জসীম উদ্দীনের ‘যে দেশে মানুষ বড়’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জিজ্ঞাসা 'বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি'। আসলে কতটুকু জানি! তার মত অনেকের মধ্যেই রয়েছে অজানাকে জানার আগ্রহ । সেই আগ্রহের সহায়ক হতে পারে কবি জসীম উদ্দীনের নান্দনিক বর্ণনায় নির্মিত "যে দেশে মানুষ বড়। তিনি প্রায় ৫৫ বছর আগে ভ্রমণ করেছিলেন রুশদেশে। লিখেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা। যেমন আছে সোভিয়েতের সমাজ, রাষ্ট্র, সমাজতন্ত্র ও বিপ্লব, তেমনই আছে শিশুদের প্রতি কবির মমতা, রুশ শিল্পের বর্ণনা, এমনকি সোভিয়েত নারীদের প্রতি মুগ্ধতার বয়ানও।
এক সময় এই অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সকলে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও, তাদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি একধরণের সহানুভূতি থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। কবি জসীম উদ্দীনও তার ব্যতিক্রম নন। তাদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি স্বপনের দেশ। ১৯১৭ সালে তৎকালীন বিপ্লবী নেতা লেনিনের নেতৃত্বতে সে-দেশে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। হয়তবা, তারই প্রভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল সকলের জন্যই সোভিয়েত ছিল একটি স্বপ্নরাজ্য। কবি নিজেও তার ভ্রমণ কাহিনীতে রুশ বিপ্লব ও লেলিনের কথা উল্লেখ করেছেন। ঘুরে দেখেছেন বিপ্লবের সাক্ষী হয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থান।
লেলিনগ্রাডে তিনি প্রথমে যান "স্বাধীনতাকামীর চির-তীর্থভূমি"তে। তীর্থভূমির বর্ণনায় লিখেছেন: "একটি ট্যাঙ্ক রাখিয়া স্থানটি চিহ্নিত করা হইয়াছে। ডানদিকে উন্মুক্ত প্রান্তর। বামধারে একটি পার্ক। ট্যাঙ্কের পাশে কয়েকখানা টুল পাতা। তারই একখানায় বসিয়া মানস নয়নে আঁকিতে লাগিলাম এই মহাকাহিনীর ইতিহাস।"
কবির অনুভূতি ফুটে উঠেছে কল্পনার এক বর্ণনায়। "মানস নয়নে যেন দেখিতে পাইতেছি কত মাতা সন্তানকে শেষ চুম্বন দিয়া বিদায় দিতেছে, কত বধূ তার দয়িতকে বীরের সাজে সাজাইয়া এখানে পাঠাইতেছে, কত পিতা, কত পুত্র, কত বন্ধু, কত আত্মীয় আপনার প্রিয়জনকে হাসিমুখে এই মরণযজ্ঞে পাঠাইয়া দিতেছে। এ কোন মমতা - এ কোন প্রেম!"
এছাড়াও তিনি গিয়েছিলেন লেলিন স্মৃতি-মিউজিয়ামে। কবি উল্লেখ করেন কিভাবে সেখানে লেলিনের ব্যবহৃত সকল আসবাবপত্র সংরক্ষিত করা হয়েছে। তিনি লিখেন: "এখানেই লেলিন তাহার বিপ্লবের কাজ আরম্ভ করেন। যে চেয়ারে বসিয়া, যে টেবিলখানি সামনে রাখিয়া মহামতি লেলিন লেখাপড়া করিতেন, যে বিছানায় তিনি শয়ন করিতেন, তার কাগজকলম, আসবাবপত্র সকলই তার জীবিতকালে যেখানে যেমন ছিল তেমনই আছে। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কথা, আদেশপত্র, চিঠি সবই গ্লাস-কেসে রহিয়াছে; তাহাছাড়া ঘরের দেয়ালে লেলিনের জীবনের কয়েকটি ঘটনা চিত্রিত আছে।"
কবি মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা লিখেন এইভাবে: "এখান থেকে ফিরিয়া যাইতে কেবলই মনে হইতেছিল, এই বিরাট পুরুষ, যার অঙ্গুলি হেলনে শত শত যুবক মৃত্যুকে অবহেলা করিত, কী সাধারণ, কী সহজ ছিল তাঁর স্বকীয় জীবনযাপন!" মিউজিয়ামে সংরক্ষিত লেলিনের প্রতিটি স্মৃতিই বিস্মিত করেছে তাঁকে। তাঁর বিস্ময় ও অশেষ শ্রদ্ধা থেকেই তিনি লেলিনকে "মহামানুষ" বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কবির রুশদেশের বৈচিত্র্যময় স্থানগুলো ঘুরে দেখার মধ্যে অন্যতম শিশুকেন্দ্র, যেখানে তার ভাষায় "শিশুদের রাজত্ব" রয়েছে। তার ভ্রমণে শিশুকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ বহন করে কবির শিশুদের প্রতি ভালোবাসার চিহ্ন। তার শিশুদের প্রতি মমতা ফুটে উঠেছে মস্কো শহর থেকে দূরে ভূমধ্যসাগরের কাছে এক শিশুকেন্দ্রের শিশুদের নিয়ে অভিজ্ঞতার এক মায়াময় বর্ণনায়: "এ যেন নন্দনের দেবশিশুরা। কী সুন্দর হাসিখুশি মাখা মুখ। এদিক দিয়া-ওদিক দিয়া দু'একজন কাছে আসে, আমাকে আবার ছুয়ে পালাইয়া যায়। ভারি ভালো লাগিল এদের সঙ্গে খেলা করিতে।"
তাসখন্দে গিয়েও কবি জসীম উদ্দীন এক শিশুকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। পরিদর্শনকালে সেখানকার শিশুরা ঘুমাচ্ছিল এবং শিশুদের নিয়ে তার সেই অভিজ্ঞতারও এক স্নেহভরে বর্ণনা দেন তিনি: "বাহিরে ঘুরিয়া এই ঘুমন্ত শিশুদের দেখিতে লাগিলাম। আকাশের শত শত তারার মতো তাহাদের সুন্দর মুখগুলি। ... ছোট ছোট বিছানায় যেন কতগুলি ফুল ফুটিয়া আছে।" কবির শিশুদের প্রতি অপার ভালোবাসা বারবার ফুটে উঠেছে তার বর্ণনায়, এবং তাঁর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ বর্ণনাগুলোই আমাদেরকে কবির উদার এবং সংবেদনশীল চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
কবি রুশ নারীদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ এবং তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন। তবে, ভ্রমণকালে তার যত নারীর সাথে পরিচয় হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য সাতলানা নামক এক তরুণী। সাতলানা- "ফুলের চেয়েও কোমল" এ তরুণী সম্পর্কে পড়তে পড়তে পাঠকের মনে এ প্রশ্নও সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক যে তিনি কি সেই তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন কিনা। অবশ্য, কবি সাতলানাকে তাঁর ভালো লাগার কথা বলেননি, এমটা ভাবলে ভুল হবে।
জনশ্রুতি আছে প্রেমে পড়লে সেই ব্যক্তির মনের পর্দায় তার ভালোবাসার মানুষের প্রতিচ্ছবি বেলি ফুলের মত ফুটে থাকে। কবির সাতলানার জন্য অপেক্ষার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে ঠিক তেমনই এক চিত্র: "আজ বহু মেয়ের মধ্যে সাতলানাকে খুঁজিতে যাইয়া দেখি সে যেন এক, বহু হইয়া গেছে। এদিক হইতে, ওদিক হইতে যত মেয়ে আসে দূর হইতে সবাইকে সাতলানা বলিয়া মনে হয়। যত তারা নিকটে আসে, একে একে তারা সাতলানা না হইয়া আমার মনের পর্দা হইতে সরিয়া যায়। ... আমার আশার প্রদীপ নিভিয়া যায়।"
সাতলানা মূলত ছিল মস্কো শহরের ইউক্রেন হোটেলে কর্মরত একজন অনুবাদক। কবি হোটেলে অবস্থানের সময়ে পরিচয় হয় সেই তরুণীর সঙ্গে। শুরু থেকেই সাতলানার প্রতি এক অন্যরকম আগ্রহের চিত্র লক্ষ্য করা যায় তার এই ভ্রমণবৃত্তান্তে। সেই আগ্রহ থেকেই তিনি ফটোগ্রাফারের উপস্থিতিতে সাতলানার সঙ্গে ছবি তুলে নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। অবশ্য, তরুণীর সঙ্গে কবির ছবি তোলার এই ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি তার ব্যক্তিগত অনুবাদক মিঃ বারানভ। পরবর্তীতে মিঃ বারানভের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি কবিকে বলেছিলেন, "আপনারা কবিরা সবসময়ই এরকম ভুল করিয়া থাকেন।" আসলেই কি কবিরা প্রতিনিয়তই এমন ভুল করে থাকেন? মিঃ বারানভের এমন মন্তব্যে পাঠকের কাছে বিনোদন হিসেবে ধরা না দিয়ে পারবে না।
