দশকে একই চর্চা করেছিলেন সামরিক শাসক এরশাদ। নব্বই এর দশকে এ দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও 'এটা দিয়ে ওটা ঢাকা'র পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকে—যা এখনো চলমান।

ইতিহাস বলে, সব সময় শাক দিয়ে মাছকে ঢেকে রাখা সম্ভব না হলেও কিছু সময়ের জন্য হলেও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে তারা সক্ষম হয়েছেন। তবে এখন সময় পাল্টেছে। শাকও আর আগের মতো সহজলভ্য নয়। তাই মাছ দিয়েই মাছ ঢাকা, ক্ষেত্রবিশেষে ছোট মাছ দিয়ে বড় মাছ ঢাকার খেলায় মেতেছে সবাই। রাজনীতির ভাষায় একে বলা যেতে পারে 'ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকা'।

তবে এ ক্ষেত্রে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের খেলোয়াড়েরা অন্যান্যদের চেয়ে একটু বেশিই পারঙ্গম। অবশ্য সব দেশে এর প্রয়োগ একরকম হয় না। শাসকগোষ্ঠী জনগণের মন ও মননের মান, শিক্ষা, আবেগ ও অন্যান্য অবস্থা বুঝে একেক সময় একেক ইস্যু মাঠে ছেড়ে দেয় তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য।  জনগণও কিছুদিন তা নিয়ে মেতে থাকে। মৌলিক ইস্যু ঢাকা পড়ে যায় গৌণ ইস্যুর নীচে। এই সুযোগে শাসকগোষ্ঠী গুছিয়ে নেয় তাদের আখের, সংহত করে নেয় তাদের ক্ষমতার অবস্থান।

ইতিহাসের এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন নতুন ইস্যু সামনে আসছে; বলা চলে সামনে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজপথের বিরোধীদলগুলো ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে গত প্রায় ২ বছর ধরে যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে, তখন থেকেই সরকার কিছুদিন পরপরই একটা না একটা ইস্যু মাঠে ছেড়ে দিচ্ছে। আর, সেইসব ইস্যুকে জনপ্রিয় করার জন্য রাজবদর মহল, বিশেষ করে সরকারের বশংবদ মিডিয়া মোঘলরা উঠেপড়ে লাগছে।

যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে, তখনই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সরকার থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত এক শ্রেণীর সুশীল ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন ভূমিকাকে সামনে নিয়ে নতুন একটা ইস্যু তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষের একাত্তরের আবেগকে ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে তারা। মজার বিষয় হলো সরকার তার এই প্রয়াসের সঙ্গে পাশে নিচ্ছে চীনকে। কিন্তু তারা এটা বলতে লজ্জা পাচ্ছে যে ১৯৭১ সালে চীনও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল।

প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, গত এক বছরে দেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটিতেই কার্যত জনগণ অংশগ্রহণ করেনি। সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ ভোট পড়েছে ঢাকা-১৭ এর উপনির্বাচনে। তবে মজার ব্যাপার হলো, সব দল যখন নির্বাচন বয়কট করলো, আর অরাজনৈতিক ইউটিউবার হিরো আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাড়া ফেলে দিলো, আমাদের একটি শ্রেণি একে 'রুচির দুর্ভিক্ষ' বলে ঠাট্টা-তামাশা করা শুরু করে দিলেন।

অথচ ২০১৮ সালে যখন দিনের ভোট আগের রাতে হয়ে গেলো, সারা বিশ্বের কাছে আমাদের গণতন্ত্রের চেহারাটা ন্যাংটা হয়ে গেলো, তখন তাদের রুচিতে কোনো আঁচড় পড়লো না। আসলে এসবই যে সরকারের খেলা, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

এইভাবে কখনো বিদেশি হস্তক্ষেপ ইস্যু, কখনো রুচির ইস্যু, এসব নিয়ে সরকার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই ফাঁকে জনগণকে ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে গত দেড় দশকে লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচারসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, প্রতিবেশী  ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনে কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা।

দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে আজকাল এসব নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই;  সরকারি ইস্যুর চালে সব ব্যর্থতার কাহিনীই চাপা পড়ে গেছে। এরও আগে, প্রতিদিনই যখন লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, কিংবা মাসের পর মাস লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্তপ্রায় হয়ে উঠেছে, তখনো নানান কিসিমের ইস্যু দিয়ে সেসবকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

এই ইস্যুর খেলায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ড. ইউনূস। গত কদিন ধরে জাতীয় পত্রিকা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সর্বত্রই ইউনূস প্রসঙ্গ। চলছে বিবৃতি,  পাল্টা বিবৃতি। তিনি একজন সুদখোর, সুদের ব্যবসা করেন—এমন আরও কত কী!

হ্যাঁ, এতো সত্যি কথাই, তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ নিয়েই মূলত কাজ করে। আর, এ কথা কে না জানে যে ঋণের সঙ্গে সুদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। এটি যে শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এমন তো নয়। সব এনজিওই এ কাজ করছে। তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকই টার্গেট হবে কেনো? আর, এ কথা কে না জানে যে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাই দাঁড়িয়ে আছে সুদের উপর। এমনকি সরকারি কর্মচারীরা যে চাকরিশেষে পেনশন পান, সঞ্চয়পত্র কেনেন, তাতেও সুদ রয়েছে। তাহলে?

তবে হ্যাঁ, যদি তার প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি থাকে বা তিনি সরকারি আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই যেতে পারে। একটা সভ্য সমাজে কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না, কিংবা কারো ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের ইনডেমনিটি প্রযোজ্য হতে পারে না।

কিন্তু আমরা দেখছি অতি সম্প্রতি একজন প্রথিতযশা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠলেও উচ্চ আদালত তার বিরুদ্ধে তদন্তের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে দিয়েছেন। অন্য আরেকজন শিল্পপতিকে ব্যাংকিং নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সেসব কোনো ইস্যু হলো না, ইস্যু হলো ড. ইউনূস। কিন্তু কেন?

ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন প্রায় দেড় যুগ হয়ে গেছে। এতদিন পর হঠাৎ করে তার 'নোবেল প্রাপ্তি'র যোগ্যতা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে! তবে যারা এটি করছেন তারা কী একবারও ভেবে দেখেছেন, আমাদের দেশে যেসব জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয় বা হয়েছে, তাদের কজন সেই সব পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন?

তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশে কিংবা বিদেশে, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক, সব পুরস্কারের ক্ষেত্রেই সবসময়ই কিছু না কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আমাদের দেশে যা হচ্ছে, তা প্রশ্ন নয়, ইস্যু তৈরির প্রয়াস। এসবই হচ্ছে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য; সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য, জনগণকে বিভ্রান্ত করে তাদের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।

এ কথা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে দেশে বিদ্যমান সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতেই একের পর এক ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। লক্ষ্য করার মতো বিষয়, আজ আর কেউ ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কথা বলছে না। কথা বলছে না বিদ্যুৎ, সার, ডিজেল বা অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। বলছে না এ কারণেই যে, নিত্যনতুন ইস্যুর চাপে তারা মূল ইস্যুকেই ভুলে যাচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, এটা যে কোনো বিশেষ দল বা দলীয় সরকারের বিষয়, তা কিন্তু নয়। যতদিন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পুঁজি-সিন্ডিকেট সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে, ততদিনই এই ইস্যুর খেলা চলবে, তৈরি হবে একের পর এক ইস্যু। কখনো ধর্মের নামে, কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে, কখনো অন্য কোনো নামে, কখনো নারীর কপালের টিপ নিয়ে, কখনো হিজাব নিয়ে—এমন আরও কত কী!

দেশকে এগিয়ে নিতে চাইলে ইস্যুর খেলা বন্ধ করতেই হবে। অন্যথায় গণতন্ত্র কখনো দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে না।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

18h ago