যে ৬ উপায়ে ইন্টারনেটকে বদলে দেবে এআই চ্যাটবট

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবটকে যে ৬ বিষয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়
ছবি: সংগৃহীত

ওপেনএআই তাদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত করার পর থেকেই ইন্টারনেটে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট কীভাবে আমাদের ওপর প্রভাব রাখবে, সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরবর্তীতে মাইক্রোসফট চ্যাটজিপিটিকে তাদের বিং সার্চ ইঞ্জিনে যুক্ত করে ইন্টারনেটে কোনা কিছু সার্চ করার অভিজ্ঞতাকেই পাল্টে দেয়। 

ইন্টারনেট সার্চে গুগলের যে দীর্ঘদিনের আধিপত্য, সেটিতে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছে মাইক্রোসফটের নতুন এই বিং সার্চ ইঞ্জিন। যদিও মাইক্রোসফটের কিছুদিন পর গুগলও চাপে পড়ে নিজেদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট 'বার্ড' উন্মুক্ত করে, কিন্তু সেটি ততটা আলোড়ন ফেলেনি। 

কথা হচ্ছে এসব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) সমৃদ্ধ সার্চ ইঞ্জিন ইন্টারনেটকে কীভাবে বদলে দেবে? যদিও এখনো কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না, তারপরও কিছু অনুমান তো করাই যায়। ভবিষ্যতে ইন্টারনেটে সার্চ করার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে, তার কিছু অনুমান আমরা এখানে উপস্থাপন করছি-

সরাসরি চ্যাটের মাধ্যমে উত্তর পাবেন ব্যবহারকারীরা

চ্যাটজিপিটি ও বার্ডের মতো প্রযুক্তিগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবহারকারীদের সময় বাঁচানো। এখন যদি গুগলে কোনো কিছু সার্চ করা হয়, তাহলে সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর হাজার হাজার লিংক পাওয়া যায় এবং সেই লিংকগুলোতে গিয়ে উত্তর খুঁজতে হয়। এই পদ্ধতি আসলে খুব কার্যকর নয়। বাস্তব জীবনে আমরা যখন কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি, তখন গভীর ও বিস্তারিত কোনো উত্তর সচরাচর আশা করি না। আমরা ছোট ও সহজে সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে চাই। ভবিষ্যতে ইন্টারনেট সার্চও ঠিক এমন হবে।

কোনো জিজ্ঞাসার জবাবে সার্চ ইঞ্জিন দ্রুত, বোধগম্য ভাষায় ও নির্ভুলভাবে উত্তর দেবে, যাতে প্রশ্নকারীকে হাজার হাজার লিংক থেকে নিজের পছন্দমতো উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় করতে না হয়। এখনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এসব চ্যাটবটের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এগুলো এখনো নিরপেক্ষ ও নির্ভুলভাবে সব উত্তর দিতে পারে না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

সার্চ হবে অনেকটা আলাপচারিতার মতো

আমরা এখন ইন্টারনেটে যখন কিছু সার্চ করি, তখন বাস্তব জীবনে কোনো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মতো সার্চ করি না, বরং আমরা এমন ভাষায় সার্চ করি যাতে ইন্টারনেট সেটি বুঝতে পারে। অর্থাৎ, আমরা কোনো কিছু সার্চ করার সময় নির্দিষ্ট কিছু কি-ওয়ার্ড ধরে সার্চ করি। এ জন্যই 'এই বছর আমাদের কোথায় ছুটি কাটাতে যাওয়া উচিত' সার্চ না করে আমরা 'জনপ্রিয় ১০টি ভ্রমণ গন্তব্য' লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্চ ইঞ্জিনে আমরা স্বাভাবিক জীবনে যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই কথা বলা যাবে বা কিছু খোঁজা যাবে।

ফ্যাক্ট-চেকিং হতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ার

এই সার্চ ইঞ্জিনগুলোর অন্যতম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে ভুল বা ত্রুটিযুক্ত উত্তর। মানুষ যখন আরও বেশি এই ধরনের সার্চ ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করবে, তখন ধীরে ধীরে তারা এসব সার্চ ইঞ্জিনের উত্তরের ওপরই নির্ভর করবে। সার্চ ইঞ্জিনের উত্তর ভুল না সঠিক- সেটি নিজেরা যাচাই করতে যাবে না। নানা কারণে এটা খুব বিপজ্জনক হতে পারে।

এই সমস্যা সমাধানে এবং গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভুল উত্তরের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখতে প্রচুর সংখ্যক ফ্যাক্ট চেকার বা তথ্য যাচাইকারী নিয়োগ দিতে পারে। তথ্য যাচাইকরণ প্রক্রিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্চ ইঞ্জিনের একটি বড় অংশ হতে যাচ্ছে।

অনলাইন শপিং হবে আরও সহজ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সার্চ অনলাইন শপিংকে আরও সহজ ও প্রাণবন্ত করে তুলবে। অনেক সময় ব্যয় করে বিভিন্ন উৎপাদকের বিভিন্ন পণ্যের বিভিন্ন রিভিউ নিজে না দেখে শুধু এআই চ্যাটবটের সাহায্যে কাঙ্ক্ষিত ক্যাটাগরির কোনো পণ্যটির রিভিউ সবচেয়ে ভালো সেটি জিজ্ঞেস করা যাবে। এতে অনেক সময়ও বাঁচবে, সহজে সিদ্ধান্তও নেওয়া যাবে।