কবি জসীম উদ্দীন ঘুরে দেখেছেন রুশদেশের বেশ কিছু জাদুঘর ও ছবির গ্যালারী। তিনি সোভিয়েতে অবস্থানকালীন দেখা করেছেন সে দেশের বহু লেখকদের সঙ্গে। এছাড়াও তিনি একাধিকবার গিয়েছেন থিয়েটারে নৃত্যনাট্য ও মঞ্চনাটক দেখতে। সেদেশে শিল্প-সাহিত্যের সংরক্ষণ, মানুষ ও রাষ্ট্রের কাছে শিল্পর গুরুত্ব, এবং সে রাষ্ট্রে শিল্পী-সাহিত্যিকদের মর্যাদা দৃশ্য কবিকে হতাশ করিয়েছেন আমাদের দেশের কথা ভাবিয়ে।
তার হতাশা প্রকাশ পেয়েছে তাজিকিস্তানের বিখ্যাত লেখক সদরউদ্দীন আইনির মাজার পরিদর্শনের প্রতিক্রিয়ায়: "পথে আসিতে আসিতে কেবলই মনে হইতেছিল সোভিয়েত দেশ তার কবি সাহিত্যিকদের কত সম্মান করেন। মীর মোশাররফ হোসেন, সিরাজী, কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফা এঁদের কবরগুলি কি আমরা এরূপে রাখিয়াছি! ... সেই কবিত্বময় স্থানগুলো দেখিয়া তাহাদের দেশবাসী আমরাই উপকৃত হইতাম।" বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরা এখনো সেই অবহেলার শিকার নন কি? কবির এই হতাশার সঙ্গে বর্তমানেও বহু পাঠক সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন।
বইয়ের নামটি যে কবি রুশদেশের মানুষের আকৃতি বুঝাতে বলেননি, বরং সে দেশের মানুষের আচার-আচরণ ও নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তাদের বড় বলে আখ্যায়িত করেছেন, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কৌতুহলি পাঠক মনে বারবার একটি প্রশ্ন জেগে উঠে- কেনো সে দেশের মানুষ কবির কাছে বড় হয়ে উঠলো? এমন কি কীর্তি-কর্মের পরিচয় তাদেরকে কবির কাছে এত বড় করে তুললো?
সোভিয়েতের বহু কীর্তিময় ইতিহাস, সমাজতন্ত্র-সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা প্রতিষ্ঠানের- মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রচেষ্টা তো বটেই, সে দেশের মানুষ কেনো বড়- তার সবচেয়ে ভালো উত্তর দিতে পারবে কবির ভ্রমণকালের সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র, সাতলানা।
একদিন সাতলানা বেশ রাগান্বিত হয়েই কবিকে বলেছিল: "জানেন মিঃ জসীম উদ্দীন! আমার দেশের মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য বিস্তার করিয়া পুরুষকে কঠোরতর কাজের পথে আগাইয়া দেয়। শুধু তাই নয়। আমরা মেয়েরা তাদের কঠোরতর কাজের সমভাগী হইয়া তাদের সঙ্গে সঙ্গে কাজ করি। এত বড় রুশ বিপ্লবের কথা আপনারা শোনেন পুরুষের পাশে পাশে এখানে মেয়ের ছিল। পুরুষদের সঙ্গে মেয়েরাও জীবন দান করিয়াছিল। ...গত যুদ্ধে আমরা যে জার্মানদের তাড়াইতে পারিয়াছিলাম তার পিছনে আমাদের মেয়েদের দান কোন অংশে কম ছিল না।"
সাতলানার কথায় তো বটেই, কবি নিজেও দেখেছিলেন যে সোভিয়েতে মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। নেই কোনো অসমতা। নারী-পুরুষ, কর্ম-পেশা নির্বিশেষে সকলে সমান এবং সমাজে সম-গুরুত্বের অধিকারী। তাই, জসীম উদ্দীনকে যখন এক রুশ বেতারকর্মী জিজ্ঞেস করেছিলেন সোভিয়েত দেশের কোন ব্যাপারটা তাকে সব থেকে বেশি মুগ্ধ করেছে, উত্তরে তিনি বলেছিলেন: "এদেশে আসিয়া আমার সব চাইতে বেশি ভাল লাগিল, আপনারা আপনাদের জনগণকে সব চাইতে উচ্চ আসন দিয়াছেন।"
Comments