বিদ্যুৎখাতের সংকট রাজনৈতিক

প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

দেশের চলমান বিদ্যুৎ সংকট রাজনৈতিক এবং তা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।

ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের 'চলমান বিদ্যুৎ সংকট: কেন তৈরি হলো? উত্তরণ কীভাবে?' শীর্ষক ওয়েবিনারে আজ শনিবার বক্তারা এসব কথা বলেন।

তারা বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ও চাহিদা নিয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়, সেগুলো বিভ্রান্তিমূলক। বাস্তবে সরকারি হিসাবের চেয়ে দেশে উৎপাদন কম এবং চাহিদা বেশি।

ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক ও লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানির জোগান পরিকল্পনাকে সাস্টেইনেবল করতে ব্যর্থ হওয়া। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফুয়েল প্ল্যানিং না থাকা, অফশর ও অনশোরে গ্যাস কূপ খননে গড়িমসি, সর্বোপরি সবুজ বিদ্যুতে বিনিয়োগ এবং সবুজ বিদ্যুৎ বান্ধব নীতি কৌশলের অভাব।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের হিস্যা কমার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বিদেশি উৎস থেকে এলএনজি আমদানির চুক্তি যথাসময়ে না বাড়িয়ে, স্পট মার্কেট থেকে আমদানির ঝোঁক থেকে সমস্যার শুরু হয়েছে। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তীতে স্পট মার্কেটে দাম বাড়ায় ডলার সংকটে গ্যাস কিনতে না পারা, কাতার ও ওমানের উৎপাদনকে ইইউ রাষ্ট্রগুলো বুক করে ফেলায়, নতুন করে আমদানি চুক্তির ব্যর্থতা এবং জ্বালানি কূটনীতিতে দুর্বলতা।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কি ইউক্রেন যুদ্ধের একমাত্র কারণ?, এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক জ্বালানি মূল্যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান মূল্য ২০১৮-১৯ সালের বেজ প্রাইসের সমান হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার মূল্য কমে ইউক্রেন যুদ্ধের আগের কাছাকাছিতে নেমে এসেছে। এলএনজি মূল্য ইউক্রেন যুদ্ধের আগে চেয়েও কিছুটা কমে এসেছে। তেল, গ্যাস ও কয়লার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা বিশ্ববাজারের মূল্য পরিস্থিতি নয়, বরং মূল সমস্যা মোট আমদানির সম্মিলিত চাপ এবং ডলার রিজার্ভ পরিস্থিতি।

লোডশেডিংয়ের প্রধানতম কারণ জ্বালানি হলেও অন্যতম প্রধান কারণ ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, ১২ এপ্রিল প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ১৫৪ মেগাওয়াট, অর্থাৎ সক্ষমতার তুলনায় ৮ হাজার ১৭৮ মেগাওয়াট কম। তথাপি সেদিন ৭৭৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। এ দিন ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সক্রিয় ছিল, যার মধ্যে ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (৩১ দশমিক ৪ শতাংশ) ইঞ্জিন যন্ত্রপাতির সমস্যা ছিল, ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (২২ দশমিক ২ শতাংশ) জ্বালানি সংকটে ভুগেছে এবং ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (৭ দশমিক ৮ শতাংশ) মেরামতের কাজ চলছিল। যন্ত্রপাতির সমস্যা ও জ্বালানির অভাব—এই দুটি কারণেই ৯৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (৬১ দশমিক ৪ শতাংশ) ঠিকমতো চলেনি। এক চতুর্থাংশেই যন্ত্রপাতির সমস্যা।

দুর্নীতিবান্ধব ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংস্কারের কথা উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাহীন একদল ব্যবস্থাপক ভুল ও অদূরদর্শী পিপিএ বা পিপিআর নামক আইনি প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতকে অযোগ্য সরবরাহকারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ক্যাপাসিটি চার্জের চুক্তিগুলোয় পলিটিক্যাল ইনিশিয়েটিভে রি-নেগোসিয়েশনের উদ্যোগ নিলে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল কমে আসতে পারে। 'ডলার ড্রেনিং' ক্যাপাসিটি চার্জ কমিয়ে আনতে না পারলে বিদ্যুৎ খাতের পেমেন্ট সংকট কাটবে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, 'বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের যে কথা বলা, সেগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। আমরা সত্যিকার অর্থে উৎপাদন করতে পারি ১৮ থেকে ১৯ হাজার মেগাওয়াট এবং চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো।'

তিনি বলেন, বিদ্যুতের কারিগরি বিষয়গুলো নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে, যেগুলো ঠিক হয়নি। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সেভাবে গ্রহণ না করে রাজনৈতিকভাবে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু মানুষকে সুবিধা দেওয়ার জন্য পক্ষপাতিত্ব করা হয়।'

এই অধ্যাপক বলেন, 'যেসব প্ল্যান্ট বসিয়ে রাখা হচ্ছে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। আর যেসব ডিজেলচালিত প্ল্যান্ট থেকে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় আর অধিকাংশ সময় অকার্যকরভাবে থাকে, সেগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এই মন্ত্রণালয়ে যারা কাজ করেন, তারা অধিকাংশ নন-টেকনিক্যাল লোক। তারা জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতে বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্তগুলো পরিবর্তন করে দিয়ে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। যে টেন্ডার হয় সেগুলো ওপেন করে দিতে হবে।'

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া এই সংকট দূর করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

শেয়ার বিজের নির্বাহী সম্পাদক মো. ইসমাইল আলী বলেন, 'লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে যত মেগাওয়াটের হিসাব দেওয়া হয়, বাস্তবে তা আরও বেশি। কারণ আমাদের ডিমান্ড ফোরকাস্টের সঠিক হিসাব দেখানো হয় না। বিদ্যুতের চাহিদা নিয়ে ২০১৬ সালে পল্লীবিদ্যুৎ যে জরিপ করেছিল, সেটিই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে প্রতিবছর তার সঙ্গে ৫ শতাংশ করে যোগ করা হয়। কাজেই প্রকৃত চাহিদা কত, তা আমরা জানতে পারি না।'

তিনিও রাজনৈতিক বিষয়টিকে সামনে এনে বলেন, 'এই খাতে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে পিডিবি কয়লার বিল দিতে পারছে না। সরকার কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেবে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো পিডিবি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়। সমস্যার পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতা।'

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, 'একটি বিশেষ আইনের ক্ষমতাবলে বিদ্যুৎখাতের সব চুক্তিকে বৈধ করা হয়। ফলে এ খাতের দুর্নীতি নিয়ে তেমন প্রশ্ন করা যায় না। তবে এই বিশেষ আইনের মাধ্যমে কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।'

তিনিও এই সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা উল্লেখ করে বলেন, 'বলা হচ্ছে মূলত ডলার সংকটের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পাই আমরা যাদের কাছ থেকে ডলার আয় করি, তাদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক করছি, আর যাদের কাছে ডলার ব্যয় করি তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখছি। সংকট মূলত রাজনৈতিক।'

তিনি বলেন, 'জিডিপির প্রবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্নখাতে আমাদের যে ডেটা দেওয়া হয়, তা সঠিক নয়। এখানে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়া হয়। অনেক সময় ডেটা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেওয়া হয়। যে সমস্যা আছে সেগুলো আমরা সমাধান করতে চাইনি। বিশেষ কিছু মানুষকে সুবিধা দিতেই এসব করা হচ্ছে।'

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, 'আমার ডিমান্ড ফোরকাস্ট ঠিক করতে হবে। যেগুলোর উৎপাদন অনেক কম সেগুলো বসিয়ে না রেখে বন্ধ করে দিতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে হবে। তাহলেই বর্তমানে জ্বালানিখাতে যে সংকট সেখান থেকে কিছুটা বের হওয়া যাবে।'

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো আলী রীয়াজ বলেন, 'বিদ্যুৎখাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা অনুপস্থিত। পরিকল্পনাগুলো অংশগ্রহণমূলক হয় না। বিদ্যুৎখাতে যে সংকট, তা কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি। কিন্তু তা সমাধানে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, 'এই খাতের সংকট নির্ভর করছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। আমাদের সমাধান বাইরে থেকে এসে কেউ দেবে না। আমাদের সমাধানের সক্ষমতা আছে। আমাদের বিশেষজ্ঞ লোক আছেন। সেজন্য অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

2h ago