২৩ মার্চ ১৯৭১: যেভাবে পাকিস্তান দিবস হয়ে উঠল প্রতিরোধ দিবস
২৩ মার্চ প্রতি বছর পালিত হতো পাকিস্তান দিবস হিসেবে। এদিন ভোরে দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো, আয়োজিত হো কুচকাওয়াজ, সভা সমাবেশ ও নানা অনুষ্ঠান। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন সেবারের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হিসেবে নয়, পালিত হবে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।
প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে এদিন ভোর ৬টায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র-জনতা প্রভাতফেরি বের করে। প্রভাতফেরিটি আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ভাষা শহীদদের কবর, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের কবর জিয়ারত করে। এ সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।
ভোরে রাজধানীর সচিবালয়, হাইকোর্ট, সব সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকাও উত্তোলন করা হয়। একমাত্র প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস, ক্যান্টনমেন্ট ও তেজগাঁও বিমানবন্দরেই কড়া নিরাপত্তার মাঝে এদিন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকাল ৯টায় আউটার স্টেডিয়ামে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ এবং যুদ্ধের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ঢাকা পরিণত হয় পতাকার নগরীতে।
ভোর থেকেই ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, চাকরিজীবী, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনতার একের পর এক মিছিল বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বাড়ির সামনে জড়ো হতে থাকে। মিছিলে শামিল হওয়া সর্বস্তরের জনতার হাতে হাতে ছিল বাঁশ, লাঠিসহ নানা দেশীয় অস্ত্র। জনতার কণ্ঠে ছিল সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান এবং জয় বাংলা স্লোগান।
সকালে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। একইসঙ্গে উড়ানো হয় কালো পতাকাও। এ সময় সমবেত কণ্ঠে 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটি পরিবেশিত হয়। পতাকা উত্তোলন শেষে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় পতাকার প্রতি সালাম জানায়। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত সর্বস্তরের জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বাংলার দাবির প্রশ্নে কোনো আপস নাই। বহু রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজনবোধে আরও রক্ত দেবো, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবই। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করে রাখা যাবে না। আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলবে। এই সংগ্রামের পন্থা কী হবে তা আমিই ঠিক করে দেবো, সে ভার আমার উপরই ছেড়ে দিন। শাসক-কায়েমি স্বার্থবাদীদের কীভাবে পর্যদুস্ত করতে হয় আমি জানি। অতুলনীয় ঐক্য, নজিরবিহীন সংগ্রামী চেতনা আর প্রশংসনীয় শৃঙ্খলা বোধের পরিচয় দিয়া বাংলার মানুষ প্রমাণ করেছে, শক্তির জোরে তাদের আর দাবাইয়া রাখা যাবে না। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, যতদিন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হবে, যতদিন একজন বাঙালি বেঁচে থাকবে, এই সংগ্রাম আমাদের চলবে। মনে রাখবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহশালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালিয়ে যান, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপরই ছেড়ে দিন।'
এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ২ জনের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে দুপুর ১২টা ও সন্ধ্যা ৬টায় মোট ৩ ঘণ্টা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ও কামাল হোসেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা এম এম ইয়াকুব খান, পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান এম এম আহমদ।
২৩ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় 'আজ প্রতিরোধ দিবস' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আজ ২৩শে মার্চ বাংলাদেশে প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও অন্যান্য সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন নামে এই দিবসের পৃথক কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন।'
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় 'আজ ২৩শে মার্চ' শীর্ষক শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'আজ (মঙ্গলবার) ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাব দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিন ছুটি ঘোষণা করিয়াছেন। স্বাধীন বাংলা দেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক লীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এই দিবসটি ''প্রতিরোধ দিবস'' হিসাবে পালন করার আহ্বান জানাইয়াছেন।' প্রতিবেদনে এদিনের বিস্তারিত কর্মসূচিও তুলে ধরা হয়েছিল।
২৩ মার্চ ঢাকা টেলিভিশনে পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান থাকলেও ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা পাকিস্তান দিবসের কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেননি। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের বদলে এদিন প্রচারিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার বদলে পর্দায় ভেসে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
