কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ি ও তপন রায়চৌধুরীর শৈশবনামা

তপন রায়চৌধুরী ও বর্তমান কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

'বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষি ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, ক দেহি, মহারানি ভিক্টোরিয়া এহন কী করতে আছে? উত্তর, হে কি আর আমাগো মতো? পানি নাবতেই পান্তাভাত খাইয়া কাঁথামুড়ি দিয়া উব্বুত।'

'রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা' বইয়ে স্বাদু গদ্যে গ্রাম্য দুই কৃষকের কথোপকথনকে সরসভাবে তুলে এনেছিলেন তিনি। নিজের পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নির্দ্বিধায় জবাব দিতেন 'মোর বাড়ি বরিশাল। মুই বরিশাইল্লা তপইন্যা'।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন তপন রায়চৌধুরী। প্রচলিত আছে, ইতিহাস আর অর্থনীতির অধ্যাপকরা কাঠখোট্টা ও রাশভারী হন। কিন্তু অর্থনীতি ও ইতিহাসে ডাবল ডক্টরেট ডিগ্রিধারী তপন রায়চৌধুরী ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। হিউমারকে তিনি জড়িয়েছেন জীবনের সঙ্গে। হিউমার যে কতভাবে করা যায় তা জানতেন তিনি। হাসতে পারতেন, হাসাতে পারতেন।

আত্মস্মৃতি 'বাঙালনামা'‌ ও 'রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা' গ্রন্থে তপন রায়চৌধুরী তুলে ধরেছেন তার পূর্ববঙ্গের প্রাথমিক জীবনকে।

`বাঙালনামা'তে উঠে এসেছে তার প্রাথমিক জীবনের গল্প। জন্ম কুমিল্লা হলেও তপন রায়চৌধুরীর শৈশব ও কৈশোরের পুরোটা সময় কেটেছিল বরিশাল শহর আর ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা গ্রামে। তিনি ছিলেন কীর্ত্তিপাশার জমিদার পরিবারের সন্তান। দেশভাগের পর তারা চলে যান কলকাতায়। সেই সূত্রে তার আত্মিক টান ছিল পূর্ববঙ্গ ও বরিশালের প্রতি। নিজের শৈশবকে মোহনীয় আর সুস্বাদু গদ্যের মাধ্যমে তপন রায় চৌধুরী তুলে ধরেছিলেন। 'রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা'তে তপন রায়চৌধুরী তুলে ধরেছেন বরিশাল অঞ্চলের আঞ্চলিক কৌতুক, ছোটবেলার স্মৃতি, বরিশাল অঞ্চলের ভাষার উচ্চারণ নিয়ে ঠাট্টা, নানা চরিত্রসহ অজস্র বিষয়। বাদ যায়নি দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে দেশভাগ। 

'বাঙালনামায়' তপন রায় চৌধুরী কীর্ত্তিপাশা নিয়ে লিখেছিলেন, 'যদিও আমরা বরিশালের বাংলো বাড়িতেই বছরের দশ-এগারো মাস থাকতাম, জ্ঞান হওয়া অবধি জানতাম যে, আমাদের সত্যিকার বাড়ি কীর্ত্তিপাশা গ্রামে বড় হিস্যার জমিদারবাড়ি— যেখানে আমরা সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর। বরিশালের বাড়িটি বাসা মাত্র, নিতান্তই ক্ষণকালের আস্তানা।'

বরিশাল থেকে কীর্ত্তিপাশা যাওয়ার অপরূপ বর্ণনা দিয়েছিলেন তপন রায়চৌধুরী। লিখেছিলেন, `আমরা জলপথে কীর্ত্তিপাশা যেতাম। খুব ছোটবেলায় আমাদের ছয়-দাঁড়ের গ্রিনবোট বা বজরা করে যেতাম। পরে ভাড়া করা কোশ নৌকায়। বরিশাল থেকে কীর্ত্তিপাশা ষোল মাইল। গ্রিন বোটে ঐ পথ যেতে প্রায় পুরো একদিন লাগত, আর দুই দাঁড়ের কোশ নৌকায় আট-দশ ঘণ্টা। কিন্তু ঐ নৌকাযাত্রাটাই আমাদের এক মহা উৎসব ছিল। নদীর পাড়ে মাঝে মাঝে ক্ষিরাই আর মর্মার ক্ষেত। নৌকা থামিয়ে ক্ষেতের মালিককে সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে আমড়া যথেচ্ছ খেতাম। আর জেলেরা মাঝে মাঝে ইলিশ মাছের জাল তুলত। জালের কাল সুতোর আড়ালে রৌদ্রে উজ্জ্বল রূপার ঝকমকি। ইলিশ মাছ জলের বাইরে দু-এক সেকেন্ড মাত্র বাঁচে। সেই সদ্য ধরা ইলিশ মাছ জেলেদের কাছ থেকে কিনে ভেজে খাওয়া হত। ও বস্তু পেলে দেবতারা তুচ্ছ অমৃত খেতে যেতেন না— এই বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। নদীর ছেড়ে খাল বেয়ে বড় হিস্যার বাড়ির ঘাটে পৌঁছাতাম। সেখানে পৌঁছানো মাত্র আইয়্যা গেছে, আইয়্যা গ্যাছে বলে একটা ধ্বনি উঠত।'

