নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ ও সিইসির হতাশ প্রতিক্রিয়া

দেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কবে হবে, কিংবা আদৌ হবে কি না, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জল্পনাকল্পনা এখন তুঙ্গে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংবিধিবদ্ধ সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা—বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন—যত না কাজে, তারচেয়ে বেশি কথায় যারপরনাই তৎপর হয়ে উঠেছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্বও গা ঝাড়া দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের দৌড়ঝাঁপ, আর  রাজনৈতিক দেনদরবারের কম্পাংক কখনো দেশের ভিতরে, কখনো বাইরে। অন্যদিকে দেশীয় খেলোয়াড়রা নিজেদের খেলা ভুলে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে আন্তর্জাতিক রেফারিদের আঙ্গুলের দিকে।

এই বাস্তবতায়ই সম্প্রতি সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বিদেশি মুরুব্বিদের প্রতি ইঙ্গিত করে নিজের লুক্কায়িত ক্ষোভকে প্রকাশ করে দিলেন হাজারো মানুষের সামনে, 'যদি সম্ভব হতো, মুখ চেপে ধরতাম।' গত ১০ মে গাজীপুরে সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এভাবেই নিজের মনোভাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'আমরা যখন দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে, আমরা কিন্তু তাদের মুখ চেপে ধরতে পারছি না৷ যদি সম্ভব হতো, মুখ চেপে ধরতাম, কিন্তু মুখ চেপে ধরতে পারব না, পৃথিবীটা এখন উন্মুক্ত৷'

সিইসির হতাশার কারণটা অত্যন্ত পরিষ্কার। সম্প্রতি 'উন্মুক্ত পৃথিবী'র মুক্ত মানুষরা আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অবস্থা অনুযায়ী তারা তাদের নাক গলাতে এবং আমাদের নাক ধরে টানার সুযোগও হাতছাড়া করছে না। ধারণা করা যেতে পারে, এ নিয়ে কমিশনের ওপর চাপও রয়েছে। তাইতো সিইসি তাদের মুখ চেপে ধরার অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষাকে জনসমক্ষে প্রকাশ না করে থাকতে পারলেন না।

কিন্তু তিনি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন, বাইরের মানুষকে নিজেদের বিষয়ে নাক গলানোর এই সুযোগটাও আমরাই করে দিয়েছি। নিকট অতীতে যে কয়টা নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন হতো, তাহলে আজকে আর বাইরের আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। বিদেশিদের মুখ চেপে ধরার বক্তব্য রাখার সময় এই চিন্তাগুলো তার মাথায় কাজ করলে, বক্তব্যটা হয়তো অন্যরকম হতো।

এদিকে, তিনি যেদিন গাজীপুরে বক্তব্য রাখেন, সেদিনই দেখলাম ঢাকায় ইইউ জোটের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি রাজধানীর এক হোটেলে 'ইউরোপ ডে' উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে। চার্লস হোয়াইটলির এই ঘোষণায় সরকার ও বিরোধী শিবিরের অনেকেই বেশ উৎফুল্ল হয়েছেন বলেই মনে হয়।

কিন্তু এই 'অংশগ্রহণমূলক' বলতে কী বোঝায় বা কী বোঝানো উচিত, একবারও তারা ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। কারণ, রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেই কোনো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয় না। নির্বাচনে জনগণ যখন স্বাচ্ছন্দ্যে, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তখনই তা হয়ে ওঠে প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক। অন্যথায় তা প্রহসনে পর্যবসিত হতে বাধ্য।

আর, যতই বিদেশি পর্যবেক্ষক দেশে আসুক না কেন, তাদের পক্ষে দেশের প্রায় অর্ধলক্ষ নির্বাচনী কেন্দ্রের অবস্থা জানা সম্ভব নয়। তারপরও নির্বাচন এলেই আমাদের দেশে বিদেশি পর্যবেক্ষকের ইস্যুটি আলোচনায় এসে যায়। অথচ যেখানে গণতন্ত্র আছে, সেখানে বিদেশি পর্যবেক্ষকের কোনো দরকারই পড়ে না। জনগণ তথা ভোটাররাই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী পর্যবেক্ষক। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের অনেক কিছুই যেহেতু বিদেশিদের প্রত্যয়নের ওপর নির্ভরশীল, তাই তারা সুযোগ পেলেই আমাদের এটা-ওটা নিয়ে নাক গলায়।

