মোহাম্মদ রফিক: একজন সাহসী কবির প্রস্থান

কবি মোহাম্মদ রফিক। ছবি: সংগৃহীত

চলে গেলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। দৈহিকভাবে গেলেও কবিতায় থেকে যাবেন কবি। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।' বাংলা ভাষার আধুনিকতম কবির এই এই উচ্চারণ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কারণ তিনি একটা সহজ সত্য উচ্চারণ করেছিলেন সাহস নিয়ে।

মোহাম্মদ রফিক ঘোষণা করেছেন সত্যের আরেক পীঠ— "সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।" কবির জীবনাবসানের পরপরই লাইনগুলোও মানুষের মুখে মুখে। এটা এক অমোচনীয় সত্য যার মধ্যে একটা ভয়াল ব্যাপার গোপনে রক্ষিত। তবুও উচ্চারণ করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আজকের উত্তরাধুনিক যুগে আমরা জানছি সত্য একক নয়, তা বহুস্তরীভূত। বলতে দ্বিধা নেই, কবির এই উচ্চারণ কোনো সাধারণ বক্তব্য নয়। তা মোটেও নয় কবিতার ভেতর-বাইরে লীন হয়ে থাকা সহজ নন্দন। তাহলে তা এক অনন্য প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, মানবসত্তার ঘুমন্ত পাড়ায় জেগে ওঠার প্রত্যয়ঘণ্টা।

কোনো কোনো মানুষের পদক্ষেপই বদলে দেয় জগৎ। কবিও বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করে। কেননা কবিরা মানুষকে বদলে দেন, বদলে দেন তাদের চৈতন্য। ঘা মেরে মেরেও যিনি দেশপ্রেমকে সঙ্গে নিয়ে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়ে যান তিনিই তো সত্যিকার বুদ্ধিজীবী। যেনতেনভাবে এই দায় এড়ানো যায় না। নইলে মানুষ হিসেবে তার বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়? বাংলা কবিতার এক অনন্য মানুষ মোহাম্মদ রফিকের ছিল সেই বোধ। কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে তার গ্রাম-অধ্যুষিত বাংলাদেশ।

কবিতার উপমা উৎপ্রেক্ষা আর ব্যঞ্জনাময় চিত্রকল্প, সবখানেই তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন লোক ঐহিত্যের প্রত্মগভীরতা। জীবন-মরণ-যাপন-স্বপ্ন সর্বত্রই এই গতিবিধি যেন মাটির গন্ধে ভরপুর। তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন সেই দেশের যাত্রী যেখানকার প্রকৃতি মানবজন্মকে সার্থক করে। যার আশ্রয়ী কোল হচ্ছে মায়ের বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর স্বপ্নগাথা। নদী জল মাটি আর জীবনের অপার বিস্ময় যেন তার কবিতার গ্রন্থিতে। নদী, ফড়িং বা নক্ষত্রের চোখ মোছা জলের মতো অসংখ্য কবিতায় ছবির মতো এক গ্রামবাংলা অঙ্কিত। "নাও বইছে চাঁদের কিনার বেয়ে/একজন ধরে আছে হাল/অন্যজন বাইছে বইঠা,/ একটু পরে তারা নেমে এল ভুঁয়ে/দু'জনে দু'তীর ঘেষে দুই নায়ে/নদী কিন্তু চুপচাপ যেন চিত্রার্পিত/উত্তরের দিকে বহমান। (নদী)। 

যিনি নিবিষ্ট কবি প্রকৃতি ও জীবন তার কবিতার মর্মে ঘোষণা করবে এক সহজিয়া প্রত্যয়। তারা খুব সাধারণ উপমায় খুঁজে ফেরেন গভীরতার বোধ। যেমন জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ কিংবা লোরকার মতো কবিরা প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন লোকমানসের ভাঁজে ভাঁজে প্রত্মগভীর জীবন সন্ধানে। জীবনানন্দের কবিতায় যে ফড়িং-এর জীবন প্রত্যাশিত তা তো মানুষের হয়েও মানুষের নয়। 'যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা'। আমাদের চারপাশে দোয়েল ফড়িং নামের আশ্চর্য সৃষ্টিগুলো উড়ে ঘুরে বেড়ায়। এই ক্ষুদ্র-তুচ্ছের ভেতরে কবি খুঁজে পান ডুবে যাওয়া চৈতন্য স্বর।

'ফড়িং' কবিতায় মোহাম্মদ রফিক সেই ভালোবাসা বোধে উত্তীর্ণ যা মানুষীসত্তার অনুভবি অস্তিত্বের দিকে হাত বাড়ানো। "ফড়িং এসেছে ভুলে/জগতের মাঝে,/মেঘ-রোদ্দুরের তপস্যার ধন/স্নেহধন্যা ফুল ও পাপড়ির/কী আনন্দ, পাতার ওপরে বসে/নাড়ায় শরীর রমণীয় যেন/জয় করে নিল পুরো গ্রহ/মাটি ও মানুষ,/আমি তাকে ভুল করে/ভালোবেসে/দু'হাত বাড়াই!" জীবন, জীবনের সহজতা, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা এখানে সার্থক। 'নক্ষত্রের চোখ মোছা জল' কবিতাটা দেখি। সেখানেও শীতের সামান্য কুয়াশা নক্ষত্রের বিশালতায় রূপান্তরিত। তুচ্ছ বস্তুর ক্ষুদ্রতা যেন বৃহতে আস্থাশীল, সূত্রধর এই জীবনের মতো।  "কুয়াশায় ভিজে যায় পথিকের মুখ/আমি বলি, নক্ষত্রের চোখ মোছা জল,/ধানের ক্ষেতের শীর্ষ ছুঁয়ে/কুয়াশার আস্তরণ জমে ওঠে,/স্রোতের মাথায় কুয়াশার ধোঁয়া/যেন কেউ শ্বাস ফেলছে অবিরল,/ঘোর ছায়া মেদুরতা স্মৃতি ভারাতুর,/আমি বলি, এই শীতে মানুষের প্রসব বেদনা!" 