শুধু তা-ই নয়। দুটি পণ্যের ভালো দিক, সীমাবদ্ধতা, ফিচার ও দামগত পার্থক্যও এক নিমিষেই বের করতে পারবে এই চ্যাটবট। ফলে ব্যবহারকারী কোন পণ্যটি কিনবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। এমনকি সেখানে সরাসরি সংশ্লিষ্ট পণ্য কেনার জন্য অ্যামাজন বা অন্যান্য বড় বড় অনলাইন শপিং প্রতিষ্ঠানের লিংকও দেওয়া থাকবে, যাতে ব্যবহারকারী এক ক্লিকে পণ্যটি কিনে ফেলতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন ব্যবহারকারী এবং অ্যামাজনের মতো অনলাইন জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু যারা পণ্যের রিভিউ দেয়, তারা হয়তো এতে অতটা সন্তুষ্ট হবে না। তাদের দেওয়া রিভিউ এআই চ্যাটবট ব্যবহারকারীকে সংক্ষিপ্ত রূপে দেখাবে, এটাও হয়তো তাদের জন্য সুখকর হবে না।  

মানুষের লেখা কনটেন্টের গুরুত্ব আরও বাড়বে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি কনটেন্ট গুগলের সার্চ নিয়মের বিরুদ্ধে যায় না, এটা ঠিক। তবে প্রতিষ্ঠানটি এই বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছে, 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি কনটেন্ট কৌশলে সার্চ রেজাল্টে প্রথম দিকে দেখানোটা হবে স্প্যাম পলিসির লঙ্ঘন'।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি কনটেন্টকে টেমপ্লেট বা নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু সেগুলোকে চূড়ান্তরূপে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। তাহলে হয়তো সার্চ ইঞ্জিনগুলো ধীরে ধীরে এসব কনটেন্টকে সার্চ রেজাল্টে আর দেখাবে না। চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে বাড়ির কাজ করা এক জিনিস, কিন্তু এটি ব্যবহার করে সরাসরি বাণিজ্যিক কনটেন্ট তৈরি করাটা হবে একইসঙ্গে অনৈতিক এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্চের জগতে মানুষের তৈরি মৌলিক ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার কনটেন্টের গুরুত্ব হবে সীমাহীন। কারণ? মানুষ যেমন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফোন করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি উত্তর শুনতে চায় না, একইভাবে ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি কোনো কনটেন্টও কেউ পড়তে চাইবে না। 

ওয়েবসাইটের ট্রাফিক কমবে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে আমাদের সময় বাঁচাবে এবং আরও নতুন চাকরি সৃষ্টি করবে, সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু একটি মূল বিষয়কে কেউ ততটা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করছে না। সেটি হচ্ছে এর মাধ্যমে ওয়েবসাইটগুলোর অর্থ আয়ের সুযোগ কতটা থাকবে। এআই সার্চের আরও উন্নতির ফলে মানুষ কোনো কিছু সার্চ করলে সার্চ রেজাল্টেই মনের মতো উত্তর পেয়ে যাবে, তাকে আর কষ্ট করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা লাগবে না। 

এটা ব্যবহারকারীদের জন্য দারুণ একটি ব্যাপার, কিন্তু ইন্টারনেটভিত্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ।

বর্তমানে যে ইন্টারনেট আমরা ব্যবহার করি, তার মূল ভিত্তি বিজ্ঞাপনী আয়। মানুষ যদি বিভিন্ন আর্টিকেল এবং ওয়েব পেজে ভিজিট করা কমিয়ে দেয়, তাহলে ওয়েবসাইটগুলো ভিজিটর হারাবে, যা তাদের আয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। আয় কমে গেলে তাদেরকে কর্মীছাঁটাই করতে হবে।

কর্মীছাঁটাই করলে কনটেন্ট উৎপাদন কমে যাবে যার ফলে এআই চ্যাটবট ব্যবহারকারীকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পর্যাপ্ত কনটেন্ট খুঁজে পাবে না, যা তার সংক্ষেপে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতাকে খাটো করবে। এতে সার্চ রেজাল্টের মান কমে যাবে। এই মান কমতে কমতে এক পর্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্চের মৃত্যুও হতে পারে।

এমন সম্ভাবনার ব্যাপারে মাইক্রোসফট বলছে, শুধু চ্যাটবটের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে মানুষ হয়তো কোনো বিষয়ে আরও গভীরভাবে জানতে লিংকে ক্লিক করবেই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তাৎক্ষণিক উত্তর চায় এবং সেটি পেয়ে গেলে তারা কোনো লিংকে ক্লিক করবে না। সময়ই বলে দেবে ওয়েবসাইট বা কনটেন্ট নির্মাতার কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে। 

 

তথ্যসূত্র: এমইউও

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

14h ago