আগেই পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছিল, যদি পাকিস্তানের পতাকা টেলিভিশনে প্রদর্শন না করা হয় তবে বাঙালি কর্মীদের টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হবে। কিন্তু পিছু হটেননি ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা। টেলিভিশনে এদিন সম্প্রচারিত হয় কবিতার অনুষ্ঠান। সম্প্রচারিত হয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে রচিত আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটক 'আবার আসিব ফিরে'।
২৪ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল 'আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ'। মাভৈঃ অর্থ ভয় করো না। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিক্ষুব্ধ বাংলার বুকে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে আঘাতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের স্মারক দিবস ২৩শে মার্চ গতকাল (মঙ্গলবার) চিরাচরিত আনুষ্ঠানিকতায় আর পালিত হয় নাই। বাংলার মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের রক্তঝরা পটভূমিকায় ''স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'' ও স্বাধীন বাংলা দেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ডাকে গতকালের দিনটি বাংলা দেশব্যাপী ''প্রতিরোধ দিবস'' হিসাবে পালিত হইয়াছে। …বাংলা দেশের রাজধানী ঢাকায় সরকারী-বেসরকারী ভবনসমূহে, বাড়ী-ঘরে, যানবাহনে কালো পতাকার পাশাপাশি গতকাল সংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়। সকাল হইতে রাত পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বীর বাঙালীর অগণিত মিছিল শুধু কামনা-বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করিয়া গিয়াছে। অবিশ্রান্ত জলধারার মতো মিছিলে মিছিলে সভা সমিতিতে জনতার কণ্ঠ যেন কেবলি বলিতে চাহিয়াছেঃ
শুকনো গাঙ্গে আসুক
জীবনের বন্যা উদ্দাম কৌতুক
ভাঙ্গনের জয়গান গাও
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক
আমরা শুনেছি ঐ
মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ'
২৪ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আগের দিন বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে 'কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপর ছাড়িয়া দিন' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিক্ষুব্ধ বাংলার দশদিগন্তে সর্বাত্মক মুক্তি আন্দোলনের পটভূমিতে নয়া-আঙ্গিকে আবির্ভূত তেইশে মার্চের অবিস্মরণীয় দিনে বন্যার স্রোতের মত স্বীয় বাসভবনে সমাগত জনতার উদ্দেশে ভাষণদানকালে স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় বলেন, ''এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, যতদিন সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হইবে যতদিন একজন বাঙ্গালী বাঁচিয়া থাকিবে, এই সংগ্রাম আমাদের চলিবেই চলিবে। কাক-ডাকা ভোর হইতে রাজপথ-জনপদ প্লাবিত করিয়া শহর ও শহরতলির বিভিন্ন দিক হইতে অজস্র জনতার স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। মিছিলের পর মিছিল। সকাল হইতে ১০ ঘণ্টা সময়ে ৬টি মহিলা-মিছিলসহ অন্ততঃ ৫৫টি ছোট-বড় মিছিল গতকাল শেখ সাহেবের বাসভবনে আগমন করিয়া ''মহান জাতির মহান নেতার'' প্রতি অকুণ্ঠ আস্থার পুনরাবৃত্তি এবং সংগ্রামের দুর্জয় শপথের স্বাক্ষর রাখিয়া যায়। …. তেইশ বছর ধরিয়া বাংলার দশ দিগন্তে যে পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়াছে, যে পাকিস্তান দিবস পালিত হইয়াছে, যেভাবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় সভা-সমিতি হইয়াছে আর সেইসব অনুষ্ঠানে রাজপথে-জনপদের অধিকার বঞ্চিত গণমানুষ ক্ষ্যাপা পাগলের মত ''পাকিস্তান আর স্বাধীনতা'' খুঁজিয়া বেড়াইয়াছে, গতকালকের দিনটি তার অবসান সূচনা করিয়া জনতাকে নবসূর্যের নয়ালোকে নয়া পতাকার দিক নির্দেশে প্রাণের টানে টানিয়া দিয়াছে জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। আর বাম হাতে বাংলা দেশের পতাকা ঊর্ধ্বে বাড়াইয়া দিয়া বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার স্পন্দনকে একত্রে জড়ো করিয়া গজিয়া উঠিয়াছেন, বাংলার মানুষ কাহারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তাঁরা মুক্তি ছিনাইয়া আনিবে। জয় বাংলা— বাংলার জয় অনিবার্য।'
২৪ মার্চ কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় 'পাকিস্থান দিবস নয় — প্রতিরোধ দিবস' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের একাংশে বেনাপোল সীমান্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানোর বর্ণনাও দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'নয় চৈত্র। সকাল সাড়ে দশটা। ভারত সীমান্তের পেট্রাপোলের ওপারে পূর্ব বাংলার সীমান্ত বেনাপোল। এসেছে তরুণ-তরুণী, সংখ্যায় তারা শতাধিক হবে লরী করে এসে বেনাপোল নামল। একসঙ্গে জমায়েত হল। তারপর একদম সীমান্তে যেখানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়ছে ঠিক তার পাশে একটি স্ট্যান্ড নির্মাণ করে কয়েকশ কণ্ঠের জয়ধ্বনির মধ্যে জীবনমরণ সংগ্রামের শপথের মধ্যে জয় বাঙলা পতাকা উড়াল। এই প্রথম সীমান্তে জয় বাঙলা পতাকা উড়ল। …পাশেই কালো পতাকা উড়ছে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের কাস্টমস অফিসে।'
তথ্যসূত্র:
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ ও ২৪ মার্চ ১৯৭১
দৈনিক পূর্বদেশ ২৩ ও ২৪ মার্চ ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর ২৪ মার্চ ১৯৭১
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments