মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন
'বাংলার মাটিতে প্রতিদিন রক্ত বয়ে যায়,
প্রতিটি পথিক তাদের রক্তভান্ডারে রেখে যায় খানিক রক্ত
ভবিষ্যতের জমির প্রয়োজনে যে রক্ত সংরক্ষিত করা হয়,
বাংলার মাটি শুষে ন্যায় সে তামাম রক্ত।
আর তাতে শুঁকিয়ে যায় নদী, অদৃশ্য হয় সমুদ্র…'
লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আয়োজিত 'কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি'তে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্বরচিত এই কবিতাটি আবৃত্তি করতে গিয়ে চোখের অশ্রু বাঁধ মানেনি প্রখ্যাত অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসনের। ভিটেমাটি ছাড়া লাখো অসহায় শরণার্থী আর যুদ্ধাহত শিশুদের বেদনার্ত মুখ স্মরণ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে গ্লেন্ডা জ্যাকসন আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'আশ্রয়হীন, স্বজন হারানো, দেশচ্যুত এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এখন পৃথিবীর প্রতিটি বিবেকবান মানুষের দায়িত্ব।'
দীর্ঘ সময় রোগভোগের পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরম সুহৃদ ও স্বাধীনতার বন্ধু, কিংবদন্তি অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। গ্লেন্ডা জ্যাকসনের মুখপাত্র লিওনেল লার্নার গতকাল এক বিবৃতিতে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বলেন, 'সকালে লন্ডনের ব্ল্যাকহেথে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত গ্লেন্ডার পরিবারের সদস্যরা তার পাশে ছিলেন।'
অভিনয় জীবনে অনন্য অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ দুই বার অস্কার, তিন বার অ্যামি, দুই বার বাফটা ও একবার টনি পুরস্কার পেয়েছেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন।
তার মৃত্যুর পর প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক পিটার ব্র্যাডশ বলেন, 'গ্লেন্ডা জ্যাকসন চলচ্চিত্রে এক বিশেষ ক্লাসের জন্ম দিয়েছেন, যা আগে কখনো হয়নি।'
গ্লেন্ডা জ্যাকসন জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালে উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের বিরখেনহেডে এক দরিদ্র পরিবারে। কিন্তু তার শিল্পমনা ও সিনেমা-পাগল মা হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্লেন্ডা ফারেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিলেন। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই কিশোর বয়সে টাউনস ওমেনস গিল্ড নাটকের দলে অভিনয় করার সুযোগ পান গ্লেন্ডা।
১৯৫২ সালে জেবি প্রিসলির মিস্ট্রি অব গ্রিনফিঙ্গারে প্রথম অভিনয় করেন গ্লেন্ডা। পরবর্তীতে ফার্মেসি চেইন 'বুটস দ্য কেমিস্ট' এ ২ বছর কাজের পর বৃত্তি নিয়ে লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টে অভিনয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ১৯৫৭ সালে নাট্যকার টেড উইলিসের 'ডক্টর ইন দ্য হাউস' নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মঞ্চে অভিষেক হয় গ্লেন্ডার। ১৯৬৩ সালে লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের 'দিস স্পোর্টিং লাইফ' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। ১৯৬৭ সালে স্যার পিটার হল প্রযোজিত শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাটক হ্যামলেটের 'ওফেলিয়া' চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দারুণভাবে নজর কেড়েছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন।
নাট্য সমালোচক পেনেলোপ গিলিয়েট বলেছিলেন, 'গ্লেন্ডার নিখুঁত অভিনয় দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে নিজেকে যুবরাজ হ্যামলেটের চরিত্রে আবিষ্কার করেছিলাম।'
তৎকালীন সময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাড়া জাগানো প্রযোজনা 'টেল মি লাইস', যেখানে একইসঙ্গে দুর্দান্ত অভিনয়, আবার অন্যদিকে মানবতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে অনন্য এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন গ্লেন্ডা।
১৯৬৯ সালে ডিএইচ লরেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস 'ওমেনস ইন লাভ'র পটভূমিতে নির্মিত হয় একই নামের চলচ্চিত্র 'ওমেনস ইন লাভ'। এই চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ ও একইসঙ্গে অতুলনীয় অভিনয় করেছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন ১৯৭০ সালের একাডেমি অ্যাওয়ার্ড।
ব্রিটিশ ফিল্মের এনসাইক্লোপিডিয়ায় ব্রায়ান ম্যাকফারলেন এই চলচ্চিত্রে গ্লেন্ডা জ্যাকসনের দুর্দান্ত উপস্থিতি এবং অতুলনীয় অভিনয়ের প্রশংসায় লিখেছিলেন, 'এই চলচ্চিত্রে তার উজ্জ্বল বুদ্ধিমত্তা ও ঘৃণ্যতায় অভিনয়ের যে রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, তা ছিল ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও এক বিরলতম দৃষ্টান্ত।'
অস্কারজয়ী অভিনেত্রী হওয়া সত্ত্বেও মানবতার টানে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি গ্লেন্ডা জ্যাকসন। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আদলে ব্রিটেনের মোট ৮টি শহরে আয়োজিত হয়েছিল 'কনসার্ট ফর সিমপ্যাথি'। এই শহরগুলো ছিল লন্ডন, লিভারপুল, বার্নিংহাম, শেফিল্ড, লিডস, স্কানথর্প, লেস্টার ও কোলচেস্টার।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর উদ্যোগে কনসার্ট ফর সিমপ্যাথির লন্ডনের আয়োজনটি হয়েছিল বিখ্যাত স্যাডলারস ওয়েলস থিয়েটারে। অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের ভাতিজা বীরন্দ্র শঙ্কর। সেই আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন ভারত ও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী ও অভিনয়শিল্পী। এদের মধ্যে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা, ফণীভূষণ ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সবিতাব্রত দত্ত, পল্লীগীতি শিল্পী শাহ আলী সরকার, মোশাদ আলী প্রমুখ।
আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শরণার্থী ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে বেশ কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন। একইসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, 'এই মুহূর্তে এই অসহায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি বিবেকবান মানুষেরই দায়িত্ব।' গ্লেন্ডা জ্যাকসনের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসংখ্য বিদেশি নাগরিক সেদিন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়ে দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে অর্থ সহায়তা দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের বছরেই রানি এলিজাবেথের ওপর নির্মিত বিবিসির সিরিয়াল 'এলিজাবেথ আর' এও অসামান্য অভিনয় করেছিলেন গ্লেন্ডা। সিরিয়ালটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিবিএসে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দর্শক-সমালোচক থেকে সর্বত্রই দারুণ সাড়া ফেলেছিল। সিরিয়ালে প্রশংসনীয় অভিনয়ের জন্য ২টি প্রাইমটাইম এমি এ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন।
একই বছর রানি এলিজাবেথের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র 'মেরি কুইন অব স্কটসে'ও দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য অস্কারে নমিনেশন পেয়েছিলেন তিনি। যদিও সে দফা না পেলেও একই বছর 'সানডে ব্লাডি সানডে' চলচ্চিত্রে নিখুঁত অভিনয়ের জন্য পান বাফটা অ্যাওয়ার্ড।
বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র ও সিরিয়ালে গ্লেন্ডা জ্যাকসনের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার মেলভিন ফ্রাঙ্ক। বুঝতে পেরেছিলেন হাস্য রসাত্মক ও রোমান্টিক চলচ্চিত্রে দারুণ অভিনয় করতে পারবেন গ্লেন্ডা। ১৯৭৩ সালে গ্লেন্ডা জ্যাকসনকে প্রধান নারী চরিত্রে রেখে নির্মিত হলো 'অ্যা টাচ অব ক্লাস'।
চলচ্চিত্রটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে রাতারাতি ব্রিটিশ বক্স অফিসে এক নম্বরে উঠে আসে চলচ্চিত্রটি। ১৯৭৪ সালে এই চলচ্চিত্রে নিখুঁত ও দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পান গ্লেন্ডা জ্যাকসন।
চল্লিশের দশকে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেবার পার্টিতে যোগ দিলেও রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে ছিলেন গ্লেন্ডা। তবে ১৯৭৮ সালে অ্যান্টি-নাজি লীগের অর্থায়নদাতা ছিলেন তিনি। একইসঙ্গে কখনোই থেমে থাকেনি তার মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ড। অক্সফাম থেকে ইউনিসেফের মানবতাবাদী কার্যক্রমের সর্বত্রই ছিল তার বিচরণ। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ভলেন্টিয়ারি হোস্টেলেও তিনি ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাসে রাজনৈতিক বন্দিদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন গ্লেন্ডা। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার শিশুদের নিয়ে ইউনিসেফের বিভিন্ন মানবতাবাদী কার্যক্রমেও গ্লেন্ডা বরাবরই ছিলেন চির সোচ্চার।
নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্রের অভিনয় ছেড়ে পাকাপাকিভাবেই রাজনীতিতে চলে যান গ্লেন্ডা জ্যাকসন। ১৯৯২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একটানা তিনি লেবার পার্টির হয়ে নর্থ লন্ডনের এমপি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিলেন।
এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে তিনি টনি ব্লেয়ার সরকারের পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে আক্রমণ ও টনি ব্লেয়ারের পক্ষাবলম্বন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যুদ্ধে নামার বিষয়টি তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। ইরাক যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রকাশ্যেই টনি ব্লেয়ারের সমালোচনা করেছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন। যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টিকে তিনি দেশের জন্য চরম লজ্জা ও হতাশাজনক হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন।
দীর্ঘ ২৩ বছর বিরতির পর রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে ২০১৫ সালে আবারও অভিনয়ের জগতে ফেরেন গ্লেন্ডা। এমিল জোলার বিখ্যাত উপন্যাসের ওপর রেডিও ফোর নির্মিত 'ব্লাড সেক্স অ্যান্ড মানি'তে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে ফের শেক্সপিয়রের কিং লিয়ারে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মঞ্চে ফেরেন তিনি।
বরাবর মঞ্চ অন্তপ্রাণ ছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন। চলচ্চিত্র-রাজনীতি সবকিছুর বাইরে, সব অনুপস্থিতির মাঝেও মঞ্চকে তিনি বারবার স্মরণ করতেন। প্রায় ৩ দশক পর ২০১৯ সালে টিভি নাটক 'এলিজাবেথ ইজ মিসিং'র মধ্য দিয়ে টিভি পর্দায় ফের দেখা যায় গ্লেন্ডা জ্যাকসনকে, যে কারণে তিনি পেয়েছিলেন বাফটা অ্যাওয়ার্ড।
গ্লেন্ডা জ্যাকসনের মৃত্যুর খবরে শোকাহত প্রখ্যাত অভিনেতা ও সংগীত শিল্পী স্যার জনাথন প্রাইস এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমি মনে করি আমাদের দেশে গড়ে ওঠা সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি।'
তথ্যসূত্র:
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি : আবু সাঈদ চৌধুরী
ব্রিটিশ ফিল্মের এনসাইক্লোপেডিয়া
Comments