'বাঙালনামা'য় পাওয়া যায় কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ির পূজার উৎসবের বর্ণনাও।

`বড় হিস্যার বাড়িতে পূজার সময়টা সকলেরই মহা আনন্দের দিন। বহু দূরের সব গ্রাম থেকে শয়ে শয়ে বড় হিস্যার বাড়ির পূজা দেখতে আসত। দুর্গাদালানের সামনে হাঁড়িকাঠে পাঁঠাবলি হত। একটা গভীর ভয়মিশ্রিত আকর্ষণবোধ নিয়ে দৃশ্যটা দেখতাম। বলির সময়ে চারদিকে ঢাক আর মন্দিরার শব্দে কানে তালা ধরত। তার সঙ্গে ভক্তদের মা, মা ধ্বনি। সন্ধ্যায় আরতি। গ্রামের কেউ কেউ আরতিনৃত্যে বিশেষ পটু ছিলে। কালুয়া ধুমায়মান ধুনুচি মুখে বা মাথায় নিয়ে ঢাকের বাজনার তালে তালে ভারী সুন্দর নাচত। পূজার কদিন বাড়ির মেয়েরা স্নান করে চওড়া লালপেড়ে শাড়ি পরে প্রতিমা বরণ করতেন। বিসর্জনের আগে বরণের সময় মেয়েদের অনেকের চোখেই জল। রাত্রে সবাই নৌকা করে বিসর্জন দেখতে যাওয়া হত।'

কীর্ত্তিপাশা ছেড়ে বরিশাল যাওয়ার বর্ণনা, বরিশাল ছেড়ে কীর্ত্তিপাশায় যাওয়ার বর্ণনা তপন রায়চৌধুরী দিয়েছিলেন এভাবে-

`কয়েক সপ্তাহ গ্রামবাসের পর আবার ঐ বাড়ির পাশের খাল থেকে কোশ নৌকা করে শহরে ফিরতাম। গ্রামের আত্মীয়বন্ধুদের ফেলে আসতে বড় কষ্ট হত। তারাও সব ম্লানমুখে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সুহৃদ-বিরহ অসহ্য হলে হঠাৎ সাইকেল নিয়ে কীর্ত্তিপাশা চলে যেতাম। কখনও বাড়িতে বলে, কখনও না বলে। কীর্ত্তিপাশা থেকে প্রত্যাশিত তারবার্তা আসত sriman arrived safely। যখন বয়স বছর দশেক, তখন কীর্ত্তিপাশা যাওয়ার এক সঙ্গী জুটল— অক্সফোর্ড মিশনের ব্রাদার কেটলি। সকাল সাড়ে আটটা-নটায় রওনা হয়ে দুপুরের আগেই পৌঁছে যেতাম।'

`বাঙালনামা'য় কতবার যে তপন রায় চৌধুরী কীর্ত্তিপাশার স্মৃতি বর্ণনা করেছেন তা বলে শেষ করার নয়। নিজেকে তিনি বরাবরই পরিচয় দিতেন 'কাঠবাঙাল' বলে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পুরোপুরিভাবে কলকাতায় পাড়ি জমান।

'বাঙালনামা'য় লিখেছিলেন, 'কার্শিয়াং থেকে কলকাতা ফিরে আরও এক দুঃসংবাদ পেলাম। স্থির হয়েছে আপাতত আমরা কলকাতায়ই থেকে যাব। ছেলেদের লেখাপড়ার সুবিধা হবে বলে বাবা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বুক ভেঙ্গে যাওয়া কথাটার অর্থ কী, আমরা দু'ভাই এবার ভালই বুঝলাম।'

পরে আর স্থায়ীভাবে ফিরে আসেননি তপন রায়চৌধুরী। তবে পূর্ব বাংলার টানে বারবার কীর্ত্তিপাশায় এসেছিলেন তিনি। মৃত্যুর ২ বছর আগে ২০১২ সালে কীর্ত্তিপাশা ঘুরে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ।

কথিত আছে, কীর্ত্তিপাশা গ্রামের নাম এসেছে রাজা কীর্ত্তি নারায়ণের নামানুসারে। তপন রায়চৌধুরীর পূর্বপুরুষ কৃষ্ণকুমার সেন আঠারো শতকের কোনো এক সময় রায়কাঠির রাজার কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে কীর্ত্তিপাশা গ্রামে তালুক পেয়েছিলেন। নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজারাম সেন ও কনিষ্ঠ পুত্র কাশীরাম সেনের নামে তালুক কিনেছিলেন কৃষ্ণকুমার সেন। রাজারাম পেয়েছিলেন সম্পত্তির দশ আনা। আর কাশীরাম পেয়েছিলেন ছয় আনা। সেই থেকে দুজন গড়ে তুলেছিলেন দুটি দালান। একটি পরিচিত বড় হিস্যার বাড়ি, অন্যটি ছোট হিস্যার।'

'রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা' বইয়ে তপন রায়চৌধুরী সরসভাবে তুলে ধরেছিলেন তাদের মধ্যে ঝগড়ার আখ্যানও। লিখেছিলেন, 'দুই হিস্যায় মামলা-মোকদ্দমা লাঠালাঠি নিয়ে ঝগড়াটা জমে উঠলে বার্লিন শহরের মতো মাঝখানে দেওয়াল তুলে এক বাড়ি দুই বাড়িতে পরিণত হয়।'

কয়েক মাস আগে ঘুরতে গিয়েছিলাম ঐতিহাসিক সেই কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়িতে। তপন রায়চৌধুরীর অপরূপ বর্ণনার সেই বাড়িটির চিত্র বর্তমানে একবারেই ভিন্ন। অযত্ন আর অবহেলায় কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ির পুরোটাই আজ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে কিছুটা ভালোভাবে টিকে আছে বাড়ির দুটি অংশ। বাড়ির একটি অংশে করা হয়েছে প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অন্যদিকে নাট্যমঞ্চ ও হলরুমে বর্তমানে চলছে কমলিকান্দর নবীন চন্দ্র বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান।

কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ির বেশিরভাগ অংশ পরিচর্যার অভাবে আগাছা ও লতাপাতায় পূর্ণ। ছবি: সংগৃহীত

জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথমভাগে এই বাড়ির জমিদারপুত্রকে শরবতে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যান জমিদারের পুত্রবধূও। পরে তাদের একসঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, স্থাপন করা হয়েছিল একটি মন্দিরও।

তপন রায়চৌধুরী সেই হত্যা ও সহমরণ নিয়ে 'রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা'তে লিখেছিলেন, 'দেওয়ান আর গুরু সড় করে সরবতে বিষ মিশিয়ে রাজকুমার সেনের প্রাণনাশ করেন। গুরু আর দেওয়ানদত্ত বিষ খেয়ে রাজকুমার বাবু ত' স্বর্গে গেলেন। এখন তাঁর সহধর্মিণী অনুমৃতা হবেন বলে জিদ ধরলেন। শোনা যায় রাজকুমার-পত্নীকে নিরস্ত্র করার চেষ্টায় তরুণ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং কীর্ত্তিপাশা আসেন। যথাকালে টকটকে লাল বেনারসী , এক গা হীরে-জহরতের গয়না, এক কপাল সিঁদুর পরে বিয়ের কনে সেজে চিতায় উঠলেন। লোকে ধন্য ধন্য করল। চিতানলে পবিত্র হয়ে সতীনারী বেহেস্ত গেল। সতীর নামে মন্দির উঠল। তাঁরই পুণ্যে নাকি উত্তরপুরুষরা বেঁচেবর্তে আছি।'

সমাধির ওপর গড়া সেই মন্দির, জমিদার বাড়ির নাটমন্দিরও আজ ধ্বংসের পথে। লতাপাতা আর আগাছায় পরিপূর্ণ বাড়িটির সব ভবন এখন জরাজীর্ণ আর ভগ্নদশায়। কোথাও কোথাও ছাদ ধসে পড়েছে। সিঁড়ি ভেঙে মিশে আছে মাটির সঙ্গে। এছাড়া মূল জমিদার বাড়ি ও দুর্গা মন্দিরটি এখন পরিত্যক্ত হয়ে আগাছায় পূর্ণ। নাট্যশালার চিহ্ন টিকে আছে কোনোমতে।
কীর্ত্তিপাশা জমিদারদের উত্তরাধিকারীরা পরে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়িটি এখনো হতে পারে ঐতিহাসিকদের মিলনস্থল। ঐতিহ্যের ধারক এই বাড়িটিকে ঘিরে ২০০৪ সালে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল কীর্ত্তিপাশা জাদুঘর। কিন্তু তাও বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে অবহেলা আর অনাদরেই পড়ে আছে বাড়িটি।

'বাঙালনামা'র একটি অংশে তপন রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, 'আমি একুশ বছর বয়সে বাস্তুহারা হয়েছি, ৫২ বছর পরে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে, বহু মানুষের অশ্রুজলে গঙ্গাস্নান করে মাতৃভূমিকে ফিরে পেয়েছি, যে মাতৃভূমি কখনো আমার চেতনা থেকে দূরে সরে যায়নি। বাঙালের শ্রমের অন্নে আমার দেহ পুষ্ট, বাঙালের ভাষা আমার ভাষা— আমি বাঙাল না হলে কে বাঙাল?'

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments