সেই ভয়ংকর রাতের স্মৃতি

holey artisan
২০১৬ সালের ১ জুলাই অস্ত্রধারী জঙ্গিরা গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ২২ জনকে হত্যা করে। ছবি: ফাইল ফটো

২০১৬ সালের ১ জুলাই, রমজানের শেষ দিকের অন্যান্য দিনের মতোই এক সন্ধ্যা ছিল সেদিন হোলি আর্টিজান বেকারিতে।

গুলশান-২ এর অভিজাত এলাকার পশ্চিমা ধাঁচের ক্যাফেটিতে ইফতারির পর ভিড় কিছুটা কম ছিল। সময় গড়ানোর সাথে সাথে বিদেশি ও বাংলাদেশিদের কাছে সমান প্রিয় দোতলা এই খাবারের দোকানটিতে আসতে শুরু করেন অতিথিরা।

বাড়তে থাকে পিৎজা, পেস্ট্রি, ক্রোসান্ট আর কফির অর্ডার। রাত ৮টার মধ্যেই রোস্তারাঁটি তার অতিথি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিদেশিদের মধ্যে ইতালীয় ও জাপানিদের দুটি গ্রুপ ছিল। কয়েকজন বাংলাদেশিও তাদের রাতের খাবার খাচ্ছিলেন।

সে রাতে কী ভয়াবহতা অপেক্ষা করছিল তার কোনো ধারণাই কারো ছিল না।

রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে আতশবাজির মতো বিকট আওয়াজ শুনতে পান অতিথিরা। রামদা, গ্রেনেড আর আধা-স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ পাঁচ যুবক 'আল্লাহু আকবর' চিৎকার দিতে দিতে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে এবং এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে।

চিৎকার আর আর্তনাদে চারদিকের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত অতিথিরা টেবিলের নিচে আশ্রয় নেন অন্যদিকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এদিক সেদিক ছুটছিলেন রেস্তোরাঁ কর্মীরা।

অতিথিদের জিম্মি করে সন্ত্রাসীরা পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ করতে বলে তাদের মধ্যে থেকে অমুসলিমদের আলাদা করে।

পুরো জাতি প্রত্যক্ষ করে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই জিম্মি সংকট পরিস্থিতি। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে প্যারা কমান্ডোরা সেখানে অভিযান চালায়। এসময় পাঁচ হামলাকারীকে হত্যা করা হয়, নিহত হয় এক শেফ।

রেস্তোরাঁর ভেতরে এক নৃশংস বীভৎস দৃশ্য দেখতে পান প্যারা কমান্ডো সদস্যরা। রক্তে ভেসে যাওয়া রেস্তোরাঁর মেঝেতে পড়ে আছে রক্তমাখা সব মরদেহ। 

রক্তস্নাত সেই মৃত্যুর মিছিলে মাত্র ২০ বছর বয়সী এক তরুণের সাহস, বন্ধুত্ব আর মানবতার দৃষ্টান্ত দেশের মানুষের অন্তর্মূল যেন কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।

ফারাজ আয়াজ হোসেন, যিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন। চাইলে মুক্ত হতে পারতেন কিন্তু সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বন্ধুদের ছেড়ে আসতে চাননি, এমনকি আতঙ্ক আর মৃত্যুর মুখেও তাদের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার আটলান্টার এমোরি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ফারাজ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার বন্ধু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অবিন্তা কবির এবং ভারতীয় নাগরিক ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার শিক্ষার্থী তারিশি জৈন নিহতদের মধ্যে ছিলেন।

সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস-অনুপ্রাণিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একটি অংশের সমন্বয়ে গঠিত নব্য জেএমবি গুলশানে এই হামলা সরকারের জন্য ছিল 'ওয়েকআপ কল'। এরপরই জঙ্গিদের আটকে ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালায় সরকার।

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকটি জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস করে। হামলার মাস্টারমাইন্ড -- বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী, এক মাস পর ২৭ আগস্ট, ২০১৬ তে এরকম এক অভিযানে নিহত হন।

তামিম ২০১৩ সালে বাংলাদেশে আসার পর নব্য জেএমবির নেতৃত্ব দেন এবং ২০১৫ সালে এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। ওই বছরের ১১ জুলাই তার দল মূলধারার জেএমবি নেতা সারোয়ার জাহান মানিকের গ্রুপে যোগ দেয়। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর এক অভিযানে সারওয়ারও নিহত হয়।

ক্যাফেতে হামলার পর থেকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই ডজনেরও বেশি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান চালায় যেখানে অন্তত ৭৯ জঙ্গি নিহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ধ্বংস বা জব্দ করা হয়।

গুলশান ক্যাফেতে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়।

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ৭ জঙ্গিকে হামলায় জড়িত থাকার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ট্রাইব্যুনাল এ ঘটনাকে কলঙ্কজনক ও বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হননের লক্ষ্যে চালানো হামলা হিসেবে অভিহিত করে।

রায়ে আদালত জানায়, এই কলঙ্কজনক হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানকার বিদেশিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হয়েছে।

চলতি বছরের মে মাসে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু করেছে হাইকোর্ট। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শুনানি শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং তারপর হাইকোর্ট তার রায় জানাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Cops gathering info on polls candidates

Based on the findings, law enforcers will assess security needs in each constituency and identify candidates who may pose risks.

12h ago