তিস্তায় পশ্চিমবঙ্গের ২ খাল খনন: বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ‘মারাত্মক হুমকি’

শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা অববাহিকার চিত্র। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় আরও ২টি খাল খননের যে উদ্যোগ নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগ, তা বাস্তবায়িত হলে সেচের অভাবে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে বলে মন্তব্য করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত।

তার ভাষ্য, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ২ দেশের মধ্যে বর্তমানে যে চলমান দ্বন্দ্ব আছে তার মধ্যে ভারতের এই প্রকল্প অনেকটা আগুনে ঘি দেওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করবে।

আরেক পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হকের অভিমত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন উদ্যোগ আন্তর্জাতিক নিয়মবিরুদ্ধ ও নৈতিকতাবিরুদ্ধ।

আজ শনিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই উদ্যোগ জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলার আরও কৃষি জমি সেচের আওতায় আনতে সহায়তা করবে। তবে পানি নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা বাড়বে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

আইনুন নিশাত ও ম ইনামুল হক। ছবি: সংগৃহীত

এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ- এর  ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিস্তা অববাহিকায় বাংলাদেশ ও ভারতের যে ২টি ব্যারেজ প্রকল্প আছে, সেখানে পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তখন নদীতে কিছুটা পানি আসে, বাংলাদেশও কিছুটা পানি পায়। ভারত তার প্রকল্পের জন্য পুরো পানি প্রত্যাহার করার পরে তলানিটুকু বাংলাদেশ পায়। এখন সেই তলানি থেকে ভারত যদি আরও পানি প্রত্যাহার করে তাহলে বাংলাদেশের আমন মৌসুমে মারাত্মক ক্ষতি হবে। রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট অর্থাৎ তিস্তা প্রকল্পের এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহানন্দা অববাহিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'

তার ভাষ্য, '২ দেশের প্রধানমন্ত্রী যে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন ২০১১ সালে, তাতে বলা হচ্ছে, অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাকে আমি ব্যাখ্যা করছি এভাবে, তিস্তার সারা বছরের পানি যদি যোগ করি তাহলে প্রচুর পানি আছে। বর্ষার পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ছাড়তে হবে। এটা সম্ভব যদি সিকিমে কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ভারত সরকার এই ব্যবস্থাপনা করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ কী করছে সেই দায় কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে মিটমাট হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দিল্লির সঙ্গে কথা বলবে এবং দিল্লি এই ব্যবস্থাপনা করবে।'

'বাংলাদেশেও আমরা তিস্তা প্রজেক্টের ফেইজ-১ এ পানি দিচ্ছি। বাকি ফেইজ, আরও অনেক; বর্তমানে যতটুকু এলাকায় পানি দেওয়া হয় তার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ এলাকায় পানি দেওয়ার প্রস্তাব আমাদের রয়েছে। আমাদের পানির চাহিদা অনেকখানি।'

আইনুন নিশাত মনে করেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। হয়তো শুকনো মৌসুমে পানি আরও কমে যাবে। এ অবস্থাতে উজানের দেশ যদি গায়ের জোরে পানি প্রত্যাহার করা শুরু করে এটা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক হবে। এটা আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিপন্থী, ভারতের নিজস্ব আইনও এটাকে সমর্থন করে না।'

এ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে বাংলাদেশের কী হলো-না হলো তা নিয়ে ভারতের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এটি হলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।'

বিষয়টি নিয়ে পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হকের বক্তব্য হলো, 'পশ্চিম দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদা জেলায় সেচ প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত এবং সেটার কাজ পশ্চিম দিনাজপুরে বেশ কিছু দূর হয়েছে। বাকি কাজগুলো মালদা পর্যন্ত তারা করছে। তিস্তা নদীর পানি তারা যে ডাইভার্সন ক্যানেলের মাধ্যমে সরিয়ে নিয়ে যায়, ওই রুটেই তারা সেচের পানিটা দেয়। ভারত তিস্তার প্রায় সব পানি নিয়ে যাচ্ছে, কোনো পানি রাখছে না। পুরো পানি নিয়ে তারা পশ্চিম দিনাজপুরের অন্য দিকে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে মহানন্দা, ষোলহাট দিয়ে গঙ্গা নদীতে চলে যায়, বিহারে চলে যায়। এই যে খুলে দেওয়া, এ ব্যাপারে অনেক আপত্তি আছে। তারা পানি বিহারে পাঠিয়ে দিচ্ছে, আসলে আমাদের বঞ্চিত করছে। এগুলোকে ঢাকার জন্য তারা সেচ প্রকল্প সম্প্রসারিত করছে।'

তিনি বলেন, 'তিস্তা নদীর পানি আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার। নিম্নতম প্রবাহ অক্ষুণ্ন রেখে তারপর তারা পানি নিয়ে যেতে পারলে তারা নিত। নিম্নতম প্রবাহ যেটা ২০১১ সালের চুক্তির মাধ্যমে আমাদের কাছে আসার কথা ছিল সেটা তো হয়নি। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এটা বোঝাতে হবে যে, নিম্নতম পানিপ্রবাহ রোধ করা আন্তর্জাতিক নিয়মবিরুদ্ধ, নৈতিকতাবিরুদ্ধ এবং ২ দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করার মতো ব্যাপার।'

ইনামুল হকের অভিমত, 'তারা সব পানি নিতে পারে না। আমাদের ন্যূনতম প্রবাহ দিয়ে তারপর তারা নিক।'

আজ টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে জানানো হয়, গ্রীষ্মে তিস্তায় প্রায় ১০০ কিউমেক (কিউবিক মিটার পার সেকেন্ড) পানি পাওয়া যায়। ভারত ও বাংলাদেশের কৃষিজমিতে সেচের জন্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিউমেক পানি প্রয়োজন।

পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতে গতকাল শুক্রবার জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন প্রায় ১ হাজার একর জমি সেচ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। এই জমিতে তিস্তার বাম তীরে খাল খনন করা হবে। জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আরেকটি নদী জলঢাকার পানি প্রবাহের জন্যও খালগুলোকে সংযুক্ত করা হবে।

পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের বরাত দিয়ে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী তিস্তা ও জলঢাকা থেকে পানি তুলতে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করা হবে। একইসঙ্গে তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি খাল খনন করা হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Beximco workers' protest turns violent in Gazipur

Demonstrators set fire to Grameen Fabrics factory, vehicles, vandalise property

1h ago