এরপরও একজন কবি স্বকালের দগ্ধীভূত, অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াইকামী। জীবন যেমন আনন্দের তেমনি বেদনামুখর। ধ্বংসের নাগিন ফনা তুলে দাঁড়িয়েছে যেখানে, সেখানেই বুদ্ধিদীপ্ত কবির প্রতিরোধ। কেননা একজন কবির মাতৃভূমির ঋণ কেবল বন্দনাগানে শেষ হয়ে যায় না। সেজন্যই সজল মেদুর প্রকৃতিগানে ভরপুর এক কবি গর্জে ওঠেন মানুষিসত্তার চৈতন্যে। ষাট দশকের মোহাম্মদ রফিক আইয়ূবি শাসন বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নিবেদিত কর্মী। সেই পাকিস্তানের ভূত এসে চেপেছিল স্বদেশের স্বৈরশাসকের ঘাড়েও। আবারো প্রতিবাদে মুখর হলেন তিনি। সামরিক জান্তার দাঁতাল শুয়োরও যখন কবিতা লেখে, তখন আর কবিতার মূল্য কী? যে কবিতা মানুষের প্রকৃতির জীবনের, তা কখনো বিলিয়ে ছড়িয়ে দেবার সামগ্রী নয়।

মোহাম্মদ রফিকের নিষিদ্ধ 'খোলা কবিতা' তখন সারাদেশে ঘুরছে। ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে কবিতার  প্রেক্ষাপট জানিয়েছিলেন। তখন ঢাকায় অবসর জীবনযাপন করছেন। বলেছেন—'কবিতাটি আমি লিখেছিলাম জুন মাসের এক রাতে, এক বসাতেই। আমার মনে একটা প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, মনে হচ্ছিল একজন ভুঁইফোড় জেনারেল এসে আমাদের কবিতার অপমান করছে'।

কবি দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রী নষ্ট হাতের বিরুদ্ধে এক প্রবল সাহস। যে কবিতা কেউ প্রকাশ করতেও সাহস করেনি, সেই কবিতার মোহাম্মদ রফিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক তিনি তখন। কি ছাত্র কি শিক্ষক সকল অবস্থাতেই তিনি সমান প্রতিবাদমুখর। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ নষ্টকারী হীন চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে তার স্বর কম্পন তুলেছিল। প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে যারা অধিকার হরণের নাটকে নিমজ্জিত ছিল, তাদেরকে তিনি কখনো ক্ষমা করেননি, আপোষ করেননি। এভাবে জীবন কাটিয়ে গেলেন মোহাম্মদ রফিক। আমাদের প্রিয় রফিক স্যার! 

আমি তখন সদ্য শিক্ষকতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় স্যার থাকতেন প্রান্তিক গেটের দিকে। তার বাসায় গিয়েছি, কথা শুনেছি। কী এক প্রাণোচ্ছ্বল মানুষ তিনি তখন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এক বিরাট হৃদয়ের মানুষ। তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো হলেও কী অসীম বন্ধুত্বে হাত বাড়িয়েছেন। মনে পড়ে বাংলা বিভাগে মাঝেমধ্যে তাকে বক্তৃতায় আহ্বান করা হতো। বলবার ভাষা ছিল তার প্রগলভ। বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্র-নজরুল থেকে শুরু করে কাজানজাকিস, গ্যেটে, হুইটম্যান, তলস্তয় কি এরকম বহু নাম, তাদের কীর্তির কথায় তাঁর উচ্চারণ ছিল অনায়াস। তার মুখে উচ্চারিত হতো আবিশ্ব ছড়ানো কবিতার স্বর। তিনি ভুলে যাননি তিনি বাংলাদেশের কবি। কিন্তু বিশ্ব কবিতার প্রেক্ষাপটে বাংলার কবিতার পেশিকে শক্ত উচু হাতে তুলে ধরেছিলেন। 

আজ তিনি নেই। তাকে নামানো হয়েছে কাফনের কাপড়ে, পূর্বপুরুষের গোর দেওয়া আপন ভিটায়। যে মৃত্যুবোধকে তিনি কবিতার অন্তর্লীন প্রবাহে সঞ্চার করেছিলেন, সেই চিত্রকল্প ছবির মতো ভাসছে আমার দু চোখে :

'লাশ নামানো হচ্ছে গোরে
ঠিক সেই মুহূর্তে একটি প্রজাপতি 
কোত্থেকে, ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে উড়ে
এসে বসল লাশের বুকের ওপর,
প্রজাপতিটি নাড়াচ্ছে পাখনা;
আনন্দে না বেদনায়
কে বলবে!' (লাশ)

বাংলা কবিতায় এক অনিবার্য নাম মোহাম্মদ রফিক। একটি অনুভবের জগৎ, ভালোবাসা ও জীবনমন্থনের পৃথিবীতে ছিল তার অধিকার। এমন সাহসী কবিকে মনে রাখবে পাঠক। 

Comments

The Daily Star  | English
Tarique Rahman on interim government

Interim govt must not be allowed to fail: Tarique addresses BNP rally

Thousands join BNP rally from Nayapaltan to Manik Mia Avenue

5h ago