গৃহকর্মে শিশুশ্রম বন্ধ না হলে শিশু অধিকার বাস্তবায়িত হবে না
গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুরা যেমন নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, ঠিক তেমনি তারা নানাভাবে নিগৃহীত, নিপীড়িত ও যৌন নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষা আইন থাকলেও গৃহকর্মে শিশুদের সুরক্ষা বিষয়ে আলোকপাত করা হয় না। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকাতেও গৃহকর্মে শিশুশ্রম অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে দেশের প্রায় প্রতিটি গৃহেই শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। যদি আইনের মাধ্যমে শিশুদের গৃহকর্মী নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ করা হয় এবং গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকাভুক্তি করা হয়, তবে শিশুদের অনেকটাই স্বস্তি মিলবে।
'ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমের তালিকায় গৃহকর্ম অন্তর্ভুক্তকরণের অগ্রগতি ও আইনি বাস্তবতা' শীর্ষক সংলাপে এমন মন্তব্যই করেছেন শিশু অধিকার, শিশুশ্রম ও মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
সোমবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংলাপটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি), শাপলা নীড় ও এডুকো বাংলাদেশ।
সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।
সংলাপের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে শাপলা নীড় বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমোকো উচিয়ামা বলেন, 'গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। যে বয়সে শিশুদের স্কুলগামী হওয়ার কথা, সেই বয়সেই তারা গৃহে নিপীড়িত হচ্ছে। এই শিশুদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। তারা কোনো প্রকার অধিকার সম্পর্কেও সচেতন নয়। গৃহকর্মে নিযুক্ত বেশিরভাগ শিশুই স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। পরবর্তীতে তারা গৃহকর্মে নিযুক্ত হচ্ছে। ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ হলেও দেশের এখনো গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদি আইনের মধ্য দিয়ে গৃহকর্মে শিশুদের প্রবেশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে গৃহকর্মে শিশুশ্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে আমরা আশা করতে পারি শিশু অধিকার বাস্তবায়িত হওয়ার পথ সুগম হবে। এক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।'
আয়োজিত সংলাপে আয়োজিত সংলাপের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচ্য বিষয়ের ওপর উপস্থাপনা করেন শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ সরফুদ্দিন খান। সংলাপে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের কর্মসূচি পরিচালক হামিদুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য দেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন স্পেশালিস্ট শাবনাজ জাহেরিন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন মো. মাহবুবুল হক, শিশু অধিকার বিষয়ক থিমেটিক কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রোগ্রাম অফিসার সাইদুল ইসলাম, জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সেক্রেটারি নাসিমা আক্তার জলি, ডেইলি অবজারভারের প্রধান প্রতিবেদক মোহসিনুল করিম প্রমুখ।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন স্পেশালিস্ট শাবনাজ জাহেরিন বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় থাকা সব কাজই ফরমাল সেক্টরের কাজ। কিন্তু গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুশ্রম এখনো ইনফরমাল সেক্টরেই রয়ে গেছে। তাই গৃহকর্মে শিশুর বিষয়টি যদি ফরমাল সেক্টরে আনা যায়, তাহলে আমরা তা জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারব। ২০০৭ ও ২০১৩ সালে ইউনিসেফ চাইল্ড লেবার সার্ভে করেছিল, এখন ২০২২ সালের করা জরিপের কাজও চলছে। কিন্তু সেখানে গৃহকর্মে শিশুশ্রমের বিষয়টি উঠে আসেনি; কারণ এটি ফরমাল সেক্টর হিসেবে স্বীকৃত না। যে কারণে এটি বারবারই বাদ পড়ছে। তাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত এটিকে ফরমাল সেক্টরে তালিকাভুক্তির ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানো।'
সংলাপে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন মো. মাহবুবুল হক বলেন, 'মানবাধিকার কমিশনের সাধারণ মানুষের কাছে যেমন একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, ঠিক তেমনি সরকার বা মন্ত্রণালয়গুলোতেও দীর্ঘ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি যদি তালিকাভুক্ত করা যায় তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবে। অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যৌথভাবে শাপলা নীড় ও এডুকো বাংলাদেশের উদ্যোগটি মানবাধিকার কমিশন গুরুত্বসহকারে পদক্ষেপ নিবে এটিই প্রত্যাশা করি।'
গৃহকর্মে শিশুদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রোগ্রাম অফিসার সাইদুল ইসলাম বলেন, 'আইএলও সরকার, মালিক, শ্রমিক—সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা সব এনজিওদের নিয়েই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি। যদি আমরা সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিই, তবে আগামীতে খুব শিগগিরেই গৃহকর্মে শিশুশ্রম আমরা বন্ধ করতে সক্ষম হবো। আইএলও কনভেনশনে ৭ ধারা মোতাবেক ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োগ করা উচিত না। যেহেতু শ্রম আইনে গৃহ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই, তাই গৃহকর্মে শিশুশ্রম বন্ধের জন্য আইনের খসড়াটি অনুমোদিত হলে এটি অনেকটাই সহায়ক হবে।'
সংলাপে জাতীয় কন্যা শিশু এডভোকেসি ফোরামের সেক্রেটারি নাসিমা আক্তার জলি বলেন, 'আমরা পরিসংখ্যানে দেখেছি ঢাকা শহরে ২ লাখ ২৫ হাজার কন্যা শিশু গৃহকর্মে কাজ করছে। তাদের মধ্যে ৭১ ভাগ কন্যাশিশুই পেটে-ভাতে কাজ করছে। অর্থাৎ তারা কেউই কোনো পারিশ্রমিক পায় না। বাকি যে ২৯ ভাগ কন্যাশিশু গৃহকর্মে কাজ করে তারা ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পায়। এই শিশুদের পুষ্টি কিংবা স্বাস্থ্যের বিষয়টি কখনোই দেখা হয় না। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত যেসব গৃহশ্রমিক কাজ করছে, তাদের ২৫ ভাগ শিশুই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, আর ১০ ভাগ শিশু গৃহকর্তার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু তা কখনোই প্রকাশিত হয় না। গৃহকর্মে নিযুক্ত যেসব শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ভবিষ্যতে তারা মানসিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। যাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহননের পথ ও বেছে নিচ্ছে। গৃহকর্মে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে কেবল আইনই নয়, এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের সামগ্রিকভাবে সার্বক্ষণিক নজরদারি ছাড়াও কোনো বিকল্প নেই।'
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক ও শিশু অধিকার বিষয়ক থিমেটিক কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, 'নীতিগত কোনো বিষয় থাকলে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুপারিশ করে থাকি। আমরা ইতোমধ্যেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপের পরেও কেন গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না, তা আমাদের জানা নেই। তবে এক্ষেত্রে আমাদের পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, আমরা কোনটি চাচ্ছি। গৃহকর্মে কাজটি কি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, নাকি শিশুদের যেভাবে ব্যবহার করা হয় তা ঝুঁকিপূর্ণ! ইনফরমাল ও ফরমাল সেক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধতাটি এই জায়গাটিতেই যে, চাইলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ফরমাল সেক্টরের যেকোনো কারখানায় ঢুকে পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন, কিন্তু গৃহকর্মে শিশুদের বিষয়ে তা পারছেন না। এক্ষেত্রে আগে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে গৃহের শিশুশ্রমকে যদি অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।'
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা বলেন, 'গৃহকর্মে শিশুশ্রম কেবল ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম হিসেবে চিহ্নিত করে অন্তর্ভুক্ত করাটাই যথেষ্ট নয়, সম্পূর্ণভাবে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা উচিত। এজন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি শিশু সুরক্ষা আইন পূর্ণাঙ্গভাবে গঠন করা উচিত।'
সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'শিশুদের একটি অংশ এখনো মানবিক মর্যাদা পাচ্ছে না। গৃহকর্মে নিযুক্ত ৯০ শতাংশ শিশুই মানবিক মর্যাদা পাচ্ছে না এবং নানাভাবে নিপীড়িত হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। মানবাধিকার কমিশন এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে উপস্থাপন করব যেন ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় গৃহকর্মের শিশু শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।'
অনুষ্ঠানে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা ২ শিশু নিজেদের প্রতিকূল অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে গৃহকর্মে শিশুশ্রম বন্ধের দাবি জানায়।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এম এ করিম।
Comments