বিজয় দিবসে ‘পরাজয়ের’ বার্তা দিলেন পুতিন?

মস্কোয় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ৯ মে ২০২৩। ছবি: রয়টার্স

স্পেনের সংবাদমাধ্যম 'এল পাইস'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'এই মুহূর্তে সংঘাত বন্ধে শান্তি আলোচনা সম্ভব না।'

গতকাল মঙ্গলবার গুতেরেস যখন এই মন্তব্য করছেন তখন মস্কোয় চলছিল 'বিজয় উৎসব'।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়কে প্রতিবছর ঘটা করে স্মরণ করতে ৯ মে রাশিয়ায় বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়। তবে এবার এতে 'ছন্দ পতন' দেখা গেল। কারণ বিজয় দিবস উদযাপনে আয়োজনের সেই জমকালো ভাব ছিল অনেকটাই অনুপস্থিত।

পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি যে কিছুটা দুর্বল হয়েছে তা কারোই অস্বীকার করার উপায় নেই। এর প্রভাব ইউক্রেনের রণক্ষেত্রেও পড়েছে।

মস্কোর রেড স্কয়ারে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ। ছবি: এএফপি

গত কয়েকদিন ধরে ইউক্রেনে রুশ হামলার দাপট বাড়লেও রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে ইউক্রেনের হামলা মস্কোর 'অসহায়ত্ব'কেই ফুটিয়ে তুলেছে। রুশ প্রেসিডেন্টের বিজয় দিবসের ভাষণেও এর প্রতিফলন দেখা যায়।

প্রশ্ন জাগে- সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে এবারের বিজয় দিবস কি পুতিনের পরাজয়ের কোনো বার্তা নিয়ে এলো? বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক…

'দনবাসের বাসিন্দাদের রক্ষা করবো'

গতকাল রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরটি জানায়, নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের ৭৮তম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে মস্কোর রেড স্কয়ারে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, পশ্চিমের মোড়লরা নাৎসি বাহিনীর 'অলীক উচ্চাকাঙ্ক্ষা'র পরিণতির কথা ভুলে গেছেন।

তার মতে, কোনো মতবাদের একক আধিপত্য 'জঘন্য, অপরাধ ও ভয়ঙ্কর'।

'বিশ্ব মোড়লরা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে চাপ দেয়। তারা এক দল মানুষকে আরেক দলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তারা রক্তক্ষয়ী সংঘাত ডেকে আনে ও অভ্যুত্থান ঘটায়। তারা ঘৃণা, রুশভীতি ও আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে। তারা মানুষের পারিবারিক ঐতিহ্য ধ্বংস করে।'

সন্দেহ নেই, প্রেসিডেন্ট পুতিনের এসব কথা যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের উদ্দেশে বলা। তাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে 'লুট, সন্ত্রাস ও দমনপীড়ণের নীতি' চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

পুতিনের এমন বক্তব্যের সঙ্গে পশ্চিমবিরোধীরা একমত হবেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ টেনে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, 'আমাদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ করবো। আমরা দনবাসের বাসিন্দাদের রক্ষা করবো। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।'

রেড স্কয়ারে অতিথির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

তিনি মনে করেন, ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের জনগণ অভ্যুত্থানের 'বেড়াজালে' আটকা পড়ে আছে। তারা পশ্চিমের হাতের 'পুতুলে' পরিণত হয়েছে।

একই দিনে অপর রুশ সংবাদ সংস্থা তাস জানিয়েছে, এ বছর রাশিয়ার বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে রেড স্কয়ারে ৮ হাজারের বেশি সেনা অংশ নেন। তাদের মধ্যে ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযানে' যোগ দেওয়া ৫৩০ যোদ্ধা ছিলেন। এছাড়াও, সেখানে ১০০টির বেশি সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শন করা হয়।

এ বছরের বিজয় দিবসে 'আকাশ কুচকাওয়াজের' আয়োজন ছিল না। গত বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা বাতিল করা হয়েছিল। এ বছর কেন বাতিল করা হয়েছে তা তাসের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়নি।

একই দিনে দ্য মস্কো টাইমস জানায়, বিজয় দিবসে নিজের শক্তিমত্তা দেখাতে প্রতিবছর ক্রেমলিন যে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ বছর এতে 'ভাটা' পড়তে দেখা গেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু যে রেড স্কয়ারে জৌলুশ কম ছিল তা নয়, এবার রাশিয়ার ২০টি শহরে সামরিক কুচকাওয়াজ বাতিল করা হয়েছে। এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণ যে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় তাও এবার হয়নি।

এসব না হওয়ার কারণ সংবাদমাধ্যমটিতে বলা হয়নি। ধারণা করে নেওয়া যেতে পারে যে, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের মিত্রদের দেওয়ার নিষেধাজ্ঞার কারণে মস্কো খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই।

ফাঁকা বুলি?

রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিজয় দিবসের ভাষণে ইউক্রেন অভিযানকে ঘিরে কোনো 'বিজয় বার্তা' পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশী ইউক্রেনকে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাত থেকে 'মুক্ত' করার প্রত্যয় জানিয়ে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পরাশক্তি রাশিয়া যে যুদ্ধ শুরু করে তা ১ বছরের বেশি সময় পরও ক্রেমলিনের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনতে পারেনি।

সেসময় রুশ প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেছিলেন যে অল্প দিনের মধ্যে ইউক্রেন তার অধীনে আসবে। বাস্তবতা হলো—রুশ বাহিনী ইউক্রেন থেকে পিছু হটে পূর্ব ইউক্রেনের রুশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয় আটকে গেছে। সেখানেও তাদের অবস্থান মজবুত নয়।

বিজয় দিবসের ভাষণে প্রেসিডেন্ট পুতিন পশ্চিমের দেশগুলোর বিরুদ্ধে তার তীব্র ক্ষোভ-খেদ প্রকাশ করলেও বাস্তবে সেগুলো 'ফাঁকা বুলি'তে পরিণত হয় কিনা তা দেখার বিষয়।

প্রায় ১৪ মাস আগে যে পুতিন পুরো ইউক্রেনকে 'রক্ষার' প্রত্যয় প্রকাশ করে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' শুরু করেছিলেন তিনিই এতদিন পর এসে বলছেন 'আমরা দনবাসের বাসিন্দাদের রক্ষা করবো।' তিনি যেন পুরো ইউক্রেন জয়ের আশা বাদ দিয়ে এখন শুধু পূর্ব ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী দনবাস অঞ্চলকে 'রক্ষার' প্রতিজ্ঞা করছেন।

বিজয় দিবসে আগ্রাসনবিরোধী প্রেরণা

গতকাল সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান পুতিনের 'পতনের পটভূমি' ফুটিয়ে তুলেছে। কারণ, তিনি ইউক্রেন আগ্রাসনকে 'ন্যায়ের জন্য যুদ্ধের ধারাবাহিকতা' বলে মনে করেন।

এতে আরও বলা হয়, ইউক্রেনে রক্তক্ষয়ী ও অন্যায় যুদ্ধে পুতিনের ব্যর্থতা ইউক্রেনসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর বাসিন্দাদের মনে আগ্রাসনবিরোধী প্রেরণা জোগাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয়ের বার্ষিকীর এই দিনে সেই প্রেরণা নতুন করে জেগে উঠবে।

পুতিন পশ্চিমের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে নিজেই যখন প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসন চালান তখন তিনি তার কথার মারপ্যাঁচে পড়ে নিজের বিপদকে আরও ঘনীভূত করছেন বলে মনে করছেন অনেকেই।

সামরিক কুচকাওয়াজে দর্শক। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো ম্যাক্সিমিলিয়ান হিস আল জাজিরার মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেন, 'ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে এবং রুশদের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুতিন তার পতনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন।'

বিশ্লেষক হিস আশা করেন, রাশিয়ার আগামী বিজয় দিবসে একই সঙ্গে নাৎসি জার্মানি ও পুতিনের রাশিয়ার পরাজয় উদযাপন করা হবে।

'অস্বস্তিকর পরিবেশে বিজয় দিবস'

রাশিয়ার বিজয় দিবসকে নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, 'পুতিন শক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু মস্কোর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে তার বিচ্ছিন্নতাই প্রকাশ পেল'।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির শিরোনাম ছিল, 'অস্বস্তিকর পরিবেশে বিজয় দিবস অনুষ্ঠিত হচ্ছে।'

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজয় দিবসের আগের রাতে রাশিয়া ইউক্রেনজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালেও গত কয়েকদিন ধরে রাশিয়াকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

গত সপ্তাহে রাশিয়ার বিমান বাহিনী ক্রেমলিনের ওপর ২টি ড্রোন ধ্বংস করে। কয়েকদিন আগে ক্রিমিয়ায় একটি তেলের ডিপোতে হামলা চালানো হয়েছে। এছাড়াও, ইউক্রেন সীমান্তবর্তী রাশিয়ার ছোট শহর ও গ্রামেও ড্রোন হামলা হয়েছে।

এছাড়াও, গত শনিবার রাশিয়ার পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলীয় নিঝনি নভগরদ প্রদেশে এক গ্রামে গাড়িবোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছেন পুতিনপন্থি লেখক জাখার প্রিলেপিন।

গত মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গের এক কফিশপে বিস্ফোরণে নিহত হন রুশ মিলিটারি ব্লগার ভ্লাদলেন তাতারস্কি।

চলতি সপ্তাহেই পুতিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভাগনার গ্রুপের দ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে আসে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে কৌশলগত শহর বাখমুতের দখল নিয়েও রাশিয়ার দাবি স্পষ্ট নয়।

এসবই রাশিয়ার জন্য চরম অস্বস্তিকর।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা যেতে পারে যে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর থেকে সবদিক থেকেই রাশিয়ার ক্ষয় শুরু হয়েছে। কোনো স্বাধীন দেশ অপর দেশে আগ্রাসন চালালে তার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। ইতিহাস বারবার তাই-ই বলে।

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

8h ago