সিইসি সাহেবের ওখানটাতেই যত কষ্ট। তিনি তাদের মুখ চেপে ধরতে চান, কিন্তু পারেন না। যেমন পারে না এ দেশে কোটি মানুষ তাদের কষ্টগুলোর প্রকাশ ঘটাতে। আশা করি সিইসি সাহেব নিজের অক্ষমতা থেকে এ দেশের লাখো কোটি মানুষের ব্যর্থ ক্ষোভটুকুকে বুঝতে পারবেন।

তবে সিইসি সাহেব তার গাজীপুর বক্তৃতায় একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আমাদের ইঙ্গিত করেছেন। তিনি নির্বাচনে কালো টাকা ব্যবহারের বিষয়টিকে একটি 'কালো সংস্কৃতি' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, 'আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় এখনো অনেক কালো সংস্কৃতি রয়ে গেছে। এই কালো সংস্কৃতি থেকে আমাদের ধীরে ধীরে উঠে আসতে হবে।'

কথায় বলে, কোনো সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারা মানেই সমস্যার অর্ধেক সমাধান। দেখা যাক, সিইসি সাহেবের এই উপলব্ধি সত্যি, নাকি শুধুই কথার কথা! তিনি যা বলেছেন, যদি সত্যিই তা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে জাতি তার কাছ থেকে অনেক কিছু পেতে পারে। না হলে, অতীতের অনেক সিইসির মতোই তিনিও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। আমরা নিশ্চয়ই ভালোটাই আশা করবো।

এদিকে সিইসির গাজীপুর সভার আগের দিন নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা খুলনায় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এক মতবিনিময়  সভায় বলেছেন, 'পরীক্ষামূলক হলেও আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা উচিত।' তিনি বলেছেন, কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন চায়। এ জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হবে।

প্রশ্ন হলো, নির্বাচন তো আর কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার বিষয় নয় যে পরীক্ষাগারে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে! স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও যদি 'পরীক্ষামূলক' নির্বাচনই করতে হয়, তাহলে আর স্বাধীন হলাম কেন? দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে দেশে ভৌত কাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে প্রচুর। আকাশে স্যাটেলাইট, ঢাকার রাস্তায় মাথার উপরে ফ্লাইওভার, প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু, এমন আরও কত কী! তাহলে সরকারই নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে একটা 'পরীক্ষামূলক' নির্বাচন দিচ্ছে না কেন?

এই দীর্ঘ সময়ে নানাবিধ পন্থায় সরকারই বরং সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তাহলে পরীক্ষামূলক নির্বাচন দিতে সরকারের এত ভয় কেন? আর, কমিশনার মহোদয় যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণের কথা বলছেন, তা-ই বা কীভাবে সম্ভব? গত ৬ মাস ধরেই সরকার সভা-সমিতির মাধ্যমে নৌকায় ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছে, আর বিরোধী দল ভোট চাওয়া তো দূরের কথা, একটা সভাও করতে পারছে না। এই বাস্তবতায় নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে, ফিল্ড লেভেল করলেই কী, আর না করলেই কী! কারণ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভোটের ৬-৭ মাস আগে থেকেই নির্বাচনের বাতাস বইতে শুরু করে। তাই ফিল্ডকে যদি সমান করতে হয়, তাহলে এখন থেকেই কমিশনকে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। না হয়, ম্যাচের দিনে লাফালাফি করে কোনো লাভ হবে না।

মনে রাখতে হবে, নির্বাচন হলো একটা টুর্নামেন্টের মতো, যা শুরুর নির্দিষ্ট সময় আগে থেকেই সব দলকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির সুযোগ দিতে হয়। সেটিই যদি নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে ইইউ কেন, খোদ জাতিসংঘ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠালেও কোনো কাজ হবে না। নির্বাচন কমিশন কি পারবে সময়ের এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে? যদি পারে, তাহলে দেশ এক মহা রাজনৈতিক সংকট থেকে রক্ষা পাবে। আর তা না হলে আগামীর ইতিহাস এই কমিশনকে কখনো ক্ষমা করবে না। অতীতের আরও কমিশনের মতো এর নামও লেখা হবে অশ্রদ্ধার আখরে।

মোশতাক আহমেদ, সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

2h ago